হিমাচলের বাঁকে বাঁকে এত সৌন্দর্য! পুজোর ছুটিতে স্বর্গের হাতছানি ডাক

হিমাচল প্রদেশ উত্তর ভারতের একটি ছোট রাজ্য। হিমাচল প্রদেশের উত্তর সীমায় কেন্দ্রশাসিত জন্মু ও কাশ্মীর, এবং লাদাখ রাজ্য। পশ্চিম ও দক্ষিণ পশ্চিমে পাঞ্জাব, দক্ষিণে হরিয়ানা ও উত্তরপ্রদেশ রাজ্য। দক্ষিণ পূর্বে উত্তরাখণ্ড ও পূর্বে তিব্বত রাজ্য অবস্থিত। হিমাচল প্রদেশ শব্দটির আক্ষরিক অর্থ তুষারাবৃত পর্বতসংকুল অঞ্চল। হিমাচল প্রদেশের অপর নাম দেবভূমি (দেবতাদের দেশ)। এতসব তথ্য শোনার পর বোর হয়ে গেলে আপনার লস। কারণ হিমাচলের কোলে ঘুরতে যেতে হলে এইসব আপনাকে জানতেই হবে।

বৈচিত্র্য সমারোহে ভারতের ভ্রমণ স্থানগুলো মিলিয়ে যদি একটি আলোচনার আয়োজন করা হয় তাহলে এই বিষয়ে তর্ক বিতর্কের সৃষ্টি হবেই। আসমুদ্র হিমাচল থেকে মরুভূমি কিংবা মালভূমি তার নিজস্বতার রঙে স্বমহিমায় বিরাজমান। আর তা প্রত্যক্ষ করার জন্য ব্যাগপ্যাক নিয়ে প্রায়শই আমরা যাযাবরের মতো ঘুরতে বেরিয়ে পড়ি তাঁর রহস্য উন্মোচনের জন্য। ভারতের উত্তরে অবস্থিত হিমাচল সর্বদা সুন্দর প্রাকৃতিক দৃশ্যে ভরপুর। তুষারাবৃত পর্বতের পাশাপাশি ঘন জঙ্গল, ঝরনা, জলপ্রপাত, মন্দির সবকিছুই পর্যটকদের আকর্ষণ করে। হিমাচল প্রদেশ বলতেই আমরা বুঝি শিমলা, মানালি, কসৌল ইত্যাদি। কিন্তু জানেন কি এগুলি ছাড়াও হিমাচলের অন্দরে এমন অনেক গ্রাম, জায়গা লুকিয়ে আছে যার ব্যাপারে মানুষ সেভাবে বিশদে জানেনও না। একপ্রকার অদেখাই রয়ে গেছে।

বাঙালি ভ্রমণপ্রেমী এই নিয়ে তাদের অনেক দুর্নাম শুনেছি। কিন্তু শুধু বাঙালি ভ্রমণ ভালোবাসে এমনও নয়। ভারতের মানুষ ঘুরতে যাওয়ার নাম শুনলেই এক পায়ে রাজি। শহরের কোলাহল, অফিসের চাপ, নতুন কিছু খোঁজের নেশা আমাদের সকলকে ভ্রমণের নেশায় আচ্ছন্ন করে। এই লেখায় আজ এমন কিছু অফবিট ডেষ্টিনেশানের কথা বলব যা হিমাচলের অন্দরে লুকিয়ে আছে, সকলের চোখের আড়ালে। অনেক তো হল আন্তর্জাতিক ট্যুর এবার দেশের মধ্যেই বিদেশের স্বাদ নিন।

আরও পড়ুন: ভারতের শেষ গ্রাম, এখান থেকেই নাকি স্বর্গের শুরু…

চাম্বা গ্রাম

ইতিহাস, শিল্প, প্রকৃতির পারফেক্ট কম্বিনেশান এই গ্রাম। সংস্কৃতিতে ভরপুরও বলা যায়। চাম্বা পর্বতের পিছনে চাম্বা গ্রাম। গ্রামে থাকেন খাসাস আর আদুমবারাস আদিবাসী। আদিই বটে। সেই দ্বিতীয় শতাব্দী থেকে নাকি এই আদিবাসীরা এই গ্রামে বাস করছে।

 প্রকৃতির সমস্ত সৌন্দর্য ঢেলে দিয়ে বড় আদরে তৈরি করেছে এই চাম্বাকে। ব্রিটিশ আমলে চাম্বার কালাতোপ জঙ্গল শিকারীদের প্রিয় জায়গা ছিল। এখন অবশ্য এটি অভয়ারণ্য। শিকার বন্ধ হলেও জঙ্গলের সৌন্দর্য আর অ্যাডভেঞ্চারের হাতছানি একই রকম রয়ে গেছে। ঘণ্টার পর ঘণ্টা জঙ্গলে হেঁটে বেড়ান, গল্প করুন, আর গল্প শুনুন।

কখন যাবেন– চাম্বা যাওয়ার উপযুক্ত সময় হল জুলাই থেকে অক্টোবর। এইসময় চাম্বার আবহাওয়া অত্যন্ত মনোরম থাকে।

তীর্থান ভ্যালি

রিভার র‍্যাফটিং করতে ভালোবাসেন কিন্তু প্রথমবারের অভিজ্ঞতা নিয়ে চিন্তিত তাহলে চলে যান তীর্থান ভ্যালি। আর তার সঙ্গে যদি প্রকৃতিকে নিজের মতো রূপে এবং একদম বিশুদ্ধ ভাবে চাক্ষুষ করার সৌভাগ্য হয় ব্যস ! আর কি চাই। গ্রেট হিমালায়ান পার্ক দ্বারা বেষ্টিত এই ভ্যালি প্রকৃতির কোলে অবস্থিত। রিভার র‍্যাফটিং এর জন্য এই ভ্যালি অন্যতম। শান্ত পরিবেশে কিছু বিশ্রাম এবং দুঃসাহসিক খেলার জন্য এই ভ্যালি আপনার পছন্দের লিস্টে থাকবেই। একজন মানুষ নিজেকে সেফটি হারনেসের সাথে বেঁধে নিয়ে এদিক থেকে ওদিকে ছুটে যাচ্ছে আর তাঁর পায়ের নিচ দিয়ে বয়ে যাচ্ছে তীর্থান নদী। র‍্যাফটিং করার সময় নদীর জল সারা শরীর ভিজিয়ে দিচ্ছে। কি এক্সাইটিং অভিজ্ঞতা। যারা রিভার র‍্যাফটিং জানেন আর জানেন না তাদের মনে হবে এখনই ছুটে চলে যাই সেখানে।

বসন্ত ঋতুতে এই ভ্যালি ভ্রমণ আপনার ছুটিকে আরও উত্তেজনায় ভরিয়ে দেবে। বছরের যে কোনও সময় যাওয়া গেলেও বসন্ত ঋতুতে এই উপত্যকা যেন রঙিন ফুলের সমাহারে সেজে ওঠে। আর এই অপূর্ব দৃশ্য তীর্থান ভ্যালির সৌন্দর্যকে আরও বাড়িয়ে তোলে।

কখন যাবেন– এপ্রিল থেকে জুন মাস তীর্থান ভ্যালিতে ট্রেকিং করার উপযুক্ত সময়। আর বসন্তকাল তো রইলই।

পাব্বার ভ্যালি

হিমাচলের হিপনোটাইজিং স্পটগুলির মধ্যে অন্যতম হল পাব্বার ভ্যালি। কম ঘনত্বের এই ভ্যালি শিমলা থেকে ১০০ কিমি পূর্বে অবস্থিত। বলতে গেলে এই ভ্যালি untouched। এখনও লোকজনের কোলাহল এবং ঝাঁক বেঁধে মানুষের যাতায়াত শুরু হয়নি। একজন প্রকৃতি প্রেমিকের কাছে এই ভ্যালি সেরা জায়গা করে নেবে। আপনি হাইকিং ও করতে পারেন। এরসঙ্গে এই ভ্যালির বনভূমি আপনাকে প্রকৃতির আরও কাছে এনে দেবে। এছাড়াও আপনি মাছ ধরা, ট্রেকিং, ক্যাম্পিং ইত্যাদির মতো বিভিন্ন কাজের অভিজ্ঞতা নিতে পারেন। এই নিয়ে কোনও সন্দেহ নেই যে যদি আপনি একবার এই ভ্যালিতে পৌঁছে যান তাহলে তাকে ভালবাসতে বাধ্য।

কখন যাবেন– মার্চ থেকে জুন পাব্বার ভ্যালিতে যাওয়ার উপযুক্ত সময়।

বারোট
হিমাচলের মাণ্ডি জেলায় অবস্থিত এই জায়গা এখনও পর্যটকদের মধ্যে জনপ্রিয় হয়ে ওঠেনি। দেওদার গাছ দিয়ে ঘেরা এই ঘন বন দেখার মতো জায়গা। বারোট গ্রামের পাশে অবস্থিত উহল নদী এই স্থানের সৌন্দর্য বাড়িয়ে দিয়েছে। সুতরাং, আপনি যদি তাদের মধ্যে একজন হন, যারা নির্মলতা এবং প্রকৃতিতে হাঁটা পছন্দ করেন, তাহলে বারোট যেতেই হবে।

যারা অ্যাঙ্গলিং করতে ভালবাসেন তাদের জন্যও এই স্পটটি জনপ্রিয়। নদীগুলি ট্রাউট মাছে পরিপূর্ণ, বারোটে একটি সরকারি ট্রাউট মাছের প্রজনন কেন্দ্র রয়েছে এবং অন্যান্য প্রাইভেট কেন্দ্রও আছে যেখান থেকে মাছগুলি উহলে ছেড়ে দেওয়া হয় এবং নদীর মধ্যে ৩০ কিলোমিটার মতো একটা অংশ রয়েছে যা অ্যাঙ্গলিংয়ের জন্য দুর্দান্ত৷ বারোট ভ্যালিকে অনেকে ‘ট্রেকার প্যারাডাইজ’ ও বলে থাকে।

কখন যাবেন– বর্ষাকাল বাদে বছরের যে কোনও সময় আপনি এই ভ্যালি ঘুরে আসতে পারেন।

আবার এক জনপ্রিয় কিংবদন্তি অনুসারে, একবার সহসার্জুন নামে এক শয়তান রেণুকার স্বামী জমদগিনীকে পরাজিত করে হত্যা করেছিল। রেণুকার স্বামীকে হত্যা করার পর, শয়তান তাকে অপহরণ করার চেষ্টা করলে তার হাত থেকে পালানোর জন্য, রেণুকা এই হ্রদে ঝাঁপ দিয়েছিল যেভাবে হ্রদটির নাম হয়েছে।

কখন যাবেন- রেনুকা হ্রদ যাবার উপযুক্ত সময় হল মার্চ থেকে মে।

শোজা

সিরাজ উপত্যকায় অবস্থিত শোজা একটি শ্বাসরুদ্ধকর জায়গা। শোজার সকালগুলো বিশেষভাবে উদ্দীপনাময়। যদি কেউ চান শুধু ঘুরে বেড়াতে পারেন, আবার কেউ চাইলে জঙ্গলের রাস্তা ধরে হাঁটতে পারেন। প্রকৃতি প্রেমীরা নিচ থেকে উপর দিকে বা পাশে চাইলে দেখতে পাবেন গভীর পাহাড়ি ঢাল। শোজা থেকে গাড়ি করে জালোরি পাস পর্যন্ত যাওয়া যায়। শোজার মধ্যেই একটি ছোট কিন্তু খুব সুন্দর লেক আছে। জায়গাটির পরিবেশ আপনাকে সম্মোহিত করে দেবে।

কখন যাবেন– মার্চ থেকে জুন এবং সেপ্টেম্বর থেকে নভেম্বর।

রাকচাম ভ্যালি

রাকচাম উপত্যকা হল হিমাচল প্রদেশের আর একটি অনাবিষ্কৃত রত্ন, যার চারপাশে সাদা পাহাড়ে ঘেরা। বাস্পা নদী পাশ দিয়ে বয়ে চলেছে যা রাকচামকে ভ্রমণকারীদের স্বর্গে পরিণত করেছে। শহরটি সাংলা এবং চিটকুলের মধ্যে অবস্থিত, ইন্দো-তিব্বত সীমান্ত থেকে খুব দূরে নয়। রাকচামে দু-টি হিন্দু মন্দির এবং একটি বৌদ্ধ মন্দির। এই অঞ্চলে কস্তুরী হরিণ, গোরাল, নীল ভেড়া, ব্রাউন ট্রাউট, হিমালয়ান ব্ল্যাক বিয়ার এবং চিতাবাঘ সহ বিভিন্ন হিমালয়ান বন্যপ্রাণী রয়েছে।

 কখন যাবেন– গরমের শুরুর সময় মার্চ থেকে জুন।

চূড়ধর

‘চূড়ধর’ শব্দের অনুবাদ হল ‘চাঁদের আলোয় সাজানো’, আর সত্যি জায়গাটি ঠিকই তার নামের সাথে মিলে যায়। এখানে রাত আসে চাঁদের মহিমায় পাহাড়ের সুন্দর ছবি নিয়ে। সারাইন থেকে একটি ট্রেক আপনাকে রহস্যময় দেওদার বনের মধ্য দিয়ে শ্রীগুলের প্রাচীন মন্দিরে নিয়ে যায়। এই গন্তব্যে ৪৮ কিমি দীর্ঘ ট্র্যাকের অভিজ্ঞতা চিরকাল আপনার সাথে থাকবে। চূড়ার উপরে বসে আছে ভগবান শিবের একটি বিশাল কংক্রিটের মূর্তি। বৃষ্টির পরে দিগন্তে রামধনু ফুটে ওঠার দৃশ্য স্মরণীয় হয়ে থাকার মতো। মেঘের আচ্ছাদন থেকে বেরিয়ে আসা বহু রঙের রশ্মি, পুরো আকাশকে একটি বিশাল ঝাড়বাতির মতো দেখায়।

কখন যাবেন- এপ্রিল থেকে নভেম্বর।

হিমাচল প্রদেশের অফবিট ঘোরার জায়গার নাম গুনে শেষ করা যায় না। প্রকৃতি যেন অনেক আদরে ভরিয়ে দিয়েছে তাকে। অপার সৌন্দর্যে ভরপুর এই হিমাচলে মানুষ বারবার ছুটে যায়। খুঁজে নেয় প্রকৃতির মাঝে একটু স্বর্গ। তারই কিছু হদিশ রইল এখানে। আরও অনেক অজানা অচেনা জায়গা নিজের গর্ভে লুকিয়ে রেখেছে হিমাচল প্রদেশ। তাদের হদিশ না হয় আবার তোলা রইল। তাই চিন্তা না করে বাক্স প্যাটরা নিয়ে বেরিয়ে পড়ুন। ঘুরে আসুন সেইসব জায়গা থেকে যেখানে এখনও পর্যটকদের কোলাহল শুরু হয়নি, ভিড়ে ঘিঞ্জি হয়নি উপত্যকার কোল। হিমাচল আপনাকে দু'হাতে স্বাগত জানাতে প্রস্তুত।

More Articles