চিনকে টেক্কা দিতেই শ্রীলঙ্কার পাশে ভারত?

আর্থিক ব্যাধিতে ভুগতে থাকা শ্রীলঙ্কার সঙ্গে বাণিজ্যিক রফতানিতে লেনদেনের সমস্যার মুখোমুখি হচ্ছিলেন ভারতের রফতানিকারীরা। এই সমস্যার সুরাহা করেছে ভারতের রিজার্ভ ব্যাঙ্ক এশিয়ান ক্লিয়ারিং ইউনিয়ন।

 

বলা বাহুল্য, ভারতের অর্থনীতি ভালো নেই। টাকার দামে রেকর্ড পতন। ডলার-প্রতি ৮০ টাকায় দাঁড়িয়েছে অর্থমূল্য। কাজেই ভারতীয় অর্থনীতিতে বিপুল ধাক্কা আসতে চলেছে, তাতে সন্দেহ নেই। টাকার দাম পড়ে যাওয়াই তার স‌ংকেত বলে মনে করছেন অর্থনীতিবিদরা। বিশেষ করে প্রভাব পড়বে আন্তর্জাতিক বাণিজ্যে। এর ফলে ধাক্কা খাবে দেশের অর্থনীতি। শেয়ারবাজারেও তার প্রভাব পড়বে। টাকার দামের পতনে নতুন করে শঙ্কার মেঘ দেখছেন শেয়ার বাজারের কারবারিরা। এই অবস্থায় ভারতের প্রতিবেশী শ্রীলঙ্কারও দিন কাটছে অর্থনৈতিক সংকটের মধ্যে। শ্রীলঙ্কার এই দুর্দিনে শুরু থেকেই পাশে থাকার বার্তা দিয়েছে নয়াদিল্লি। ভারতের পক্ষ থেকে সাধ্যমতো আর্থিক সাহায্যের কথা ঘোষণা করা হয়েছিল। এবার ভারত আরও এককদম এগিয়ে বন্ধুতার বার্তা দিল। তবে কূটনৈতিক বিশেষজ্ঞরা বলছেন, এই কঠিন সময় শ্রীলঙ্কাকে সাহায্য ভারতের জন্য কৌশলগত বিচক্ষণতার পরিচয় হবে। চিন যখন বন্ধুতার পরিচয় দেয়নি, তখন ভারতের সামনে শ্রীলঙ্কাকে সাহায্য করে নিজেকে বড় শক্তি হিসেবে প্রমাণ করার এ নেহাতই বড় সুযোগ।

ভারতীয় মুদ্রায় শ্রীলঙ্কার সঙ্গে বাণিজ্যিক লেনদেন
কয়েক মাস ধরেই শ্রীলঙ্কার আর্থিক সংকটের পরিস্থিতি চরমে উঠেছে। বিদেশি মুদ্রার ঘাটতির কারণেই দ্বীপরাষ্ট্রের আর্থিক সংকট তীব্র থেকে তীব্রতর হয়েছে। শ্রীলঙ্কার আর্থিক সংকট মোকাবিলায় শুরু থেকেই পাশে থাকার বার্তা দেয় ভারত। কিছুদিন আগে ভারতের পাশে থাকার বার্তা দিয়ে বিদেশ মন্ত্রকের মুখপাত্র অরিন্দম বাগচী জানিয়েছেন, "শ্রীলঙ্কার সরকার ও সাধারণ মানুষ প্রতিকূল অবস্থার মধ্য দিয়ে যাচ্ছে। আমরা সেই দিকে নজর রাখছি। ভারত ইতিমধ্যেই শ্রীলঙ্কার জনগণের পাশে দাঁড়িয়েছে। ইতিমধ্যে ভারত শ্রীলঙ্কাকে ৩.৮ বিলিয়ন মার্কিন ডলারের বেশি সাহায্য করেছে।‘’

বিদেশ মন্ত্রকের মুখপাত্র বিবৃতি দিয়ে এও জানান, "শ্রীলঙ্কা নিকটতম প্রতিবেশী। দুই দেশের বন্ধন নিবিড়। শ্রীলঙ্কা আমাদের প্রতিবেশী দেশের অগ্রাধিকার নীতির মধ্যে পড়ে। চলতি বছরে ভারত দ্বীপরাষ্ট্রকে ৩৮০ কোটি টাকার আর্থিক সহায়তা দিয়েছে, যাতে তারা চলতি আর্থিক পরিস্থিতির মোকাবিলা করতে পারে।"

আরও পড়ুন: মানুষের আস্থা ফিরবে? শ্রীলঙ্কার নতুন প্রেসিডেন্ট রনিল বিক্রমসিঙ্ঘের আসল পরিচয় জানুন

তবে আর্থিক ব্যাধিতে ভুগতে থাকা শ্রীলঙ্কার সঙ্গে বাণিজ্যিক রফতানিতে লেনদেনের সমস্যার মুখোমুখি হচ্ছিলেন ভারতের রফতানিকারীরা। এই সমস্যার সুরাহা করেছে ভারতের রিজার্ভ ব্যাঙ্ক এশিয়ান ক্লিয়ারিং ইউনিয়ন। ভারতীয় মুদ্রায় ভারত-শ্রীলঙ্কার বাণিজ্যিক লেনদেনের ছাড়পত্র দিয়েছে দেশের শীর্ষ ব্যাঙ্ক। বিজ্ঞপ্তি জারি করে রিজার্ভ ব্যাঙ্কের তরফে একথা জানানো হয়েছে। মার্চ মাসের ১৭ তারিখ ভারত সরকার আর্থিক সংকটে ভুগতে থাকা শ্রীলঙ্কাকে নিত্যপ্রয়োজনীয় সামগ্রী কেনার জন্য স্টেট ব্যাঙ্ক অফ ইন্ডিয়া মারফত ১০০ কোটি মার্কিন ডলার শর্তসাপেক্ষে ঋণের বন্দোবস্ত করে দেওয়ার কথা জানিয়েছিল। আর্থিক সংকটে ভুগতে থাকা দ্বীপরাষ্ট্রকে সহায়তার জন্য এই পদক্ষেপ করেছিল কেন্দ্রীয় সরকার। রিজার্ভ ব্যাঙ্ক সার্কুলার জারি করে জানিয়েছে, এই ব্যবস্থার আওতায় ভারত থেকে প্রয়োজনীয় পণ্য ও পরিষেবাগুলো রফতানির ক্ষেত্রে ভারতীয় মুদ্রা ব্যবহারের অনুমতি দেওয়া হচ্ছে।

ভারতের কৌশলগত অবস্থান
খোদ দেশের সরকার সেই দেশকে দেউলিয়া ঘোষণা করেছিল, এরপরও চিন কিন্তু শ্রীলঙ্কাকে ঋণ পরিশোধের বিষয়ে ছাড় দেয়নি। নয়াদিল্লির সামনে এটি পুরনো সম্পর্ক ঝালিয়ে নেওয়ার এটা বড় সুযোগ বলেই মনে করছেন কূটনীতিকরা।

এখন শ্রীলঙ্কায় চরম অরাজকতা। কিন্তু বেশ কিছুদিন ধরেই শ্রীলঙ্কায় বিনিয়োগের ক্ষেত্রে ভারতের সমস্যা ছিল। সমস্যা ছিল শ্রীলঙ্কাকে সাহায্যর ক্ষেত্রেও। সে যাই হোক, তামিলদের স্বার্থের কথা ভেবে এবং পরবর্তী সময় শ্রীলঙ্কার সুবিধার কথা ভেবে ভারত দ্বিপাক্ষিক সম্পর্ককে আরও মজবুত করার দিকে নজর দিয়েছে। এই সংকটেও ভারত প্রতিবেশী দেশের জনগণের হাত ছাড়েনি।

যদিও শ্রীলঙ্কা ভারতের প্রতিবেশী হিসেবে নীতিগত দিক থেকে একটি গুরুত্বপূর্ণ স্থান দখল করে আছে, তবু নয়াদিল্লি ও কলম্বোর মধ্যে ঘনিষ্ঠ বাণিজ্য ও উন্নয়নমূলক সম্পর্ক গড়ে তোলার প্রশ্নে কয়েক বছর ধরে কিছুটা শীতলতা লক্ষ করা গিয়েছিল। হাতে-গরম এই সুযোগ লুফে নেয় বেজিং। তারা প্রভাবশালী বিদেশি খেলোয়াড় হিসেবে উঠে এসেছে। এটা যে নেহাত কথার কথা নয়, তার প্রমাণ আছে। ২০১৫ সাল থেকে চিন ওই দেশের শীর্ষ একক ঋণদাতা এবং প্রত্যক্ষ বিদেশি বিনিয়োগের সবচেয়ে বড় উৎস হয়ে ওঠে। এমনকী, বাণিজ্যক্ষেত্রেও শ্রীলঙ্কা বা ভারতের চেয়ে চিন থেকে বেশি আমদানি করে। বেজিং সম্পর্কে ভারতের উদ্বেগ দ্বীপরাষ্ট্রে চিনা বিনিয়োগের প্রকৃতি এবং সংকটের প্রেক্ষাপটে তাদের অবস্থান।

প্রায়শই সমালোচিত হয়েছে শ্রীলঙ্কায় চিনা বিনিয়োগগুলি। তারা ঋণের ন্যায্যতা প্রমাণ করতে পারেনি অর্থাৎ সেগুলি থেকে যে ধরনের কর্মসংস্থান বা রাজস্ব প্রত্যাশিত ছিল, তার ব্যবস্থা করতে ব্যর্থ হয়েছে। ফলে প্রায়শই শ্রীলঙ্কা সরকার ঋণ পরিশোধ করতে পারেনি। এবং তার বিনিময়ে হাম্বানটোটার মতে বন্দর বা শহরাঞ্চল চিনকে হস্তান্তর করতে বাধ্য হয়েছে।

বলাই বাহুল্য, এত বড় ঋণদাতা হওয়া সত্ত্বেও চিনকে পাশে পায়নি শ্রীলঙ্কা। এই দুর্দিনে নয়াদিল্লির কলম্বোর পাশে থাকা শুধু বন্ধুতা নয়, বিচক্ষণতারও পরিচয় বলে মনে করছে রাজনৈতিক মহল। কূটনীতিবিদরা বলছেন, এর ফলে এশিয়ার মানচিত্রে নিজেদের শক্তিধর দেশ হিসেবে প্রতিষ্ঠা করার এটা একটা সুযোগও বটে। কূটনৈতিক পরামর্শ, ভারতের পক্ষে এই সুযোগ হাতছাড়া করা উচিত হবে না। কারণ বন্ধু হারালে বন্ধু পাওয়া যেমন দায়, তেমন একথাও সত্যি যে, opportunity comes once in a lifetime।

More Articles