মানুষের আস্থা ফিরবে? শ্রীলঙ্কার নতুন প্রেসিডেন্ট রনিল বিক্রমসিঙ্ঘের আসল পরিচয় জানুন

দীর্ঘ টানাপোড়েনের পর গত ১৪ জুলাই শ্রীলঙ্কার প্রেসিডেন্ট পদ থেকে পদত্যাগ করেন গোতাবায়া রাজাপক্ষে। তারপর রনিল এবং পার্লামেন্টের স্পিকার মাহিন্দা ইয়াপা আবেওয়ার্দেনার মধ্যে কোনও একজনই অন্তর্বর্তীকালীন দায়িত্ব নিতে পারেন বলে...

চূড়ান্ত অস্থির পরিস্থিতির মধ্য দিয়ে দিন কাটছে শ্রীলঙ্কার। অর্থনৈতিক সঙ্কট দেশটার নিত্যদিনের সঙ্গী। একবেলা খেয়ে ঘুমোতে যাচ্ছে দ্বীপরাষ্ট্র। স্বাধীনতার পর থেকে এমন সঙ্কট দেখেনি শ্রীলঙ্কা। এর মধ্যেই হয়ে গেল প্রেসিডেন্ট নির্বাচন। শ্রীলঙ্কা পেল নতুন প্রেসিডেন্ট। দায়িত্ব নিলেন রনিল বিক্রমসিঙ্ঘে।

প্রেসিডেন্ট নির্বাচন

শ্রীলঙ্কার নতুন প্রেসিডেন্ট হলেন রনিল বিক্রমসিঙ্ঘে। এক মাস আগে তাঁকে দ্বীপরাষ্ট্রের প্রধানমন্ত্রী করেছিলেন দেশের তৎকালীন প্রেসিডেন্ট গোতাবায়া রাজাপক্ষে। সম্প্রতি তিনি পদত্যাগ করায় রনিল অস্থায়ী প্রেসিডেন্ট হিসেবে দায়িত্ব পালন করছিলেন। এবার তাঁকেই শ্রীলঙ্কার প্রেসিডেন্ট হিসেবে নির্বাচিত করা হল। বুধবার ছিল শ্রীলঙ্কার প্রেসিডেন্ট নির্বাচন। তার আগে শ্রীলঙ্কায় প্রেসিডেন্ট নির্বাচনের নতুন নিয়ম জারি হয়। প্রেসিডেন্ট পদপ্রার্থী এবং তখনকার প্রধানমন্ত্রী রনিলের সরকারই জানিয়ে দেয়, নাগরিকদের সমর্থন নয় (পপুলার ভোট), দেশের পার্লামেন্টের সদস্যদের ভোটেই ২০ জুলাই নির্বাচিত হবেন পরবর্তী প্রেসিডেন্ট। সেই নিয়ম মেনে জয়ী হলেন রনিল। শ্রীলঙ্কার ইউনাইটেড ন্যাশনাল পার্টির সদস্য ৭৩ বছরের রনিল। ২০২০ সালে সাধারণ নির্বাচনে জিতে মাহিন্দা রাজাপক্ষে ক্ষমতা দখল করার আগে তিনিই দ্বীপরাষ্ট্রের প্রধানমন্ত্রী ছিলেন। শ্রীলঙ্কার ৫ বারের প্রধানমন্ত্রী তিনি। এবার তাঁর জয়ের ব্যাপারে একরকম নিশ্চিত ছিল শ্রীলঙ্কা। ২২৫ সদস্যের শ্রীলঙ্কা পার্লামেন্টে রাজাপক্ষের দল এসএলপিপি –র ১০০ জন সদস্যের অনেকেই প্রকাশ্যে রনিলকে সমর্থনের কথা ঘোষণা করেন। বৃহত্তম তামিল দল টিএনএ-র ১০ সদস্যের সমর্থনও সঙ্গে ছিল। এই পরিস্থিতিতে অন্য ছোট দল এবং ৪৫ জন নির্দল সদস্যের সমর্থন নির্ণায়ক হবে বলে মনে করা হয়েছিল। বুধবারের ভোটে রনিলের জয়ের পর মনে করা হচ্ছে, নির্দলের সমর্থন তাঁর পক্ষে গিয়েছে। রনিল এখন শ্রীলঙ্কাকে খাদের কিনারে থেকে সরিয়ে আনতে পারেন কিনা, সেটাই দেখার।

কে এই রনিল বিক্রমসিঙ্ঘে

১৯৪৯ সালের ২৪ মার্চ জন্ম রনিলের। প্রেসিডেন্ট হওয়ার আগে দলের মনোনীত সংসদ সদস্য ছিলেন। রাজনৈতিক পরিবারে জন্ম নেওয়া রনিল সিলন বিশ্ববিদ্যালয় থেকে আইনে ডিগ্রি নিয়েছেন। সত্তরের দশকের মাঝামাঝিতে শ্রীলঙ্কার রাজনৈতিক দল ইউএনপি-তে সক্রিয়ভাবে যোগ দেন। ১৯৭৭ সালে প্রথমবারের মতো শ্রীলঙ্কার সংসদ সদস্য নির্বাচিত হন। সেবার তিনি সবচেয়ে কম বয়সী হিসেবে যুব মন্ত্রকের দায়িত্ব পান। ১৯৮৯ সালে প্রেসিডেন্ট রানাসিংহে প্রেমাদাসা রানিলকে শিল্প, বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি মন্ত্রী হিসেবে নিয়োগ করেন। ১৯৯৩ সালে প্রেসিডেন্ট প্রেমদাসা হত্যাকাণ্ডের পর প্রধানমন্ত্রী ডিবি উইজেতুঙ্গা প্রেসিডেন্টের দায়িত্ব দেন। আর উইজেতুঙ্গার প্রধানমন্ত্রী পদে স্থলাভিষিক্ত হন রনিল। ১৯৯৪ সালে র প্রেসিডেন্ট নির্বাচনের প্রচার চলাকালে গামিনী দিশানায়েক হত্যাকাণ্ডের পরবর্তীতে ওই বছরের নভেম্বরে রনিলকে বিরোধী দলনেতা নির্বাচিত করা হয়।

আরও পড়ুন-চরম সংকটেও ক্যারম খেলা, স্নান সুইমিং পুলে! কেন এই আচরণ শ্রীলঙ্কার জনগণের?

২০১৫ সালের ৮ জানুয়ারি শ্রীলঙ্কার প্রেসিডেন্ট মাইথ্রিপালা সিরিসেনা পুনরায় তাঁকে প্রধানমন্ত্রী হিসেবে নিযুক্ত করেন। ইউনাইটেড ন্যাশনাল ফ্রন্টের সঙ্গে জোট করে সেবার জাতীয় সংসদ নির্বাচনে লড়ে ১০৬ আসনে জয়ী হলেও সংসদে সংখ্যাগরিষ্ঠতা পেতে ব্যর্থ হয়েছিলেন তিনি। ৩৫ আসন নিয়ে শ্রীলঙ্কা ফ্রিডম পার্টি তাঁর সঙ্গে সংসদে যোগ দিলে তিনি আবার প্রধানমন্ত্রী হন। কিন্তু ২০১৮ সালের ২৬ অক্টোবর তাঁকে পদ থেকে সরিয়ে দেন প্রেসিডেন্ট মাইথ্রিপালা সিরিসেনা। তাঁর জায়গায় তৎকালীন প্রেসিডেন্ট মাহিন্দা রাজাপক্ষেকে প্রধানমন্ত্রী হিসেবে নিযুক্ত করেন। মাহিন্দা প্রধানমন্ত্রী হলে রনিল মেনে না নেওয়ায় দেশে সাংবিধানিক সঙ্কট দেখা যায়। ২০১৮ সালের ১৬ ডিসেম্বর সিরিসেনা পুনরায় তাঁকে প্রধানমন্ত্রী হিসেবে নিয়োগ করলে সেই সঙ্কট দূর হয়। ২০১৯ সালে প্রেসিডেন্ট নির্বাচনের পর ২০ নভেম্বর তিনি পদত্যাগ করেন এবং মাহিন্দা রাজাপক্ষে প্রধানমন্ত্রী হন। ২০২০ সালের সংসদ নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করলেও তিনি জয়ী হতে পারেননি। পরে দলের মনোনীত এমপি হিসেবে সংসদে যান এবং ২০২১ সালের ২৩ জুনে তিনি শপথ নেন। ১৯৯৪ সালে পর থেকে তিনি ইউএনপির নেতা হিসেবে দায়িত্ব পালন করে আসছেন। দক্ষিণ এশিয়ার অন্য অনেক নেতার মতোই রাজনৈতিক পরিবার থেকে এসেছেন রনিল। সত্তরের দশকের মাঝামাঝিতে রাজনীতিতে নাম লেখান তিনি। তারপর তড়তড়িয়ে উঠেছেন সিঁড়ি বেয়ে। এর আগে পাঁচবার প্রধানমন্ত্রী হলেও কোনওবারই মেয়াদ সম্পূর্ণ করতে পারেননি রনিল। ৭৩ বছরের এই রাজনীতিকের কেরিয়ার শেষ বলে মনে করেছিলেন রাজনৈতিক বিশেষজ্ঞরা। কিন্তু নতুন করে শুরু করলেন তিনি। তবে এমন সময়ে দেশের দায়িত্ব নিলেন তখন শ্রীলঙ্কায় চরম অরাজক অবস্থা। দক্ষিণ এশিয়ার দ্বীপরাষ্ট্রকে পঙ্গু অর্থনীতি থেকে বের করতে পারবেন রানিল?

আনতে পারবেন স্থিতাবস্থা?

১৯৪৮ সালে ব্রিটেন থেকে স্বাধীনতা লাভের পর শ্রীলঙ্কা সবচেয়ে খারাপ অর্থনৈতিক পরিস্থিতির মধ্য দিয়ে যাচ্ছে। বেশ কিছুদিন ধরে ধুঁকছে এই দেশটির অর্থনীতি। সম্প্রতি নিত্যপ্রয়োজনীয় জিনিস ও জ্বালানির সঙ্কটের কারণে দেশজুড়ে অরাজক পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়েছে। খাবারের দাম আকাশছোঁয়া। অনেক সময় শ্রীলঙ্কার বাসিন্দারা একবেলা খেয়ে দিন কাটাচ্ছেন। অর্থনৈতিক সঙ্কট কাটিয়ে উঠতে এই মুহূর্তে আন্তর্জাতিক অর্থভাণ্ডারের সঙ্গে কথা চলছে কলম্বোর। সেখান থেকে অর্থসাহায্য নিয়ে আপাতত খাদ্য সহ নিত্য প্রয়োজনীয় পণ্য যাতে আমদানি করা যায় তার চেষ্টা চলছে। কিন্তু ঋণ নেওয়ার ক্ষেত্রে দেখানোর জন্য যথেষ্ট পরিমাণ বিদেশি মুদ্রা সঞ্চিত নেই কোষাগারে। তার জেরে দিন তিনেক আগে শ্রীলঙ্কাকে দেউলিয়া ঘোষণা করেন প্রাক্তন প্রধানমন্ত্রী রনিল বিক্রমাসিং। তারপরই ফের ফুঁসতে থাকে শ্রীলঙ্কা। এই পরিস্থিতিতে নতুন দায়িত্ব নিলেন রনিল।

দীর্ঘ টানাপোড়েনের পর গত ১৪ জুলাই শ্রীলঙ্কার প্রেসিডেন্ট পদ থেকে পদত্যাগ করেন গোতাবায়া রাজাপক্ষে। তারপর রনিল এবং পার্লামেন্টের স্পিকার মাহিন্দা ইয়াপা আবেওয়ার্দেনার মধ্যে কোনও একজনই অন্তর্বর্তীকালীন দায়িত্ব নিতে পারেন বলে শোনা যায়। শেষপর্যন্ত অন্তর্বর্তীকালীন প্রেসিডেন্টের দায়িত্ব গ্রহণ করেন রনিলই। তবে খানিকটা নিমরাজি হলেও বিরোধীদের তরফে সর্বাত্মক সাড়া মেলেনি। প্রেসিডেন্ট হিসেবে দায়িত্ব গ্রহণের পর তিনি কোন পথে এগোন তা এখন দেখার। বর্তমানে রনিলের সামনে দেশের স্থিতাবস্থা ফিরিয়ে আনার চ্যালেঞ্জ।

চ্য়ালেঞ্জ সামলাতে পারবেন কি রানিল? আজ শ্রীলঙ্কার দুর্দিনে তিনি যে মুকুট মাথায় পড়লেন, তা কাঁটার মুকুটে পরিণত হবে না তো! প্রবীণ এই রাজনীতিকের ওপর ভরসা রাখতে চাইছে দেশ। দেখা যাক।

More Articles