রুশ–ইউক্রেন যুদ্ধে নির্ণায়ক শক্তি, কী ভবিষ্যৎ বিটকয়েনের?

নভেম্বর, ২০২১। নিউ ইয়র্কের মেয়র নির্বাচিত হলেন এরিক অ্যাডামস। মেয়র হয়েই প্রথম ঘোষণা, তিনি তার প্রথম তিন মাসের বেতন নেবেন বিটকয়েনে। তাঁর সঙ্গে যোগ দিলেন মায়ামির মেয়র ফ্রান্সিস সুয়ারেজ, তিনিও এরিক অ্যাডামসের সূত্র ধরে জানালেন যে, পরের মাসের বেতন বিটকয়েনে নেবেন। বিকেন্দ্রীভূত অর্থব্যবস্থার বাঁকবদল এগিয়ে গেল আরও এক ধাপ। ক্রিপ্টোকারেন্সি বা ক্রিপ্টোকয়েনকে বেতন হিসেবে কি গ্রহণ করা হবে? উঠে গেল প্রশ্ন।

বিটকয়েন ইতিমধ্যেই ডিজিটাল আর্থিক লেনদেন মাধ্যমে ইতিহাস গড়ে ফেলেছে। সাতোশি নাকামোতোর তৈরি এই বৈপ্লবিক মুদ্রা অনেক মানুষের কাছে অর্থ উপার্জনের রাস্তা খুলে দিয়েছে, যা কোনও ব্যাংক বা আর্থিক প্রতিষ্ঠান বা ব্যক্তিবিশেষের ওপর নির্ভরশীল নয়। ব্লকচেন প্রযুক্তির মাধ্যমে তৈরি এই অর্থব্যবস্থা লেনদেনের জন্য এক বিরাট নেটওয়ার্ক তৈরি করেছে, এবং সেই কারণেই অনেকে বিটকয়েনের মাধ্যমে বেতন বা তাদের প্রাপ্য অর্থ গ্রহণ করতে চাইছেন। তবে সেটা কতটা বাস্তবসম্মত এবং ঝুঁকিবিহীন, তা যথেষ্ট আলোচনাসাপেক্ষ।

বিটকয়েন বাজারে আত্মপ্রকাশ করে ২০০৯ সালে, সাতোশি নাকামোতো ছদ্মনামে এক ব্যক্তির হাত ধরে। তবে তিনি আসলে কে– তা আজ পর্যন্ত জানা সম্ভব হয়ে ওঠেনি। কিন্তু তা বিটকয়েনের রাস্তায় বাধা তো হয়ইনি, বরং তার জন্য রাস্তা আরও প্রশস্ত করে দিয়েছে। ২০১৭ সালে বিটকয়েন খ্যাতির আলোয় আসে। হ্যাঁ, এটা ঠিকই যে, বিটকয়েন একদিনের জন্যও আর্থিক লেনদেন এবং বিনিময় প্রথায় ব্যাঙ্কিং প্রচলিত মুদ্রাকে পিছনে ফেলতে পারেনি, তবে অনেক সংস্থা, বিক্রেতা বিটকয়েনকে মান্যতা দিয়েছেন এবং বিটকয়েন গ্রহণ করছেন। লেখার শুরুতেই উল্লেখ করা হয়েছে, আমেরিকার দুই শহরের মেয়রের কথা। তাদের দেখানো পথে এগিয়েছেন আরও অনেক বিখ্যাত মানুষ।

বিটকয়েনের দাম এই মুহূর্তে ৪৫.৩৮১ ডলার। গত চব্বিশ ঘণ্টায় এর দাম পড়েছে দুই শতাংশেরও বেশি। বাজারে মোট একুশ মিলিয়ন বিটকয়েন ছাড়া হবে, যার মধ্যে উনিশ মিলিয়ন ইতিমধ্যেই ছাড়া হয়ে গেছে। বিটকয়েন এখনও পর্যন্ত সবচেয়ে দামি ক্রিপ্টোকয়েন, যার মোট বাজারমূল্য এক ট্রিলিয়ন ডলার ছাড়িয়ে গেছে, এবং বিশেষজ্ঞরা এর ভবিষ্যৎ নিয়ে খুবই আশাবাদী। তবে বিটকয়েন কি সত্যিই সেই জায়গায় পৌঁছেছে যে, তাকে বেতন দেওয়ার মাধ্যম হিসেবে মান্যতা দেওয়া যেতে পারে?

আরও পড়ুন: যুদ্ধের মাশুল! যে কোনও মুহূর্তে ভারতে সংবাদপত্র ছাপা বন্ধের আশঙ্কা

বিটকয়েনের বিরুদ্ধে সবচেয়ে বড় সমালোচনা হল, যে-প্রক্রিয়ায় এই ডিজিটাল কয়েনের নির্মাণ হয়, মাইনিং (Mining)– তাতে প্রচুর পরিমাণ বিদ্যুতের প্রয়োজন হয়, যা একেবারেই পরিবেশের জন্য ভাল নয়। এছাড়াও অভিযোগ, বিটকয়েনে লেনদেনের টোপ দেখিয়ে অনেক হ্যাকার সাধারণ মানুষের সাথে প্রতারণা করেছেন। বেআইনি কাজেও হ্যাকারদের হাতিয়ার এই বিটকয়েন। কিছু বিশেষজ্ঞ এটাও মনে করেন যে, বিটকয়েনের এই দৌড় খুব বেশি দিনের নয়। এর পতন অনিবার্য। যে-হারে এর দাম ওঠা–নামা করে, তাতে অনেকে ক্রিপ্টোকারেন্সির বাজারকে জুয়া খেলার সঙ্গেও তুলনা করে থাকেন।

তবে বিগত কয়েক মাসে সমালোচকদের আশঙ্কা খুব একটা গুরুত্ব পায়নি কিছু আঞ্চলিক এবং জাতীয় সরকারের কাছে। এল স্যাল্ভেদরের সরকার যেমন বিটকয়েনকে আইনি মান্যতা দিয়েছে। এছাড়াও রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ শুরুর পর দেখা গেছে দুই দেশকেই ক্রিপ্টোকারেন্সির দিকে ঝুঁকতে। আর্থিক নিষেধাজ্ঞায় জর্জরিত রাশিয়া বিটকয়েন এবং অন্যান্য কয়েনের মাধ্যমে আন্তর্জাতিক নিষেধাজ্ঞাকে ফাঁকি দেওয়ার চেষ্টা করেছে, অন্যদিকে ইউক্রেন বিটকয়েন এবং ইথেরিয়ামের মতো কয়েনের মাধ্যমে অনুদান নিয়েছে বিশ্বের বিভিন্ন প্রান্তের মানুষের থেকে। এই দুই দেশই বিটকয়েনকে মান্যতা দেওয়ার পথে অনেক এগিয়ে গেছে। জানা যাচ্ছে, এই তালিকায় আছে দুবাইও।

তবে ভারত সরকার এখনও খুব একটা সদয় নয় ক্রিপ্টোকারেন্সির প্রতি। তারা তিরিশ শতাংশ কর বসিয়েছে ক্রিপ্টো লেনদেনে লাভের ওপর। সেই সঙ্গে যে-কোনও প্রকার লেনদেনে এক শতাংশ টিডিএস। সরকার ঘোষণা করেছে ভারতের রিজার্ভ ব্যাঙ্কের নিজস্ব কয়েন আনার কথা।

বিশেষজ্ঞরা মনে করছেন, এই হারে কর বসানোয় অনেকেই আগ্রহ হারাতে পারেন, অনেক বিনিয়োগকারী দেশের বাইরে চলে যেতে পারেন নিজেদের বিনিয়োগ করা অঙ্কের ওপর বেশি লাভ তুলতে।

তবে এটাও মাথায় রাখতে হবে যে, এখনও অনেক বৃহৎ অর্থনৈতিক শক্তি ক্রিপ্টোকারেন্সিকে আইনি মান্যতা দেয়নি। সেই সঙ্গে বিশ্বের বাজারে এখনও বিটকয়েন বহুল-প্রচলিত হয়ে ওঠেনি। এই ব্যবস্থায় বদল আসতে সময় লাগবে। এই মাধ্যমের ভবিষ্যৎ যে উজ্জ্বল, এই নিয়ে সন্দেহের অবকাশ বেশিরভাগ অর্থনীতিবিদের কাছেই নেই। সেই তালিকায় আছেন ওয়ারেন বাফেটের মতো মানুষও, যিনি শুরুতে ক্রিপ্টোকারেন্সির অনেক সমালোচনা করলেও পরবর্তীকালে নিজের মত পাল্টেছেন। দুই মাস আগেই তাঁর সংস্থা ‘বার্কশায়ার হ্যাথাওয়ে’ ক্রিপ্টোতে এক বিলিয়ন ডলার বিনিয়োগ করেছে।

দুই দশক আগে যখন ইন্টারনেট আত্মপ্রকাশ করে, তখন অনেকে নাক সিঁটকেছিলেন। কেউ গুরুত্ব দিতে চাননি, এবং বলা হয়েছিল– এটি ক্ষণিকের অতিথি। আজ দেখুন, ইন্টারনেট ছাড়া আপনি নিজের জীবনটা ভাবতে পারেন না। একইভাবে আস্তে আস্তে মানুষ বুঝছেন যে, আর্থিক বৃদ্ধির জন্য শুধু ব্যাংকের ওপর নির্ভর করা নির্বুদ্ধিতা। সেই সঙ্গে যে আদর্শে ক্রিপ্টোকারেন্সি তৈরি হয়েছে– তা অনন্য, তা একজন সাধারণ মানুষের হাতে ক্ষমতা প্রদান করেছে। আবিশ্ব ক্রিপ্টোকারেন্সির রাষ্ট্রীয় মান্যতা পাওয়া কি তাহলে শুধুই সময়ের অপেক্ষা?


More Articles