শর্মিলা ঠাকুর থেকে বিদ্যা বালান, বাঙালির প্রিয় টয় ট্রেন যে কারণে আজও রহস্যময়

পাইন, দেবদারুর জঙ্গলের মাঝ দিয়ে, খরস্রোতা ঝরনাকে একপাশে রেখে কু-ঝিক-ঝিক শব্দে শীর্ণ রেলপথ ধরে সেই কোন কাল থেকে এগিয়ে চলেছে টয় ট্রেন। দার্জিলিং আর টয় ট্রেন – এই দুই নাম উচ্চারিত হলে কোনও বেরসিকেরও মনে রোমান্টিসিজম জাগতে বাধ্য। মন গুন গুন করে গেয়ে উঠতেই পারে-  "মোর স্বপ্নের সাথী তুমি কাছে এসো, আজ ঋতু ফাল্গুনে কেন দূরে থাকো...’’

দার্জিলিংয়ের আঁকাবাঁকা পাহাড়ি পথ ধরে চলা হুড খোলা জিপে রাজেশ খান্নার লিপে এই গান আজও বহু বাঙালির হৃদয়ে রোমান্স জাগায়। হবে না-ই বা কেন? টয় ট্রেনে সওয়ারি ছিলেন শর্মিলা ঠাকুর। পরিচালকের ক্যামেরায় সেই টপ শটে একসঙ্গে ধরা পড়েছে টয় ট্রেনের জানালায় বসে শর্মিলা আর চলন্ত জিপে সওয়ারি মাউথ অর্গান বাজানো সেকালের সুপার হিরো রাজেশ খান্না। বাংলা ও হিন্দিতে সুপার-ডুপার হিট হয়েছিল সেই ছবি— ‘আরাধনা’।

১৯৬৯ সালে মুক্তি পাওয়া সেই ছবির ওই বিশেষ দৃশ্যের শ্যুটিং হয়েছিল দার্জিলিং যাওয়ার পাহাড়ি পথে। তারপর আরও অনেক ছবির শুটিং হয়েছে দার্জিলিংয়ের পাহাড়ি পথে, টয় ট্রেন, বাতাসিয়া লুপ, ঘুম স্টেশন, টাইগার হিলে। 

আরও পড়ুন: এই রেলপথগুলিতে পদে পদে বিস্ময়! ভ্রমণপিপাসুদের জন্য রইল খোঁজ

করোনা সেই রোমাঞ্চেও থাবা বসিয়েছিল। তবে এখন মোহময়ী দার্জিলিংও স্বাভাবিক ছন্দে ফিরেছে। আর টয় ট্রেন আমাদের গর্বের স্মারক। দার্জিলিং হিমালয়ান রেলওয়ে-কে এই স্মৃতিমেদুর ঐতিহ্যের কারণেই ইউনেসকো ১৯৯৯ সালে বিশ্ব ঐতিহ্য হিসেবে গণ্য করেছে। 


বলিউডের সঙ্গে পাহাড়ের নিবিড় যোগ। 'জগ্গা জাসুস’, ‘বরফি’, ‘পরিণীতা’-র মতো বেশ কিছু সিনেমার বহু দৃশ্য পাহাড় ও ডুয়ার্স অঞ্চলের রেলপথকে রীতিমতো মাইলস্টোন করে রেখেছে দর্শকমনে। বহু বলিউড ছবির শুটিং হয়েছে টয় ট্রেনে। বাংলা সিনেমা মনে করলে এই তালিকা যে আরও দীর্ঘ হবে, তা বলাই বাহুল্য। 


পাহাড়ি পাকদণ্ডি বেয়ে আঁকাবাঁকা পথে ঘুরে ঘুরে টয় ট্রেনের ভ্রমণকথা লেখা রয়েছে অনেক রোমান্টিক মনের অতলে। সেই ঊনবিংশ শতাব্দীর মাঝামাঝি সময় থেকে যোগাযোগের সু-বন্দোবস্ত করার জন্য টয় ট্রেন তৈরির প্রয়োজন অনুভব করেছিল ব্রিটিশ সরকার। ১৮৮১ সালের ৪ জুলাই সেই পথের উদ্বোধন হয়। যদিও তার আগে থেকেই দার্জিলিং নামে এই পাহাড়ি জনপদের কথা ধীরে ধীরে জানতে পারছিল বাঙালি, ইংরেজদের সৌজন্যেই। সেই আমলে জলধর সেনের বই থেকে দার্জিলিং তথা হিমালয়ে সম্মন্ধে অনেক কিছুই জানা যায়। তাও টয় ট্রেন তখনও বাঙালি মননে চেপে বসেনি।


এই পাহাড়ি রাস্তায় কীভাবে এই ছোট ট্রেন যেতে পারে, তা পাশ্চাত্য ঔপনিবেশিক প্রযুক্তির এক অন্যতম উদাহরণ। ঊনবিংশ শতাব্দীর শেষ লগ্নে, ১৮৯৬ সালে, সাহিত্যিক মার্ক টোয়েন যখন দার্জিলিং গিয়েছিলেন, তখন তিনি এই ট্রেনে চড়ে বিস্ময়ে অভিভূত হয়েছিলেন। তখনই তিনি এর নামকরণ করেন টয় ট্রেন। 


কত যে বিখ্যাত বাঙালি তথা বিদেশি এই টয় ট্রেনে দার্জিলিং গিয়েছেন, তার হিসেব নেই! মহর্ষি দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুর হিমালয়ে প্রায়ই ঘুরতে যেতেন। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরও প্রায়শই সুযোগ পেলে দার্জিলিং চলে আসতেন। রবীন্দ্রনাথের বিভিন্ন লেখায় দার্জিলিংয়ের প্রসঙ্গ উঠে এসেছে বারবার। আর দার্জিলিং গেলে কবির পছন্দ ছিল এই টয় ট্রেন। কবি শেষবার পাহাড়-ভ্রমণ করেন এই টয় ট্রেনেই, পুত্র রথীন্দ্রনাথের সঙ্গে। ১৯৪০ সালের ২৭ সেপ্টেম্বর শিলিগুড়ি টাউন স্টেশনে কবিকে দেখার জন্য লোকারণ্য হয়ে গিয়েছিল! যে-কথা মৈত্রেয়ী দেবী 'মংপুতে রবীন্দ্রনাথ' গ্রন্থে বিস্তারিতভাবে লিখেছেন।


সত্যজিৎ রায়ের 'কাঞ্চনজঙ্ঘা'-য় যে ভাবে দার্জিলিংকে ধরা হয়েছে, তাতে দার্জিলিং সাধারণ বাঙালির কাছে পাশের বাড়ি হিসেবে গড়ে উঠেছিল। যদিও সত্যজিৎ টয় ট্রেনকে গুরুত্ব দেননি। সারা সিনেমায় শুধু ট্রেনের হুইসেলের আওয়াজ শুনিয়েছিলেন।


গরমের দাপট বেড়েছে। এই অবস্থায় বাঙালি লোটাকম্বল নিয়ে যে পাহাড়ে পাড়ি দেবে, তা বলাই বাহুল্য। উত্তরবঙ্গে টয় ট্রেন পরিষেবা দিয়ে থাকে দার্জিলিং হিমালয়ান রেলওয়ে। বাংলা তথা ভারতের গর্ব এই ডিএইচআর-কে ওয়ার্ল্ড হেরিটেজ সাইট ঘোষণা করেছে ইউনেসকো। দার্জিলিংয়ে যাবেন, অথচ টয় ট্রেন চড়বেন না, তা কী করে হয়? আর টয় ট্রেন বলতেই মনে পড়ে ঘুম স্টেশনের কথা। ঘুম থেকে টয় ট্রেনে চড়ে দার্জিলিং যেতে মাঝখানে পড়বে বাতাসিয়া লুপ। জায়গাটির দূরত্ব ঘুম স্টেশন থেকে প্রায় ১ কিলোমিটার, আর দার্জিলিং শহর থেকে ৫ কিলোমিটারের মতো। ইংরেজিতে ‘লুপ’ মানে বক্রাকার কিংবা বৃত্তাকার কোনও অঞ্চল। পাহাড়ের চড়াই পথে টয় ট্রেনের যাত্রাকে সাবলীল করার জন্য ১৯১৯ সালে বাতাসিয়া লুপ গড়ে তোলা হয়। টয় ট্রেন বাতাসিয়া লুপে ৩৬০ ডিগ্রি ঘুরে যায়, ফলে দার্জিলিংয়ের প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের বৃত্তাকার ভিউ পাওয়া যায়। চোখে পড়ে তুষারধবল হিমালয়। বাতালিয়া লুপ থেকে বিশ্বের তৃতীয় উচ্চতম শৃঙ্গ কাঞ্চনজঙ্ঘা দেখলে তার স্মৃতি আপনার মনের মণিকোঠায় চিরকাল থেকে যাবে। পাহাড়ের রানি দার্জিলিং শহরটিকেও এই যাত্রাপথে অনবদ্য লাগে। এখানে রয়েছে বিশাল মনোরম বাগান। বহু রকমের গাছে সাজানো। রংবেরঙের ফুল আপনাকে মুগ্ধ করবে।


করোনার দাপট কমেছে। মন আবার উড়ু উড়ু। বাঙালিকে পাহাড় যে ডাকছে, তা বললে ভুল হয় না। কাজেই কাঁধে রুকস্যাক নিয়ে মন ছুটে যাক মেঘের দেশে। বেরসিক মনেরও গেয়ে উঠতে দোষ কী-


"...মেঘের ব্যাগের ভেতর 
ম্যাপ রয়েছে মেঘপিওনের পাড়ি
পাকদণ্ডি পথ বেয়ে তার বাগানঘেরা বাড়ি...’’

More Articles