পিকের সঙ্গে বিচ্ছেদ, ২০২৪-এ জাতীয় রাজনীতিতে প্রভাব ফেলতে পারবেন মমতা?
২০২১ এর পশ্চিমবঙ্গ বিধানসভা নির্বাচনে ভারতীয় জনতা পার্টির বিজয়রথ স্তব্ধ করে দিয়েছিলেন মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। বাংলা বিষয়ের স্বপ্ন দেখা বিজেপি মাত্র ৭৭ আসনেই আটকে গিয়েছিল। মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়কে জাতীয় নির্বাচনেও নরেন্দ্র মোদির বিরুদ্ধে একটি অন্যতম মুখ হিসেবে তুলে ধরেছিল এই একটি নির্বাচন। অনেকে বিশ্বাস করেন, মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় পুরোপুরিভাবে নিজের ক্ষমতায় এবং নিজের ক্যারিশমায় বিজেপিকে পরাস্ত করেছেন। কিন্তু ভোটপর্যবেক্ষক মাত্রই জানেন মমতার এই বাংলা বিজয়ের নেপথ্যে আরো একজনের হাত ছিল। তিনি ভারতের অন্যতম তারকা ভোটকুশলী প্রশান্ত কিশোর।
২০১৯ লোকসভা নির্বাচনে বিজেপির হাতে পর্যুদস্ত হয়ে তৃণমূলের যখন ছন্নছাড়া অবস্থা, সেই সময় তৃণমূলের যুবরাজ অভিষেক বন্দ্যোপাধ্যায়ের হাত ধরে বাংলায় এসেছিলেন প্রশান্ত কিশোর। শুরু থেকেই তাঁর লক্ষ্য ছিল নির্বাচনে জয়লাভ। একেবারে তৃণমূল স্তর থেকে দলকে ঢেলে সাজানো থেকে শুরু করে নির্বাচনের প্রার্থী তালিকা প্রস্তুতি, সবকিছুতেই প্রশান্ত কিশোরের অবস্থান ছিল লক্ষণীয়। তিনি যে শুধুমাত্র একজন ভোটকুশলী ছিলেন সেরকমটা বলা হয়তো ভুল হবে। বছর দুয়েকের মধ্যেই তৃণমূল কংগ্রেসের অন্যতম মন্ত্রণাদাতা হিসেবে নিজেকে প্রতিষ্ঠা করেছিলেন প্রশান্ত।
২০১৯ থেকে যখন তিনি তৃণমূল কংগ্রেসের দায়িত্ব গ্রহণ করেন, সেই সময় দলে একাধিক জায়গায় কোন্দল। বাংলার রাজনীতিতে তখন রীতিমত চলছে বিজেপি ঝড়। আর এই বিজেপি ঝড়ের অন্যতম হোতা হিসেবে সেই সময় অবস্থান করছেন বিজেপির তৎকালীন রাজ্য সভাপতি দিলীপ ঘোষ। তৃণমূল তখন রীতিমতো ব্যাকফুটে। গোষ্ঠীকোন্দল, করোনা ভাইরাস পরিস্থিতি, পুরসভার ভোট পিছিয়ে যাওয়া সবকিছুই যেন আঁকড়ে ধরেছে তৃণমূলকে। সেই সময় মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় এবং অভিষেক বন্দ্যোপাধ্যায়কে সঙ্গে নিয়ে কাজ শুরু প্রশান্ত কিশোরের। রাজীব বন্দ্যোপাধ্যায় এবং শুভেন্দু অধিকারীর মত হেভিওয়েট নেতাদের দলবদলও টলাতে পারেনি এই দু'জনের মেলবন্ধনকে।
'বাংলা নিজের মেয়েকেই চায়', 'খেলা হবে'-র মতো একাধিক স্লোগানে বিজেপিকে ক্ষতবিক্ষত করতে শুরু করলেন প্রশান্ত কিশোর। অমিত শাহ, নরেন্দ্র মোদি, যোগী আদিত্যনাথ এর মতো নেতাদের ভাষণকেও রুখে দিয়ে বাংলার মসনদে তৃতীয়বারের জন্য বসলেন মমতা। আর এই জয়ের নেপথ্যে সেই প্রশান্ত কিশোর। খুশি হয়ে মমতা প্রশান্ত কিশোরের আই- প্যককে আগামী বিধানসভা নির্বাচন পর্যন্ত দলের দায়িত্বও দিলেন হাসিমুখেই। কিন্তু, নির্বাচন শেষ হওয়ার মাস কয়েকের মধ্যেই ছন্দপতন। মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়কে প্রশান্ত কিশোরের একটি মেসেজ যেন সমস্ত বন্ধন ছিন্ন করে দিল। 'বাংলা, মেঘালয় এবং ওড়িশায় আপনাদের সঙ্গে কাজ করব না আমি।' মমতাও কোন বিরোধিতা করলেন না, বরং হাসিমুখেই বিদায় দিলেন প্রশান্তকে।
শেষ হলে একটা অধ্যায়। তৃণমূলের অন্দরে অনেকেই বলছেন, ২০২১ বিধানসভায় প্রশান্ত কিশোরের তেমন একটা ভূমিকা ছিল না, যেটুকু হয়েছে তার সবটাই মমতার কামাল! কেউ কেউ আবার বলেন, প্রশান্ত কিশোরের স্ট্র্যাটেজিতে নাকি ধার কমেছে। মমতা নিজেও নাকি এই একই মত পোষণ করেন, ধারণা রাজনৈতিক মহলের একাংশের। গোয়ায় সম্ভবত অভিষেকের সঙ্গে আর কিছুদিন কাজ করবেন প্রশান্ত কিশোর। তারপরেই সমস্ত বন্ধন একেবারেই ছিন্ন হতে চলেছে। শোনা যাচ্ছে, প্রশান্ত কিশোরের সঙ্গে সঙ্গেই তৃণমূলে একই সাথে ব্যাকফুটে যেতে শুরু করেছেন অভিষেক বন্দ্যোপাধ্যায়।
মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় গোয়া বিধানসভা নির্বাচনের সমস্ত দায়িত্ব তুলে দিয়েছিলেন অভিষেকের উপরেই। প্রথমে কয়েকবার প্রচারে গেলেও এখন আর গোয়ামুখি হতে চাইছেন না মুখ্যমন্ত্রী! এর কারণ কি শুধুমাত্র প্রশান্ত কিশোরের তৃণমূলের অভ্যন্তরীণ বিষয়ে হস্তক্ষেপের চেষ্টা? নাকি অভিষেক বন্দ্যোপাধ্যায়ের সঙ্গে সরাসরি সংঘাতে রয়েছেন মমতা? প্রথমদিকে গোয়ায় মমতার কিছুটা হাওয়া উঠলেও, বর্তমানে পরিস্থিতি দেখে মনে হচ্ছে না গোয়ায় তৃণমূলের চিঁড়ে ভিজবে। অন্য দিকে, আবার ত্রিপুরাতেও পুরসভা নির্বাচনে হতশ্রী ফলাফল করেছে তৃণমূল। এই অবস্থায় মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের জাতীয় নেত্রী হয়ে ওঠার সম্ভাবনা কতটা? সর্বোপরি, অভিষেক বন্দ্যোপাধ্যায় এবং প্রশান্ত কিশোর জুটির ভবিষ্যতই বা কী?
সাধারণ এক ইউনিসেফ কর্মী থেকে তারকা ভোট কৌশলী - 'প্রশান্ত কিশোর'
২০০৭ সালে যখন কংগ্রেসের সাফল্য একেবারে মধ্যগগনে, সেই সময় থেকেই ভারতের রাজনীতিতে ধীরে ধীরে অংশগ্রহণ করা শুরু করলেন প্রশান্ত কিশোর। প্রথমে কংগ্রেসের সাধারণ সম্পাদক রাহুল গান্ধীর সঙ্গে দেখা করে রাহুল গান্ধীর হাতে তার 'সোশ্যাল সেক্টর ব্লুপ্রিন্ট' নামে একটি পরিকল্পনার কথা তুলে ধরেন প্রশান্ত। স্বাস্থ্য ব্যবস্থাকে সম্পূর্ণ পাল্টে ফেলার পরিকল্পনা নিয়েছিলেন প্রশান্ত কিশোর। কিন্তু, কংগ্রেস সরকার তার এই ব্লু প্রিন্টকে বিশেষ আমল দিল না। ২০১০ সালে আফ্রিকার ইউনিসেফের সোশ্যাল পলিসি এবং প্ল্যানিং এর ক্ষেত্রে প্রধান হিসেবে নির্বাচিত হলেন প্রশান্ত কিশোর। সেই সময় ভারতের পিছিয়ে পড়া রাজ্যগুলোর স্বাস্থ্য সূচকের বেহাল দশা উঠে আসে তার কাছে।
প্রধানমন্ত্রী মনমোহন সিংকে উদ্দেশ্য করে এই মর্মে একাধিক চিঠি লিখলেন প্রশান্ত। কিন্তু প্রধানমন্ত্রীর কাছে এই চিঠি বিশেষ গুরুত্ব পেল না। তবে প্রশান্তির চিঠির একটি কপি পাঠানো হল গুজরাটের তৎকালীন মুখ্যমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির কাছে। এই চিঠি পাওয়ার পর প্রশান্তের সাথে দেখা করার ইচ্ছা প্রকাশ করলেন নরেন্দ্র মোদি। সেই থেকেই প্রশান্ত কিশোরের সরাসরি ভোটকুশলী হিসেবে হাতে ঘড়ি। ২০১১ সালের অক্টোবরে প্রশান্ত কিশোর সোশ্যাল সেক্টর পলিসি অ্যাডভাইজার হিসেবে নরেন্দ্র মোদির সঙ্গে কাজ করা শুরু করেন।
২০১১ থেকেই নরেন্দ্র মোদির সরকারি বাসভবনের বাইরেও কাজ করা শুরু করেন প্রশান্ত কিশোর। তবে সেই সময় বিজেপির কোন গুরুত্বপূর্ণ পদে ছিলেন না প্রশান্ত। তবে মোদির কাছে তার গুরুত্ব ছিল অপরিসীম। ২০১২ সালের গুজরাট বিধানসভা নির্বাচনের প্রচারণা এবং ভোট কৌশল নির্ধারণের দায়িত্ব পেলেন প্রশান্ত। সেই ২০০১ থেকে গুজরাটের ক্ষমতায় ছিলেন নরেন্দ্র মোদি; তাই শিল্পায়ন এবং উন্নতি হলেও বিরোধিতা ছিল অনেক। পাশাপাশি গুজরাট দাঙ্গার কলঙ্ক তো ছিলই। কিন্তু এই সমস্ত থাকলেও তাকে পাশ কাটিয়ে পুরো গুজরাটে মোদির উন্নয়নের বার্তাকে ছড়িয়ে দিলেন ৩৫ বছরের এক তরুণ ভোট কৌশলী। আরো একবার মুখ্যমন্ত্রী হিসেবে নির্বাচিত হলেন নরেন্দ্র মোদি। তার সাথেই ভারতীয় রাজনীতিতে একটি বড় ফ্যাক্টর হয়ে উঠলেন প্রশান্ত কিশোর।
আরও পড়ুন-মাছওয়ালা, রংমিস্ত্রিদের প্রার্থী করছে বামেরা, স্বাভাবিকতার ঢক্কানিনাদে কি চিঁড়ে ভিজবে
তবে, প্রশান্ত কিশোর ভারতীয় রাজনীতিতে সবথেকে বড় ভোট কৌশলী হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হন ২০১৪ লোকসভা নির্বাচনে। ওই লোকসভা নির্বাচনকে সামনে রেখে সিটিজেনস ফর অ্যাকাউন্টেবল গভর্নেন্স (সিএজি) নামের একটি সংস্থা চালু করলেন প্রশান্ত কিশোর। অলাভজনক প্রতিষ্ঠান হলেও এতে ভারতের প্রখ্যাত আইআইটি এবং আইআইএমের পেশাদার বিশেষজ্ঞদের নিয়োগ করা হয়। শুরুতে একটি স্বাধীন নীতিনির্ধারণী প্রতিষ্ঠান হিসাবে উল্লেখ করা হলেও, নরেন্দ্র মোদির নির্বাচনী প্রচারে অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে এই সিএজি। ৫ লক্ষ স্বেচ্ছাসেবী সংগ্রহের উদ্যোগ গ্রহণ করে তারা। ভারতের ১৫টি রাজ্যে সফলভাবে তাদের কার্যক্রম পরিচালনা করে সিএজি। প্রায় ১ লক্ষেরও বেশি স্বেচ্ছাসেবী জোগাড় করতে সক্ষম হয় সিএজি।
আর সেই লোকসভা থেকেই নরেন্দ্র মোদীর উত্থানে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা গ্রহণ করেন তিনি। নির্বাচনের জন্য নতুন নতুন আইডিয়া বের করা তার মূল কাজ। ভারতের প্রথম সারির কলেজগুলোতে মন্থন নামের একটি প্রতিযোগিতার আয়োজন করেন তিনি। এছাড়াও স্ট্যাচু অফ ইউনিটি নামের একটি জাতীয়তাবাদী আন্দোলনের ডাক দেন প্রশান্ত কিশোর। রান ফর ইউনিটি থেকে শুরু করে সরদার বল্লভ ভাই প্যাটেলের মূর্তি স্থাপন নিয়ে জাতীয়তাবাদী আন্দোলন, সবদিক থেকে কংগ্রেস সরকারকে একাধিক বাণে বিদ্ধ করতে শুরু করেন প্রশান্ত কিশোর এবং নরেন্দ্র মোদি। সোশ্যাল মিডিয়ায় ব্যাপক প্রচারণা, আচ্ছে দিন, মোদি আনে ওয়ালে হে, এই সমস্ত শ্লোগানের মাধ্যমে মোদিকে একটি ব্র্যান্ড হিসেবে উপস্থাপন করা হয়। আর এই সমস্যার সৃজনশীল প্রসারের মাধ্যম এই বিপুল ব্যবধানে কংগ্রেসকে পরাজিত করে জয়লাভ করেন নরেন্দ্র মোদি।
কিন্তু বিজেপি ক্ষমতায় আসার পর থেকেই প্রশান্তির সাথে মোদির দূরত্ব বৃদ্ধি পেতে শুরু করে। অমিত শাহু থেকে শুরু করে আরো বেশ কয়েকজন বড় মাপের নেতাকে এর জন্য দায়ী মনে করা হলেও মনোমালিন্য প্রকট আকার ধারণ করলে সিএজি-কে নিয়ে বিজেপি ছাড়েন প্রশান্ত কিশোর। সিএজি কে পরিবর্তন করে গড়ে তোলেন আই-পিএসি। তারপরেই বিভিন্ন জায়গায় রাজনৈতিক দলের জন্য কাজ করা শুরু করে প্রশান্ত কিশোরের এই সংস্থা। ২০১৫ সালের বিহার নির্বাচনে নীতীশ কুমারকে মুখ্যমন্ত্রী হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করা থেকে শুরু করে ২০১৬ কংগ্রেস নির্বাচনে অমরিন্দর সিং এর জয়, এবং সর্বশেষ ২০২১ বিধানসভা নির্বাচনে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের জয়লাভ সবকিছুতেই প্রশান্ত কিশোরের হাত ছিলই। এমনকি অন্ধ্রপ্রদেশ এবং তামিলনাড়ুর নির্বাচনে যথাক্রমে ওয়াই এস জগনমোহন রেড্ডি এবং এমকে স্ট্যালিনের জয়ের পিছনেও গুরুত্বপূর্ণ হাত ছিল প্রশান্ত কিশোরের। তবে ট্র্যাক রেকর্ড ভালো থাকলেও এখনও পর্যন্ত মাত্র একটি জায়গাতেই বিফল হয়েছেন প্রশান্ত কিশোর এবং সেটা হল ২০১৭ উত্তর প্রদেশ নির্বাচনে বিজেপির কাছে কংগ্রেসের পরাজয়। তবে, এই নির্বাচনের সময় প্রশান্ত কিশোর কংগ্রেসকে পরামর্শ দিয়েছিলেন, প্রিয়াঙ্কা গান্ধীকে রাজনীতির ময়দানে নামানোর জন্য। কংগ্রেস তার সেই প্রস্তাব শোনেনি। তাই, এ নির্বাচনে পরাস্ত হওয়ার পিছনে প্রশান্ত কিশোরের থেকেও বেশি দায় কিন্তু কংগ্রেসের উপরই বর্তায়।
কংগ্রেসই কি তাহলে প্রশান্ত কিশোরের শেষ ভরসা?
ভোটকুশলী হিসেবে পরিচিতি লাভ করলেও , রাজনৈতিক দলগুলির সাথে কখনোই দীর্ঘকালীন সম্পর্ক ভাল রাখতে পারেননি প্রশান্ত কিশোর। সে বিজেপি হোক, কিংবা জেডিইউ, অথবা তৃণমূল কংগ্রেস, সবদিকেই নির্বাচনী সাফল্যের পর তার পারস্পরিক সম্পর্ক খারাপ হয়েছে। এই মুহূর্তে প্রশান্ত কিশোরের হাতে তেমন কোন বড় দল নেই। তাই ২০২৪ এর লোকসভা নির্বাচনে বিজেপি-কে পরাস্ত করার পরিকল্পনাও তাই কিছুটা বিশবাঁও জলে। ঘনিষ্ঠ মহল সূত্রে খবর, কংগ্রেসের সঙ্গে তার একাধিকবার বৈঠক হলেও সেই বৈঠকও সম্পূর্ণ বিফলে গিয়েছে।
শুধুমাত্র ওয়াইএসআর কংগ্রেস এবং ডিএমকে নিয়ে জাতীয় রাজনীতিতে বিজেপির সাথে এঁটে ওঠা সম্ভব নয়। মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় যখন প্রশান্তের সাথে ছিলেন, তখন একটা বৃহত্তর মহাজোট গঠনের স্বপ্ন দেখেছিলেন প্রশান্ত। অবশ্যই মুখ হতে মমতা অথবা রাহুল এর মধ্যে কোন একজন। কিন্তু এই মুহূর্তে, তার সাথে কংগ্রেস অথবা তৃণমূল কংগ্রেস কারোর সম্পর্কই ভালো নয়। ২০২১ বিধানসভায় মমতার জয়লাভের পর কিছুটা ব্রেক নিতে চেয়েছিলেন প্রশান্ত কিশোর। সেই সময়, কংগ্রেসের সঙ্গেও নিজের সখ্য বৃদ্ধি করেছিলেন। কংগ্রেসের হয়ে সক্রিয় রাজনীতিতে অংশগ্রহণের ডাকও পেয়েছিলেন তিনি। কিন্তু সেইসব বৈঠকও পুরোপুরিভাবে বিফলে যায়।
একটি সাংবাদিক সাক্ষাৎকারে প্রশান্ত কিশোর বলেছিলেন, ২০২৪ লোকসভায় বিজেপিকে পরাস্ত করা এতটা সহজ নয়। শুধুমাত্র, আঞ্চলিক দলের জোট তৈরি করে বিজেপির মত একটি দলকে পরাস্ত করা একেবারেই অসম্ভব, প্রয়োজন হবে একটি সর্বভারতীয় দলের। তবে, কংগ্রেসের জন্য প্রশান্ত কিশোরের দরজা সবসময় খোলা থাকলেও তিনি যে কংগ্রেস শিবিরে সহজে প্রবেশ করতে পারবেন না, সেটা তার কথা থেকেই স্পষ্ট। সবথেকে বড় কথা, প্রশান্ত কিশোর রাজনৈতিক দলের হয়ে নির্বাচনী প্রচারণার যে কাজ করে থাকেন তার জন্য বিপুল পরিমাণ অর্থ নিয়ে থাকেন। তাই তার জন্য এই সাফল্য এবং ব্যর্থতার হিসাব অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। তবে তার সাফল্যের হার বর্তমানে ব্যর্থতা থেকে অনেক বেশি।
২০২৪ লোকসভা নির্বাচনের আগে এই মুহূর্তে প্রশান্ত কিশোরের হাত ফাঁকা। তেমন কোন বড় রাজনৈতিক দলের সঙ্গে যুক্ত নেই প্রশান্ত কিশোর নিজেও। কংগ্রেস থেকে ডাক পাচ্ছেন না, মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় সম্পর্ক ছিন্ন করলেন। তাহলে কি প্রশান্ত কিশোরের রাজনৈতিক ক্যারিয়ার শেষ? নাকি আবার নতুন করে কংগ্রেসের সঙ্গেই সম্পর্ক স্থাপন করবেন তিনি। সম্ভাবনা একেবারে উড়িয়ে দেওয়া যাচ্ছেনা কোনোভাবেই। রাহুল গান্ধীর সঙ্গে ইতিপূর্বে বেশ কয়েকবার বৈঠকও করেছেন তিনি। ২০২৪ লোকসভায় বিজেপিকে পরাস্ত করে নিয়ে তিনি এখনও আশাবাদী। তবে হ্যাঁ, কংগ্রেসের সঙ্গে যদি তিনি যুক্ত না হতে পারেন, তাহলে হয়তো তার এই ইচ্ছা অধরাই থেকে যাবে।
জাতীয় রাজনীতিতে কতটা প্রাসঙ্গিক থাকবেন মমতা?
২০২১ বিধানসভা নির্বাচনে বিজেপি কে পরাস্ত করে জাতীয় রাজনীতিতে অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ মুখ হয়ে উঠেছিলেন মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। বিরোধী জোটের প্রধান মুখ হিসেবে ধরে নেওয়া হয়েছিল তাকে। কিন্তু, প্রশান্ত কিশোরের চলে যাওয়া মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের জন্য একটু হলেও দুঃসংবাদ বহন করে আনবে। অভিষেক বন্দ্যোপাধ্যায়ের হাত ধরে ২০১৯ সালে তৃণমূলে এসেছিলেন প্রশান্ত। সেখান থেকে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়কে জাতীয় রাজনীতিতে মুখ হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করা, তৃণমূল কংগ্রেসকে জাতীয় রাজনীতিতে প্রাসঙ্গিক করে তোলা, সব কিছুর পিছনে হাত ছিল প্রশান্ত কিশোরের। তাই প্রশান্ত কিশোর চলে যাওয়ায় মমতা বন্দোপাধ্যায় যে বর্তমানে অনেকটাই ব্যাকফুটে চলে গেলেন সেটা আর বলার অপেক্ষা রাখে না। জাতীয় রাজনীতিতে প্রতিষ্ঠা পেতে প্রশান্ত কিশোরকে প্রয়োজন ছিল মমতার। কিন্তু কোনভাবে কি প্রশান্ত কিশোরের স্ট্র্যাটেজি ভুল প্রমাণিত হচ্ছিল?
এমনিতেই মেঘালয় এবং উড়িষ্যা রাজ্যে তৃণমূল এখনো পর্যন্ত কোনো প্রভাব বিস্তার করতে পারেনি তেমনভাবে। গোয়া এবং ত্রিপুরার নির্বাচন সামনে। গোয়ার দায়িত্ব অভিষেক বন্দ্যোপাধ্যায়ের উপর বর্তেছিলেন মমতা। কিন্তু বর্তমানে যে পরিস্থিতি তাতে গোয়ায় তৃণমূলের জয়ের সম্ভাবনা খুবই কম। ত্রিপুরাতেও প্রথমদিকে কিছুটা জোর পেলেও, পৌরসভা নির্বাচনে হতশ্রী ফলাফলের পর তৃণমূলের ত্রিপুরা বিজয়ের স্বপ্ন বাস্তবে পরিণত হবার সম্ভাবনা অনেকটা কম। অন্যদিকে, তৃণমূলের ছত্রছায়ায় অন্যান্য রাজনৈতিক দলগুলোকে নিয়ে এসে যে মহাজোট গঠনের কথা বলেছিলেন প্রশান্ত, সেটাও এখনো তৈরি হয়নি। তৃণমূল কংগ্রেসের সর্বভারতীয় দল হয়ে ওঠার উচ্চাকাঙ্ক্ষা এখনো সফল হয়নি। অভিষেক বন্দ্যোপাধ্যায়ের উপরে দোষারোপ চলছে। তিনিও তৃণমূলে কিছুটা ব্যাকফুটে চলে গিয়েছেন।
কল্যাণ বন্দ্যোপাধ্যায় একটি সাক্ষাৎকারে একবার বলেছিলেন, যদি অভিষেক বন্দ্যোপাধ্যায় গোয়ায় তৃণমূল সরকার প্রতিষ্ঠা করতে পারে, তাহলে আমি তাঁকে নেতা হিসেবে গ্রহণ করব। তৃণমূলে কি তাহলে দুটি দল তৈরি হচ্ছে? মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ও সম্প্রতি গোয়া প্রসঙ্গে নাম না করে অভিষেককে 'কেউ একজন' বলে সম্বোধন করছেন। অনেকদিন হয়ে গেল, গোয়ায় প্রচারে পর্যন্ত যাচ্ছেন না মুখ্যমন্ত্রী। পিকে ও এখন তৃণমূল থেকে সরছেন। তৃণমূলে অভিষেকের গুরুত্বও কি ধীরে ধীরে কমছে? সৌগত রায়ের মত বর্ষিয়ান নেতারা এখন অভিষেকের পাশে রয়েছেন।
অন্য দিকে, প্রভাব তেমন কিছু না থাকলেও উত্তরপ্রদেশে সমাজবাদী পার্টির সমর্থনে এগিয়ে এসেছেন মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। প্রথমে নির্বাচনে লড়াইয়ের সম্ভাবনা থাকলেও, পরবর্তীতে তিনি মত পরিবর্তন করেন। কিন্তু সেন্ট্রাল স্টেজে অর্থাৎ জাতীয় রাজনীতিতে প্রধান অবয়ব হয়ে ওঠার জন্য উত্তরপ্রদেশে প্রাসঙ্গিক হয়ে ওঠা অত্যন্ত প্রয়োজন। দক্ষিণ ভারত থেকে এইচডি দেবেগৌড়া, নরসিমহা রাও এবং পশ্চিম ভারত অর্থাৎ গুজরাট থেকে নরেন্দ্র মোদী প্রধানমন্ত্রী হলেও পরবর্তীতে মোদি বারানসি থেকে লড়াই করেন। এর আগেও উত্তরপ্রদেশ থেকেই ভারতের সবথেকে বেশি সংখ্যক প্রধানমন্ত্রী এসেছেন। ভারতীয় রাজনীতিতে উত্তরপ্রদেশের কতটা গুরুত্ব, সেটা নতুন করে প্রমাণ করার প্রয়োজন নেই। কিন্তু, উত্তরপ্রদেশ একেবারে ছন্নছাড়া অবস্থায়। কংগ্রেসের কার্যত কোনো প্রভাব নেই, সমাজবাদী পার্টির অবস্থাও খুব একটা ভালো নয়, একমাত্র গতি বিজেপি। মমতা যদিও বলছেন, কংগ্রেসের জায়গাটা তৃণমূল কংগ্রেস পূরণ করবে, তবে তৃণমূলের উত্তরপ্রদেশে কার্যত কোনো মুখই নেই।
কিন্তু মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের বুদ্ধিমত্তায় ভাঁটা পড়েছে সেরকমটা ভাবারও কোনো কারণ নেই। উত্তরপ্রদেশে এযাবৎকালে তৃণমূল কংগ্রেসের কোন এমএলএ না থাকলেও ২০২৪ এ একটা রাজনৈতিক হাওয়া তৈরির একটা পরিকল্পনা তিনি শুরু করে ফেলেছেন। আর এর জন্য তিনি গ্রহণ করতে পারেন '৮৯ এর লোকসভায় বিশ্বনাথ প্রতাপ সিং এর রণকৌশলকে। সারাদেশে একটা 'সেন্ট্রিষ্ট' প্রভাব তৈরি করে ভারতের রাজনীতির মোড় ঘুরিয়ে দিয়েছিলেন বিশ্বনাথপ্রতাপ সিং। রাজনৈতিক বেত্তারা বলছেন, খানিকটা সেরকমই পরিকল্পনা নিতে চাইছেন মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। তবে বিশ্বনাথপ্রতাপ সিংকে সেই সময় বামপন্থীরা এবং বিজেপি সাহায্য করেছিল। এখানে কিন্তু মমতা সেরকম সাহায্য পাবেন না। ২০২২ কিংবা ২০২৩ মমতার প্রধান লক্ষ্য নয়। তার প্রধান লক্ষটাই ২০২৪। কথায় বলে, কখনো কখনো জাহাজে উঠতে চাইলে নৌকা নিয়ে মাঝদরিয়া অবধি যেতে হয়। মমতার অখিলেশ যাদবকে সমর্থন সেই নৌকার উদাহরণই নয় তো? যাতে চড়ে ২০২৪-এর জাহাজ অবধি যাওয়ার পরিকল্পনা নিয়েছেন মমতা?