আসলে ঝুলন্ত হাওড়া ব্রিজ, কলকাতার এই গর্বের সঙ্গে জড়িয়ে যে অজানা ইতিহাস

১৯৪৩ সালের তুলনায় বহরে-ব্যস্ততায় কয়েকশো গুণ বেড়েছে আজকের কলকাতা ও হাওড়া। বেড়েছে ব্যস্ততা। বেড়েছে গাড়ি চলাচলও। তবুও একইরকমভাবে পরিষেবা দিয়ে যাচ্ছে এই সেতু। কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে আজও সে পাল্লা দিচ্ছে তরুণদের সঙ্গে।

১৯৪৩ সালে পথ চলা শুরু। তবে এর সঙ্গে জড়িয়ে থাকা ইতিহাস অনেক প্রাচীন। বয়স অনেক হয়েছে। কিন্তু আজও সে তরতাজা। পাল্লা দিতে পারে তরুণদের সঙ্গে। ইস্পাতের স্তম্ভগুলোয় বয়সের দাগ পড়েছে, পড়েনি মরচে। এতগুলো বছর ধরে কত গাড়িই না যাত্রা করেছে এই ব্রিজের ওপর দিয়ে। কত বণিকই না তাঁদের ব্যবসা ফুলিয়ে-ফাঁপিয়ে তুলেছে এই ব্রিজে সওয়ার হয়ে। এখনও হাওড়া ব্রিজে কান পাতলে শোনা যায় ধুকপুক আওয়াজ। কলকাতার হৃদস্পন্দন।

হাওড়া ব্রিজ মানে বিস্ময়। একবার সেই বিস্ময়ের চোরাগলিতে ঢুঁ মারা যাক।

একটিও নাট-বল্টু নেই
সাতশো মিটারেরও বেশি লম্বা, ৩০ মিটার চওড়া এই বিপুল আকারের ব্রিজটি তৈরিতে ব্যবহার হয়নি একটিও নাট-বল্টু। ধাতব পাত জুড়ে বিশেষ পদ্ধতিতে তৈরি হয়েছে এই ব্রিজ। এর নির্মাণের মধ্যে লুকিয়ে আছে কত না রহস্য!

আরও পড়ুন: ভালো নেই ঘোড়ার দল, কী হতে চলেছে কলকাতার ঐতিহ্য ঘোড়ার গাড়ির ভবিষ্যৎ?

ঝুলন্ত ব্রিজ
গোটা ব্রিজ তৈরিতে নদীর মাঝে কোনও পিলার ব্যবহার করা হয়নি। এই পদ্ধতিতে তৈরি ব্রিজকে বলা হয় সাসপেনসন টাইপ ব্যালান্সড ক্যান্টিলিভার ব্রিজ (suspension-type balanced cantilever bridge)। যখন এটি তৈরি হয়, তখন এটি পৃথিবীর তৃতীয় বৃহত্তম ক্যান্টিলিভার ব্রিজ ছিল। বর্তমানে এটি পৃথিবীর ষষ্ঠ বৃহত্তম ক্যান্টিলিভার ব্রিজ।

প্রথমে অন্য চেহারা
একদম প্রথমে হুগলি নদীর ওপর ছিল পল্টুন ব্রিজ। সেটা ১৮০০ শতকের ঘটনা। তারপর থেকে ইংরেজ আমলে ক্রমশ বেড়ে চলেছে কলকাতা। প্রশাসনিক ও ব্যবসায়িক কাজের ভরকেন্দ্র হয়ে উঠেছে কলকাতা শহর। তখন বড় ব্রিজ তৈরির ভাবনা আসে ইংরেজ শাসকের মাথায়। ইতিহাস বলে, প্রথমে ক্যান্টিলিভার ব্রিজ তৈরির পরিকল্পনা ছিল না। কী ব্রিজ তৈরি হবে, তা নিয়ে নানা আলোচনা হয়। কিন্তু সেগুলি কখনওই বাস্তবের মুখ দেখেনি। ১৯০৬ সালে হাওড়া স্টেশন তৈরির পর বেড়ে যায় হুগলি নদীর উপর একটি বড় সেতুর প্রয়োজনীয়তা।

ব্রিটিশ শক্তির নির্মিত স্থাপত্য
সাল ১৮৫৭, সিপাহী বিদ্রোহ দমন করে ব্রিটিশরা জাঁকিয়ে বসল ভারতের মাটিতে। ব্রিটিশ শাসনের রাজধানী ছিল কলকাতা। দেশের নানা সম্পদ বিদেশে রপ্তানি হতে শুরু করে। ব্যবসা-বাণিজ্য বাড়ল এবং পণ্যসামগ্রীর বিনিময়কে সহজ করার জন্য ১৮৬০ সালে তৈরি হল হাওড়া স্টেশন। কিন্তু রাজধানীর সঙ্গে কীভাবে যোগাযোগ হবে? বাণিজ্য বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে শুধুমাত্র জলপথে জিনিসপত্র ও যাত্রী পরিবহণ সম্ভব হচ্ছিল না। তাই হাওড়া ও কলকাতাকে সংযোগকারী একটি সেতু নির্মাণের চিন্তাভাবনা করা হল। ১৮৭১ সালে তৎকালীন ব্রিটিশ সরকার কর্তৃক পাস হল 'The Howrah bridge Act' এবং কলকাতা পোর্ট ট্রাস্টকে এই সেতুটি নির্মাণের তদারকির দায়িত্ব দেওয়া হল।

এরপর বিখ্যাত সিভিল ইঞ্জিনিয়ার স্যার ব্র্যাড ফোর্ড লেসলির সঙ্গে হুগলি বক্ষে একটি ভাসমান ব্রিজ তৈরি করার চুক্তি হল। তবে সেতুটি নির্মাণকালে প্রাকৃতিক দুর্যোগ দ্বারা ক্ষতিগ্রস্ত হলেও ১৮৭৪ সালে ব্রিজটির পরিকল্পনা বাস্তবায়িত হয়। এই ব্রিজটি তৈরি করতে খরচ হয়েছিল প্রায় ২২ লক্ষ টাকা। ব্রিজটির বিভিন্ন অংশ ইংল্যান্ড থেকে আমদানি করে এখানে সংযোগ করা হয়। ব্রিজটি ছিল ১৫২৮ ফুট লম্বা, ৬২ ফুট চওড়া।

প্রথম বিশ্বযুদ্ধ-সহ অন্যান্য নানা বাধা পার করে অবশেষে ১৯৩৭ সালে রেন্ডল পামার অ্যান্ড ট্রেটন কোম্পানির চিফ ড্রাফটসম্যান মি: ওয়ালটন-এর ডিজাইন অনুযায়ী শুরু হয় হাওড়া ব্রিজ নির্মাণের কাজ। ব্রিজ নির্মাণের তত্ত্বাবধানে ছিল ক্লিভল্যান্ড ব্রিজ অ্যান্ড ইঞ্জিনিয়ারিং কোম্পানি। সহযোগী ছিল ব্রেথওয়েট বার্ন অ্যান্ড জেসপ কনস্ট্রাকশন কোম্পানি।

কিন্তু আবারও বাধা। ১৯৩৯ সালে শুরু হয় দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ। ফলে যে ব্রিজটি তৈরির জন্য প্রয়োজন ছিল ২৬০০০ টন স্টিল, তার মাত্র ৩০০০ টন স্টিল দেওয়ার পরেই ইংল্যান্ড থেকে বন্ধ হয়ে যায় স্টিলের সরবরাহ। কিন্তু ব্রিজটি তো অত্যন্ত জরুরি। তাই তখন ভারতের টাটা স্টিল কোম্পানি প্রস্তুত করে বাকি ২৩ হাজার টন হাইটেনশন স্টিল এবং প্রায় ২ কোটি ৫০ লক্ষ টাকা খরচ করে তৈরি হয় ২৩১৩ ফুট দৈর্ঘ্য, ৭১ ফুট প্রস্থ ও ২৬৯ ফুট উচ্চতা সম্পন্ন হাওড়া ব্রিজ। এই ব্রিজের একটি আশ্চর্যজনক বিষয় এই বৃহৎ ব্রিজটি তৈরি করতে একটিও নাট-বল্টু ব্যবহৃত হয়নি। অবশেষে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ চলাকালীন সময়ে ১৯৪৩ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে জাপানিদের সম্ভাব্য আক্রমণের ভয়ে অনাড়ম্বরভাবেই শুধুমাত্র একটি ট্রাম চালিয়ে উদ্বোধন করা হয় এই বিখ্যাত হাওড়া ব্রিজের।

প্রাকৃতিক-অপ্রাকৃতিক ঝড়ঝাপটা সামলে অবিরাম কাজ করে চলেছে হাওড়া ব্রিজ। ৬০ হাজার টন ওজন নেওয়ার ক্ষমতাধারী এই ব্রিজ প্রায় এক লক্ষ টন ভার বহন করছে। কিন্তু মানুষের কিছু ক্রিয়া-কলাপে আজ এই অবিশ্বাস্য স্থাপত্য ধ্বংসের মুখে। এই ব্রিজের রক্ষণাবেক্ষণের দায়িত্বে রয়েছে কলকাতা পোর্ট ট্রাস্ট, যারা ইস্পাতের পিলারগুলিকে fibred glass দিয়ে ঢেকে এত বছরের পুরনো এই ঐতিহাসিক স্থাপত্যকে রক্ষা করার চেষ্টা করে চলেছে। কিন্তু বাংলার গর্ব বা গেটওয়ে অফ কলকাতা-কে রক্ষা করার দায়িত্ব সব মানুষের। ১৯৬৫ সালে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের নামে নামাঙ্কিত হয় হাওড়া ব্রিজ। নতুন নাম হয় রবীন্দ্র সেতু। ফলকে নাম বদলালেও, এতদিন পরেও লোকের মুখে মুখে রয়ে গিয়েছে পুরনো নামই।

১৯৪৩ সালের তুলনায় বহরে-ব্যস্ততায় কয়েকশো গুণ বেড়েছে আজকের কলকাতা ও হাওড়া। বেড়েছে ব্যস্ততা। বেড়েছে গাড়ি চলাচলও। তবুও একইরকমভাবে পরিষেবা দিয়ে যাচ্ছে এই সেতু। কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে আজও সে পাল্লা দিচ্ছে তরুণদের সঙ্গে। কলকাতা ও হাওড়ার যোগসূত্র এই স্থাপত্যে লেখা আছে অনেক ঐতিহাসিক কাহিনি। লেখা আছে অনেক ব্যবসার উত্থানপতন। আর প্রেমিক-যুগলের অনেক না-বলা কথাও টুকে রেখেছে এই স্থাপত্য। তাই গঙ্গার ওপরে নিরন্তর দাঁড়িয়ে থাকা এক আবহমানতার নাম হাওড়া ব্রিজ।

More Articles