সমুদ্রের বুকে 'অদৃশ্য' শিব মন্দির! রহস্যময় এই ধর্মস্থান রয়েছে ভারতেই
অলৌকিক এই মন্দিরের দৈবিক প্রভাব চলে আসছে যুগ যুগ ধরে, যা বিস্ময়ের সমস্ত সীমা অতিক্রম করেছে ভক্ত ও পর্যটকবৃন্দর।
ঈশ্বরকে যে কোনও ভাগ্যবানই কেবল ‘দেখিবারে পায়’, সেকথা ভক্তমাত্রই বিশ্বাস করে। কিন্তু, ভগবানের মন্দিরও মধ্যে মধ্যে অদৃশ্য হয়ে যেতে পারে! চোখের সামনে বিস্তৃত এক জলরাশি। তারই মাঝে চোখের পলকে হঠাত্ই ভেসে উঠল একটি বড় মন্দির- এমন দৃশ্য কল্পনা করতে যেন গায়ে কাঁটা দেয়! সত্যিই এমন এক অলৌকিক দৃশ্যর দেখা মেলে আরব সাগরে। এই ভারতের মাটিতেই রয়েছে সেই মন্দির এবং স্বাভাবিকভাবে তা দেবাদিদেব মহাদেবেরই মন্দির।
আত্মভোলা শিবের বরাবরই পছন্দ গহিন অরণ্য, নির্জন শ্মশান, সুউচ্চ পর্বতশৃঙ্গ অথবা গভীর সমুদ্রগর্ভ। শুধুমাত্র ভক্তির জন্যই যে কোনও ধর্মস্থানে যেতে হবে, ব্যাপারটা ঠিক তেমন নয়। অনেক সময় সেই ধর্মস্থানের পিছনে লুকিয়ে থাকে অন্য কোনও ইতিহাস। গুজরাতের স্তম্ভেশ্বর শিব মন্দির তেমনই একটি মন্দির। প্রতিদিন জোয়ারের জলে ডুবে যায় এই মন্দির। আবার ভাটার সময় জেগে ওঠে। অলৌকিক এই মন্দিরের দৈবিক প্রভাব চলে আসছে যুগ যুগ ধরে, যা বিস্ময়ের সমস্ত সীমা অতিক্রম করেছে ভক্ত ও পর্যটকবৃন্দর। মনে প্রশ্ন জেগেছে, কে নির্মাণ করেছিলেন এই মন্দির? কেনই বা দিনে দু'বার অদৃশ্য হয়ে যায় তা?
গুজরাতের বরোদা থেকে ৪০ কিলোমিটার দূরে ছোট্ট শহর কাভি কাম্বোই। এই শহরের পাশ দিয়ে বহমান আরব সাগর ও ক্যাম্বি উপসাগরের মাঝামাঝি উপকূলীয় তটরেখায় অবস্থিত মহাদেবের রহস্যময় এই মন্দির। এর নাম শ্রী স্তম্ভেশ্বর মহাদেব মন্দির। মন্দিরের নামের মাহাত্ম্য জানা না গেলেও এর অলৌকিকত্বর জন্য ইতিমধ্যে সারা বিশ্বের মনোযোগ আকর্ষণ করেছে এই মন্দির। প্রতিদিন সকাল ও সন্ধ্যায় মন্দিরটি শিবলিঙ্গ-সহ সমুদ্রগর্ভে বিলীন হয়ে যায়, আবার কিছুক্ষণ পরেই দৃশ্যমান হয় সমুদ্রের জলস্তর নিচে নামলে। স্রষ্টার এমন অপরূপ লীলা দেখার জন্য শুধু ভারতই নয়, সমগ্র বিশ্ব থেকে কৌতূহলী মানুষ ছুটে আসেন। সমুদ্রের জলে মন্দিরের সম্পূর্ণ নিমজ্জন এবং তারপর আস্তে আস্তে তার জলমুক্তির দৃশ্য— স্বভাবতই এক অলৌকিক অভিজ্ঞতা পর্যটকদের কাছে।
আরও পড়ুন: বিপুল ধনসম্পদ পাহারা দিচ্ছে বিষধর সাপ! যে কারণে আজও রহস্যময় এই মন্দির
এই মন্দিরের রীতি হলো, ভক্তরা সকাল সকাল চলে যান মন্দিরে, পূজার্চনা সেরে নেন। তারপর শুরু হয় তাঁদের অপেক্ষা। সেই সময়টা কেউ কেউ সমুদ্রের শোভা উপভোগ করেন, কেউ বা মন্দিরে বসেই ঈশ্বরচিন্তায় নিমগ্ন হন। তারপর জোয়ারের সময় এগিয়ে আসার সঙ্গে সঙ্গে ফাঁকা হয়ে আসতে থাকে মন্দির চত্বর। ভক্ত ও দর্শনার্থীরা নিরাপদ দূরত্বে সরে যান। তাঁদের চোখের সামনে শুরু হয়ে যায় আশ্চর্য প্রাকৃতিক লীলা। জোয়ারের জল বাড়তে বাড়তে গ্রাস করে ফেলে পুরো মন্দিরটাকেই। তখন সেদিকে তাকালে মন্দিরের অস্তিত্ব পর্যন্ত চোখে পড়ে না। কিছুক্ষণ কাটে এইভাবে। তারপর আবার সরে যেতে থাকে জোয়ারের জল। জলের ওপরে প্রথমে দৃশ্যমান হয় মন্দিরের চূড়া। তারপর আস্তে আস্তে গোটা মন্দির জেগে ওঠে জল থেকে। সাময়িকভাবে মন্দিরটি মানবদৃষ্টির সম্পূর্ণ আড়ালে চলে যায় বলেই একে অনেকে ‘অদৃশ্য মন্দির’ বলে থাকেন। বলা হয়, প্রকৃতি নিজের হাতে মহাদেবের জলাভিষেক করান।
স্তম্ভেশ্বর মহাদেব মন্দিরের ইতিহাস
স্তম্ভেশ্বর মহাদেব মন্দিরটি ১৫০ বছরের পুরনো মন্দির। এটি অদৃশ্য শিব মন্দির হিসাবেও পরিচিত। মাতৃ-প্রকৃতির মাঝে অবস্থিত, স্তম্ভেশ্বর মহাদেব মন্দিরটি ভক্তদের ভগবান মহাদেবের সবচেয়ে ঐশ্বরিক দর্শন। আপনি যদি মন্দিরের গর্ভে থাকেন, তবে আপনি চারদিক থেকে ঢেউয়ের শব্দ শুনতে পাবেন। মন্দিরটি পঞ্চভূজের আকারে এবং একটি সেতু দ্বারা উপকূলে সংযুক্ত। শিবলিঙ্গটি ৪ ফুট লম্বা।
পুরাণে উল্লেখ
প্রশ্ন হল, কে নির্মাণ করেছিলেন এই মন্দির? আর কীভাবেই বা অথৈ সমুদ্রের মাঝে এমন মন্দির নির্মাণ করা সম্ভব হল? হিন্দু পুরাণ বলছে, এই মন্দিরটির নামের সঙ্গে জড়িয়ে রয়েছেন স্বয়ং ভগবান শিব, তার পুত্র, দেবসেনাপতি কুমার কার্তিক ও তারকাসুর নামের ভয়ানক এক অসুর। কোনও এক সময় তারকাসুর নামের এক মহাপরাক্রমশালী অসুর মহাদেবের কাছ থেকে বর লাভ করেন যে, একমাত্র মহাদেবের পুত্র ব্যতিরেকে তাঁকে কেউ হত্যা করতে পারবে না। যা এক কথায় প্রায় অমরত্বের শামিল। কারণ মহাদেব শ্মশানচারী এবং সন্ন্যাসী। সুতরাং, তাঁর পক্ষে গৃহী বা পিতা, কোনওটিই হওয়া সম্ভব নয়। বর পেয়ে তারকাসুর স্বর্গ-মর্ত্য-পাতালে তুমুল তাণ্ডবলীলা শুরু করলেন। সমগ্র সৃষ্টি ত্রাহি ত্রাহি রব তুলে কাঁপছে তাঁর অত্যাচারে।
এভাবেই সৃষ্টিতে যখন মহাপ্রলয় ঘটার জোগাড়, তখনই কুমার কার্তিক জন্ম নিলেন মহাদেব শিব ও মাতা পার্বতীর ঘরে। এরপর বরদান অনুযায়ী তিনি হত্যা করলেন মহাপরাক্রমশালী তারকাসুরকে। শান্তি ফিরে এল পৃথিবীতে। কিন্তু তারকাসুরের মৃত্যুর পর যখন কুমার কার্তিক জানতে পারলেন যে, এই অসুর স্বয়ং তাঁর পিতা শিবের ভক্ত ছিলেন, তখন তিনি প্রচণ্ড ভেঙে পড়লেন। চরমতম পাপবোধ গ্রাস করল কুমার কার্তিককে। এমতাবস্থায় এগিয়ে এলেন শঙ্খ-চক্র-গদা-পদ্মধারী শ্রী নারায়ণ। তিনি কার্তিককে বোঝালেন, পাপীকে বিনাশ করার মধ্যে কোনও পাপবোধ নেই। কিন্তু তবুও পাপবোধ নিবৃত্ত হচ্ছিল না কার্তিকের। তখন শ্রীহরি তাঁকে মহাদেবের আরাধনা করে পাপস্খালনের পরামর্শ দিলেন। তাঁর পরামর্শে কুমার কার্তিক আরব সাগরের যে স্থানে বসে মহাদেবের আরাধনা করেছিলেন, সেখানেই পরবর্তীকালে নির্মিত হয় স্তম্ভেশ্বর মহাদেব মন্দির। তবে এর আগে এখানে কোনও মন্দির ছিল কি না, বর্তমান মন্দিরটি কে এবং কীভাবে নির্মাণ করেছিলেন, তা আর জানা যায় না।
এই মন্দিরকে ঘিরে লোকমুখে অনেক ইতিহাস রয়েছে। কেউ বলেন, বাবা নাকি কাউকে খালি হাতে ফেরান না। অন্য মতে, বাবার দেখা পাওয়া নাকি সৌভাগ্যের ব্যাপার। আবার অনেকে মনে করেন, পাণ্ডবদের সময়কালে নির্মিত হয়েছিল এই মন্দির। অনেকের মতে, পাণ্ডবরা কুরুক্ষেত্রর মহাযুদ্ধে জিতেছিলেন ঠিকই; কিন্তু গুরুহত্যা, ভ্রাতৃহত্যা, জ্ঞাতিহত্যার পাপ কলঙ্ক হয়ে তাঁদের মাথায় চাপল। সেই পাপস্খালনের জন্য তাঁদের সেই ইন্দ্রপ্রস্থ থেকে এত দূরে আসতে হয়েছিল। মিথ্যে কথা বলা, অন্যায়-যুদ্ধ ইত্যাদি পাপ কলঙ্ক হয়ে তাঁদের মাথায় চাপল। পাণ্ডবরা পড়লেন মহা বিপদে। কলঙ্কটা না গেলে তাঁদের এত কষ্ট করে জেতা যুদ্ধটার জয়ের গৌরব ঠিকমতো পাওয়া যাচ্ছে না। দ্বাপর যুগ তো আর একুশ শতক নয় যে, যুদ্ধে (ভোটযুদ্ধে) একবার জিতে গেলেই আগের সব কেলেঙ্কারির কলঙ্ক হাপিশ হয়ে গিয়ে একেবারে ধোয়া তুলসীপাতা। তখন লোকে পাপ-টাপকে খুব ভয় পেত, এমনকী, দিগ্বিজয়ী রাজা হলেও। পাণ্ডবরা তাই নিজেদের কলঙ্কমোচনের জন্য ব্যস্ত হয়ে পড়লেন।
কিন্তু অতসব গুরুতর পাপের কলঙ্কমোচন অত সহজ নয়। অনেক চেষ্টা করেও পাণ্ডবরা কোনও উপায় খুঁজে পেলেন না। অগত্যা তাঁরা অগতির গতি, সকল মুশকিলের আসান শ্রীকৃষ্ণকে পাকড়ালেন উদ্ধারের উপায়ের খোঁজে। শ্রীকৃষ্ণ উপায় বাতলালেন। উপায় আর কিছুই না, শিবকে সন্তুষ্ট করতে পারলেই শিব সব কলঙ্কমোচন করে ঝকঝকে স্টেনলেস স্টিলের মতো নিষ্কলঙ্ক করে দেবেন। খুব ভালো কথা। কিন্তু একটাই প্রবলেম। শিবকে সন্তুষ্ট করতে গেলে তো আগে তাঁর কাছে পৌঁছতে হবে। তিনি কোথায়? শিব তো ওদিকে সব জানতে পেরে লুকিয়ে পড়েছেন, অতসব গুরুতর পাপে পাপী পাণ্ডবদের ক্ষমা করার ইচ্ছে তাঁর নেই। পাণ্ডবরা শ্রীকৃষ্ণের সেই বাণী স্মরণ করে আবার তাঁর শরণাপন্ন হলেন – “অনন্যাচিন্তয়ন্তো মাং যে জনা পর্যুবাসতে/ তেষাং নিত্যাভিযুক্তাং যোগক্ষেমং বহ্যামহম্।” শ্রীকৃষ্ণ উপায় বাতলালেন। তিনি পাণ্ডবদের বললেন, “একটা কালো রঙের গরু আর একটা কালো রঙের ধ্বজা নিয়ে বেরিয়ে পড়ো। যেখানে গিয়ে দেখবে, ওই কালো গরু আর ধ্বজা সাদা হয়ে গেছে, সেখানেই শিব লুকিয়ে আছেন। ওখানে শিবের পুজো করলেই তোমরা কলঙ্কমুক্ত হবে। পাণ্ডবরা তাই করলেন। তাঁরা একটা কালো রঙের গরু আর একটা কালো রঙের ধ্বজা নিয়ে বেরিয়ে পড়লেন। ঘুরতে ঘুরতে তারা একদিন দেখলেন যে, কেল্লা ফতে! কালো রঙের গরু আর কালো রঙের ধ্বজা দুটোই ধবধবে সাদা হয়ে গেছে! তার মানে শিব এখানেই আছেন। পাণ্ডবরা সেখানে শিবের ধ্যানে বসার সঙ্গে সঙ্গে সেখানে পাথরের স্বয়ম্ভূ শিবলিঙ্গ আবির্ভূত হল এবং পাণ্ডবরা সেই শিবের পুজো করে কলঙ্কমুক্ত হলেন।"
এই স্তম্ভেশ্বর মহাদেব মন্দিরের একটি বিশেষত্ব হল, এখানকার ধ্বজাটি। এই ধ্বজাটি বছরে একদিন পাল্টানো হয়, বাকি ৩৬৪ দিন ঝড়-বৃষ্টি-সাইক্লোন যা-ই আসুক না কেন, ধ্বজাটি স্বস্থানেই থাকে, কখনওই উড়ে বা ছিঁড়ে যায় না। ভাদ্র মাসের পূর্ণিমায় এখানে পুজো দিতে বহু মানুষের আগমন হয়। অনেকেই মৃত আত্মীয়র অস্থি বিসর্জন করেন এখানে। অমাবস্যার দিনে এই মন্দিরের সামনে গভীর রাতে প্রার্থনা করার জন্য কয়েকশো ভক্ত ভিড় করেন। চারপাশে জলরাশি, তার মাঝে যখন মহাদেবের উপাসনা করা হয়, সে এক অনন্য অভিজ্ঞতা। জোয়ার শুরুর আগে পুজো শেষ করতে হয়, জোয়ার শুরু হলে মন্দিরটি আরব সাগরে ডুবে যেতে শুরু করে।
ভক্তরা গোটা বিষয়টিকেই ঐশ্বরিক লীলা হিসেবে ব্যাখ্যা করেন। তাঁদের ধারণা, স্বয়ং মা গঙ্গা এইভাবেই প্রকৃতির মাধ্যমে মহাদেবের জল-অভিষেক ঘটিয়ে থাকেন। তবে বিজ্ঞানীদের মতে, বিষয়টি সাধারণ প্রাকৃতিক নিয়মমাত্র। তবে ঘটনার নেপথ্য কারণ যাই-ই হোক, প্রতিদিন এইভাবে সমুদ্রজলে নিমজ্জিত হওয়ার পরেও মন্দির ও তাঁর অভ্যন্তরস্থ শিবলিঙ্গটি সম্পূর্ণ অক্ষত রয়ে গিয়েছে, এটাও যে কম বিস্ময়কর ঘটনা নয়, তা মানছেন বিজ্ঞানীরাও।