ভালো নেই ঘোড়ার দল, কী হতে চলেছে কলকাতার ঐতিহ্য ঘোড়ার গাড়ির ভবিষ্যৎ?

কলকাতায় এক সময় বড়লোকদের স্ট্যাটাস সিম্বল ছিল এই‌ গাড়ি। বর্তমানে এই ঘোড়ায় টানা গাড়ি দেখা যায় শুধু ভিক্টোরিয়ার সামনে।

শহরের এঁদো গলি। শীর্ণ পথ ধরে এগিয়ে চলেছে ঘোড়ার গাড়ি (তবে সেই গাড়ি অবশ্য আভিজাত্যের প্রতীক নয়), ঘোড়ার গাড়িতে চেপে নতুন বউকে নিয়ে নিজের ভাড়া বাড়িতে পৌঁছল অপু। গাড়ি থামল জীর্ণ বাড়ির সামনে। দরজা খুলে প্রথমে নামল অপু। তারপর অপর্ণা। অপর্ণার হাতে বিয়ের মুকুট। সত্যজিতের 'অপুর সংসার’ ছবিতে এভাবেই জায়গা করে নিয়েছিল ঘোড়ার গাড়ি। বহু সিনেমায় ঠাঁই পেয়েছে জুড়িগাড়ি। কলকাতার ইতিহাসের সঙ্গে একাত্ম হয়ে সেই কবে থেকে অলিগলি-রাজপথে সফর করছে ঘোড়ায় টানা গাড়ি। ঘোড়াগুলি ক্লান্ত হয়েছে, তবু তার সফর থামেনি। একসময়ে এই ঘোড়ার গাড়ি ছিল শহরের স্ট‍্যাটাস সিম্বল।

ভিক্টোরিয়ার মুখ থেকে পার্ক স্ট্রিট-ময়দান হয়ে এক চক্কর। মূল্য ৫০০ টাকা। এ আর এমন কী! জুড়িগাড়ির ঐতিহ্য আছে, কলকাতার ইতিহাসের সঙ্গে এর সম্পর্ক আছে, তবে ভালো নেই ঘোড়াগুলি। হাড়-জিরজিরে সাদা ঘোড়া। তাকেই টেনে-হিঁচড়ে টগবগ করতে রাজি করানো। না করলেই পিঠে চাবুকের ঘা। গলা থেকে চিঁহি ডাক। অথচ এই ঘোড়ার গাড়িই ছিল একসময়ে কলকাতার কেতা। ইংরেজরা নাকি ঘোড়ার গাড়ি নিয়ে রাস্তায় ঘুরতেন। শহর-বিহারে যেতেন। এখন জীর্ণ ঘোড়াগুলি আর টেনে নিয়ে যেতে পারছে না শহরের ঐতিহ্য।

ইতিহাস বলছে, ১৭৯৮-'৯৯ সালে তৈরি হয় শহরের প্রথম চওড়া রাস্তা— সার্কুলার রোড। লর্ড ওয়েলেসলি বাংলার গভর্নর জেনারেল থাকাকালীন ক্রমশ বাড়তে থাকল বাঁধানো রাস্তার সংখ্যা আর শহরের পরিধি। ১৮০৫-এর পরে তৈরি হয় স্ট্র্যান্ড রোড, ওয়েলিংটন স্ট্রিট, কলেজ স্ট্রিট, আমহার্স্ট স্ট্রিট, মির্জাপুর স্ট্রিট, হেয়ার স্ট্রিটের মতো গুরুত্বপূর্ণ কিছু রাস্তা। খোয়াবাঁধানো রাস্তা আর ঘোড়ার গাড়ির যুগলবন্দিতে বেড়ে গেল শহরটার গতি। পরিচয় হল ব্রাউনবেরি, ল্যান্ডো, ফিটন, ব্রুহাম, ছ্যাকরা, টমটম-এর মতো নানা কিসিমের গাড়ির সঙ্গে। তার পরে প্রায় এক শতাব্দী ঘোড়ার গাড়িই ছিল আভিজাত্যের প্রতীক, আবার শহরের একমাত্র গণ-পরিবহণও। উনিশ শতকের বাংলা সাহিত্যেও হামেশাই মেলে ঘোড়ায় টানা গাড়ির উল্লেখ।

আরও পড়ুন: ই-জঞ্জালে ভরেছে কলকাতা, নরকে চোখ বুজে আছেন আপনি?

এখন আর ঘোড়ায় টানা জুড়িগাড়ি কিংবা অতীতের ঘোড়ায় টানা ফিটন গাড়ির দিন নেই। তবে জুড়িগাড়ি আর ফিটন কিন্তু এক নয়। কারিগরি দিক থেকে অনেকটাই আলাদা। তবে সেসবের মধ্যে না গিয়ে যদি সরাসরি একে ঘোড়ায় টানা গাড়ি বলে আমরা উল্লেখ করি, তাহলে বলা যেতে পারে যে, কলকাতায় এক সময় বড়লোকদের স্ট্যাটাস সিম্বল ছিল এই‌ গাড়ি। বর্তমানে এই ঘোড়ায় টানা গাড়ি দেখা যায় শুধু ভিক্টোরিয়ার সামনে। ট্যুরিস্টরা এই ঘোড়ার গাড়ি চেপে, ভিক্টোরিয়ার সামনে থেকে পার্ক স্ট্রিট হয়ে ময়দান চক্কর দেন মাত্র ৫০০ টাকার বিনিময়ে। তবে তাতেও চলে দরদাম।

কলকাতার পুরনো ইতিহাস ঘাঁটলে চোখে পড়ে, এই শহরে ইংরেজদের আগমনের পর থেকেই আধুনিকতার ছোঁয়া লাগতে শুরু করে। ইংরেজদের পাশাপাশি শহরের বাঙালিবাবুদের চাহিদায় এই গাড়ির চাহিদা বাড়তে শুরু করে। ১৭৭৫ সালে কলকাতার পণ্ডিতিয়া অঞ্চলে উইলিয়াম জনসন নামের এক ইংরেজ সাহেব প্রথম এই ঘোড়ার গাড়ির কারখানা তৈরি করেছিলেন। ধীরে ধীরে এই গাড়ির চাহিদা এবং জনপ্রিয়তা তুমুল বাড়তে থাকে। কাজের সুবাদে ইংরেজরা দ্রুত যাতায়াতের জন্য এই গাড়ি ব্যবহার করতেন, তেমনই কলকাতার বড়লোক বাবুদের শখ এবং ঠাঁটবাট বজায় রাখার জন্যও এই গাড়ির চাহিদা ছিল তুঙ্গে। উইলিয়াম জনসনের পর কলকাতায় বেশকিছু ঘোড়ার গাড়ি তৈরির কারখানা চালু হয়। এর মধ্যে ওল্ড কোর্ট হাউজ স্ট্রিটে স্টুয়ার্ট অ্যান্ড কোম্পানি ১৭৮৩-'৮৪ সালে তাদের ঘোড়ার গাড়ির কারখানা তৈরি করে। এই স্টুয়ার্ট অ্যান্ড কোম্পানিই প্রথম রেলের যাত্রীবাহী কোচের নির্মাণ করেছিল ভারতে। এই কোম্পানির মালিক ছিলেন তিন ভাই– জেসপ, রবার্ট এবং উইলিয়াম।

এই গাড়ি তৈরির ক্ষেত্রে কাঠ ছাড়া বাকি সমস্ত যন্ত্রাংশই আসত ইংল্যান্ড থেকে। কলকাতায় শুধুমাত্র কাঠ দিয়ে গাড়ির কাঠামো তৈরি করে সেই সময় যন্ত্রাংশ অ্যাসেম্বল ও ফিনিশিং করে গাড়িগুলিকে রাস্তায় নামার যোগ্য করে তোলা হত। যেহেতু বিদেশ থেকে আসত যন্ত্রপাতি, ফলে সেই সময় একটি ভালো গাড়ির দাম হতো অনেক বেশি। তবে দাম কমাতে কোম্পানিগুলি বহু এদেশীয় মানুষকে কারখানায় নিযুক্ত করতে শুরু করে। বিভিন্ন ইংরেজ ইঞ্জিনিয়ারদের এদেশে এনে দেশেই তৈরি হতে থাকে এই গাড়ির যন্ত্রাংশ। এরপর এই জুড়িগাড়ির এত লম্বা সফর।

ময়দানে এই ঘোড়ার গাড়ি বন্ধ করতে আদালতে একটি জনস্বার্থ মামলা দায়ের করেছিল পশুপ্রেমী সংগঠন পেটা (PETA)। এবার ময়দানের ঘোড়া চালানো নিয়ে খোদ রাজ্য সরকার কী ভাবছে, ৫ এপ্রিল তা জানতে চাইল কলকাতা হাই কোর্ট। ঘোড়ার গাড়ি চালানোর পক্ষেই কি মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের সরকার রয়েছে? না হলে এই ঘোড়াদের নিয়ে রাজ্যের কী ভাবনা? একমাসের মধ্যে তা জানতে চেয়ে নির্দেশ দেন হাই কোর্টের প্রধান বিচারপতি প্রকাশ শ্রীবাস্তব।

আদালতের কাছে মামলাকারীদের আর্জি ছিল, হাই কোর্টের তরফে দ্রুত একটি কমিটি গড়া হোক, যারা ঘোড়াদের স্বাস্থ্য পরীক্ষা করবে। ময়দান এলাকায় ঘুরতে গেলে দেখা যায়, সেখানে গাড়ি টানা কিংবা মাঠে চড়ে বেড়ানো বেশ কিছু ঘোড়ার শারীরিক অবস্থা অত্যন্ত খারাপ। হাড়-পাঁজর চামড়ার ওপর দিয়ে দিব্যি গোনা যায়। অল্প কিছুক্ষণ গাড়ি টানার পরেই দেখা যায়, সে রীতিমতো ধুঁকছে। কিন্তু এসব নিয়ে ঘোড়ার মালিকরা একেবারেই উদাসীন। সেদিন অবশ্য মালিকদের বক্তব্য শোনা যায়নি।

করোনার সময় ঘোড়াগুলির অবস্থা খুবই খারাপ হয়ে যায়। মানুষ গৃহবন্দি। কাজ ছিল না। মানুষ খেতে পায়নি। ঘোড়াগুলির অবস্থা কী ভেবে দেখুন! এই পশুদের ওপর নির্ভর করেই তো চলত মালিকদের সংসার। সেই মারণ-থাবার হাত থেকে রক্ষা পায়নি এই ঘোড়ার দল। কাজ তো ওদেরও নেই। তাই নেই খাবার। নিয়মিত খাবার না পেয়ে ক্রমশ দুর্বল হয়ে পড়েছে ঘোড়াগুলি। তার মধ্যে মারা যায় কয়েকটি ঘোড়াও। ফলে দেরিতে হলেও পশুপ্রেমী সংগঠন যে আওয়াজ তুলবে, সেটাই তো স্বাভাবিক।

 

 

More Articles