রাজা থেকে ফকির, সব ভারতীয়র প্রাণের ফল, আমের ইতিহাস অবাক করবে

পশ্চিমের দেশগুলি আম খেতে শিখেছে সবে চার শতক হল। রইল ভারতে আমের এই দীর্ঘ ইতিহাস সম্বন্ধে আলোচনা।

গরমের দাবদাহে আম খেয়ে প্রাণ জুড়ায় বাঙালি। শুধু বাঙালি কেন, গোটা ভারতেও আম ভালোবাসে না এমন মানুষ খুঁজে পাওয়া শক্ত। আজকাল বিদেশেও আম পছন্দ করছেন লোকজন। কিন্তু অস্বীকার করার উপায় নেই পৃথিবীকে আম খেতে শিখিয়েছিল ভারতই। এ উপমহাদেশে আমচাষের ইতিহাস প্রায় হাজার চারেক বছরের পুরনো। সেখানে পশ্চিমের দেশগুলি আম খেতে শিখেছে সবে চার শতক হল। আসুন আজ ভারতে আমের এই দীর্ঘ ইতিহাস সম্বন্ধে আলোচনা করি।


আমচাষ যে সময়েই শুরু হোক না কেন, তার বহু বহু আগে থেকেই ভারতের লোকজন আমের সঙ্গে পরিচিত ছিলেন। বঙ্গ, বার্মা অর্থাৎ মায়ানমার এবং ভারতের উত্তরাঞ্চলে আড়াই-তিন কোটি বছর পুরনো ফসিল পাওয়া গিয়েছে আমের। মনে করা হয় এ অঞ্চল থেকেই দক্ষিণের দিকে এসেছিল এই ফল। বেদেও ‘রসালো’ এবং ‘সহকর’ হিসেবে ‘আম্রফলে’র উল্লেখ পাওয়া যায়। বৃহদারণ্যক উপনিষদ বা পুরাণেও আমগাছ কাটতে নিষেধ করা হয়েছে বিশেষভাবে। দক্ষিণ ভারতে আমের তামিল নাম এককালে ছিল আম-কায়। এই আমকায় পরবর্তীতে উচ্চারণের দোষে পরিণত হয় ‘মামকায়’-এ। মালায়লি লোকজন একে আরেকধাপ পরিবর্তিত করে ডাকতেন ‘মাঙ্গ’ নামে। পর্তুগিজরা কেরালায় এসে এক অদ্ভুত ফলের সন্ধান পেল। কী তার রূপ আর কী তার স্বাদ! আহা আমে মজে গিয়েছিল তারা। এই পর্তুগিজরাই বিশ্বের সঙ্গে ভারতীয় ফলটির পরিচয় করায়। ‘মাঙ্গ’-কে তারা উচ্চারণ করত ‘ম্যাঙ্গো’। এখান থেকেই ইংরেজি শব্দকোষে ঢুকে পড়ে শব্দটি।

 

‌প্রাচীন ভারতে রাজারাজড়ারা নানা জাতের আমকে চিহ্নিত করতেন বিশিষ্ট ব্যক্তিত্বদের নাম দিয়ে। বিখ্যাত বারাঙ্গনা বৈশালীর নামে যেমন আমের নাম হয়েছে বৈশালী। সে সময় আমগাছকেও মন্মথ বা কামদেবেরই এক রূপ হিসেবে দেখা হত। আমগাছে মুকুল এলে তাকে কামের শর মনে করতেন নন্দ রাজারা। এই নন্দ রাজাদের আমলেই আলেকজান্ডার ভারত আক্রমণ করেন, এবং পুরুর সঙ্গে যুদ্ধ হয় তাঁর। ফিরতি পথে নানান জাতের আম প্রচুর পরিমাণে নিয়ে গিয়েছিলেন আলেকজান্ডার।

 

বৌদ্ধধর্মের উত্থানের সঙ্গে সঙ্গে বুদ্ধদেব ও আম গাছ নিয়ে নানা কাহিনি ছড়িয়ে পড়ল অনুগামীদের মধ্যে। এই ধর্মে আমকে তাই ভক্তি ও সম্মৃদ্ধির প্রতীক মনে করা হত। বৌদ্ধ শাসকদের কাছে এই আমগাছ বিনিময় ছিল সৌহার্দ্য জ্ঞাপন। কূটনৈতিক ভাবে এই উপহারের মূল্য অসীম। এ সময় বৌদ্ধ ভিক্ষুরাও যেখানে যেতেন, সঙ্গে আম নিয়ে যেতেন। আমকে জনপ্রিয় করে তোলার পিছনে তাই বৌদ্ধধর্মের অবদান কম নয়।

 

মেগাস্থিনিসের বিবরণ, বা হিউ-এন-সাং-এর লেখায় দেখা যায়, সে সময়ে ভারতীয় রাজারা, মূলত মৌর্যরা, রাজপথের দুপাশে সারি সারি আমগাছ লাগাতে। তাতে পথ দেখতেও সুন্দর হত, সম্মৃদ্ধির প্রতীক হিসেবেও দেখা হত এই আমগাছগুলিকে। এঁদের রচনায় আমের স্বাদ নিয়ে প্রশংসাও রয়েছে প্রচুর। এই লেখাই সর্ব প্রথম ভারতের বাইরেও আমের কথা প্রচার করে।

 

আলাউদ্দিন খিলজিকেই প্রথম আমের পৃষ্ঠপোষক বলা যায়। এতটাই পছন্দ করতেন আম, যে সিওয়ামা দুর্গে শুধুমাত্র নানা ধরনের আম ও আম থেকে তৈরি খাবার দিয়েই ভূরিভোজ করেছিলেন। মুঘল সম্রাটদের আমপ্রেম তো সবারই জানা। আম নিয়ে এই পাগলামি বংশ পরম্পরায় চারিয়ে গিয়েছে মুঘলদের এক প্রজন্ম থেকে আরেক প্রজন্মে। বলা হয় বাবর নাকি মেবারের রাজা রানা সাঙ্গার সঙ্গে যুদ্ধ করার ইচ্ছে ছিল না তেমন। দৌলত খান লোদি প্রচুর উপঢৌকনের আশ্বাস দিয়েও তাঁকে রাজি করাতে পারেননি। শেষে বাবরকে আম খাওয়ালেন লোদি। সেই আমের নেশায় এমন পড়লেন বাবর যে শুধু যে রানাকে যুদ্ধে হারালেন তাই নয়, ভারতে মুঘল সাম্রাজ্যের ভিত্তি প্রতিষ্ঠা হল।


আরও পড়ুন-মান্না দে আসতেন সরবৎ খেতে, এখনও সমান জনপ্রিয় কপিলা আশ্রম


ভারত থেকে কাবুলে হুমায়ুন যখন পালিয়ে আসছেন, তিনি নাকি প্রচুর পরিমাণে আম বয়ে নিয়ে যাওয়ার ব্যবস্থা করিয়েছিলেন। আকবর তো দ্বারভাঙ্গার কাছে লাখিবাগ নামে বিরাট আমের বাগান করান। তাতে লক্ষ লক্ষ আম চাষ হত। তোতাপুরি, রাতাউল, কেশরের মতো নামিদামি আম ফলানো হত এই বাগানে। শাজাহান আম এতটাই ভালোবাসতেন, যে তাঁকে গৃহবন্দী করে ঔরঙ্গজেব প্রধান শাস্তি হিসেবে তাঁর আম খাওয়া বন্ধ করে দেন। সমস্ত আমের বাগান এবং প্রাসাদ ঔরঙ্গজেব দখল করে নিয়েছিলেন। পারস্যের শাহ আব্বাসের সাহায্য পেতেও ঔরঙ্গজেব ভেট হিসেবে পাঠান আমই।


মুঘলরা নিজেদের এই আমের নেশার চর্চাও করেছেন বহুভাবে। জাহাঙ্গীর এবং শাজাহান–দুজনেই আম পানা, আম কা লউজ এবং আম কা মিঠা পুলাও আবিষ্কারের জন্য খাসমহলকে পুরস্কৃত করেছেন। নূর জাহান আম ও গোলাপ থেকে তাঁর বিখ্যাত সব ওয়াইন তৈরি করতেন। শের শাহ সুরি যখন হুমায়ুনকে হারান, সেই জয় উদযাপনের জন্য চৌসা আম প্রথম আনা হয় রাজবাড়িতে। রোহিল্লা কাপ্তানেরা প্রথম আবিষ্কার করেন দশেরি আমের। মারাঠার রঘুনাথ পেশোয়া মারাঠা শক্তির প্রতীক হিসেবে প্রায় এক কোটি আমগাছ লাগিয়ে ছিলেন। শোনা যায়, সেই সব গাছের থেকেই নাকি ধীরে ধীরে আলফোন্সো আমের জন্ম হয়েছে। আমের এই রাজকীয় পৃষ্ঠপোষকতা ইংরেজরা একরকম ধ্বংস করে দেয়। তাদের কাছে আম সামান্য ফল ছাড়া আর কিছুই ছিল না। এবং ভারতের ফল নিয়ে আদিখ্যেতা ইংল্যান্ডের ক্ষমতা বজায় রাখার জন্যই ইংরেজদের পক্ষে সম্ভব ছিল না। ধীরে ধীরে প্রচুর ভালো ভালো প্রজাতির আম হারিয়ে যেতে থাকে। সে হিসেবে নতুন জাতের আম আবিষ্কার হয় নিতান্তই হাতে গোনা।

 

কালের বিচিত্র খেয়ালে রাজদরবারের ফল হয়ে ওঠে গৃহস্থ। যদ্দুর জানা যায়, রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর আম খেতে খুবই ভালোবাসতেন। আমের মুকুলের সুরভী তাঁর বহু রচনায় এসেছে ঘুরে ফিরে। মির্জা আসাদুল্লাহ খাঁ গালিব, যিনি গালিব নামেই বেশি পরিচিত, আম নিয়ে পাগলামি ছিল তাঁরও। যাঁরা আম ভালোবাসে না তাদেরকে মানুষ বলেই গণ্য করতেন না গালিব। আমের আকৃতি দীর্ঘদিন ধরে ব্যবহৃত হয়েছে ভারতের কুটিরশিল্পে, বস্ত্রশিল্পে। এখনো ভারতে আমকে সুখ সম্মৃদ্ধির চিহ্ন হিসাবে মানে লোকে। দরজার সামনে আমপাতা রাখা হয় সৌভাগ্যের জন্য। সব মিলিয়ে কি ভারতীয় কি বাঙালি আমের প্রেমে আজও মজে রয়েছে একই রকম। আম ছাড়া গ্রীষ্ম তাদের চলে না।

More Articles