যুদ্ধের মাশুল! যে কোনও মুহূর্তে ভারতে সংবাদপত্র ছাপা বন্ধের আশঙ্কা
যে-কোনও সংবাদপত্রের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ বিষয়, নিউজপ্রিন্ট বা সংবাদ ছাপার কাগজ। সম্প্রতি এই নিউজপ্রিন্টেরই ব্যাপক সংকটে ভুগছে ভারতের সংবাদপত্রগুলি। অতিমারীর কারণে বিগত দু’বছরে এই সংকটের সূত্রপাত হয়েছিল, রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের কারণে এই সংকট তীব্র আকার ধারণ করেছে। ভারতের ‘ন্যাশনাল ইউনিয়ন অফ জার্নালিস্ট’, ‘প্রেস কাউন্সিল’ এবং “এডিটর’স অ্যাসোসিয়েশন” আশঙ্কা প্রকাশ করে বলছে– এই সংকট আর কিছুদিন চললে দেশব্যাপী বন্ধ হয়ে যেতে পারে একাধিক সংবাদপত্র।
বিশ্বব্যাপী নিউজপ্রিন্ট সংকটের মধ্যে প্রকৃতপক্ষে আগুনে ঘি ঢালার কাজ করেছে রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ। নিউজপ্রিন্ট আমদানিকারক দেশ হিসেবে এর বৃহৎ প্রভাব পড়েছে ভারতেও। ১৫২টি ভাষায় এক লক্ষের বেশি সংবাদপত্র প্রকাশিত হয় ভারতে। সাম্প্রতিক সংকটে এই সব সংবাদপত্রই পড়েছে বিপাকে। ভারতের মোট নিউজপ্রিন্ট আমদানির ৪৫ শতাংশের বেশি নির্ভরশীল রাশিয়ার ওপর। যুদ্ধ শুরুর পর থেকে রাশিয়ার রপ্তানিকারীরা বিভিন্ন বন্দরে তাদের নিউজপ্রিন্ট পৌঁছে দেওয়ার কাজ চালিয়ে গেলেও, গত একমাসজুড়ে একদিকে নিরাপত্তার অভাব, অন্যদিকে মার্কিন ও ইউরোপীয় মুলুকে নিষিদ্ধ হওয়ার ভয়ে রাশিয়ার সমুদ্র-বন্দরে জাহাজ ভেড়াতে রাজি হয়নি অধিকাংশ বিদেশি কার্গো জাহাজ। পাশাপাশি সুইফ্ট জটিলতায় নিউজপ্রিন্টের মূল্য পরিশোধ ব্যাহত হওয়ায় ভারতীয় কার্গো জাহাজগুলিতে রাশিয়ার নিউজপ্রিন্ট লোডিংও আটকে রয়েছে। ভারতের নিউজপ্রিন্ট রপ্তানিকারক অন্য দুই দেশ কানাডা এবং ফিনল্যান্ড। সাধারণ নিউজপ্রিন্ট ছাড়াও শুধুমাত্র গ্লসি নিউজপ্রিন্টের প্রায় ৬০ শতাংশ ভারতে আমদানি করা হয় ফিনল্যান্ডের নিউজপ্রিন্ট কোম্পানি ইউপিএম (UPM)থেকে। কানাডা থেকেও ভারতে আমদানি করা হয় সাধারণ নিউজপ্রিন্টের প্রায় ৪০ শতাংশ। যুদ্ধের বেশ আগে থেকেই, জানুয়ারি মাস থেকে ফিনল্যান্ডের ‘ইউপিএম’-এ শ্রমিক ধর্মঘট এবং প্রায় একই সময় কানাডায় ট্রাক চালকদের দীর্ঘ ধর্মঘটের জেরে ভারতে নিউজপ্রিন্ট আমদানির সাপ্লাই চেনে বড়সড় প্রভাব পড়ে। এর মধ্যে যুদ্ধের দরুন ব্যাপক মূল্যবৃদ্ধিতে এই দুই দেশের সাপ্লাই চেন থমকে গিয়েছে অনেকটাই।
যদিও নিউজপ্রিন্ট সংকটের শুরুটা হয়েছে কোভিড অতিমারীর হাত ধরেই। অতিমারীর সময়ে অন্য সব শিল্প এবং সব সেক্টরের মতোই প্রভাবিত হয়েছে বিশ্বের ছোট-বড় সংবাদপত্রগুলি। দীর্ঘ লকডাউনের কারণে নিউজপ্রিন্টের অন্যতম কাঁচামাল নষ্ট হয়েছিল, সম্পূর্ণভাবে ব্যাহত হয়েছিল পুরনো কাগজ পুনর্ব্যবহারের জন্য সংগ্রহ। অন্যদিকে বিগত দু’বছরেও স্বাভাবিক হয়নি ‘গ্লোবাল লজিস্টিক সাপ্লাই’, কারণ হিসেবে বলা হচ্ছে, অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড স্বাভাবিক কার্গো কন্টেনার ব্যাপক সংকটের মুখে। ফলত, সমুদ্র মারফত কার্গো শিপিংয়ের খরচ বেড়েছে প্রায় তিনগুণ।
আরও পড়ুন: আন্তর্জাতিক বাজারে দর পড়ছে, তবু কেন লাগামছাড়া পেট্রল?
সংবাদপত্রের ছাপার রঙের দামও ঊর্ধ্বমুখী। তবে কাঁচামাল-সংকটে নিউজপ্রিন্টের মূল্যবৃদ্ধি ঘটেছে রকেট-গতিতে। ২০১৯ সালে ভারতে প্রতি টন নিউজপ্রিন্ট আমদানি করার খরচ পড়ত ৪৫০ ডলার। যেখানে ২০২২ সালে নিউজপ্রিন্টের প্রতি টনের দাম দাঁড়িয়েছে ৯৫০ ডলার।
এই পরিস্থিতিতে ভারতের দেশীয় নিউজপ্রিন্ট উৎপাদনকারী সংস্থাগুলির মাধ্যমে সংকট সামাল দেওয়ার পরিস্থিতি নেই ভারতে। ভারতে নিউজপ্রিন্ট তৈরির খরচ রাশিয়া, ফিনল্যান্ড বা কানাডার তুলনায় অনেক বেশি। স্বাভাবিক নিয়মে দেশে নিউজপ্রিন্ট ব্যবহারকারী সংস্থাগুলি হয়ে উঠেছে আমদানিনির্ভর। ফলে তিন দশক আগে থেকেই ভারতে একে একে ঝাঁপ পড়তে শুরু করেছে ব্রিটিশ আমল থেকে চলে আসা অধিকাংশ বৃহৎ দেশীয় নিউজপ্রিন্ট উৎপাদনকারী সংস্থাগুলিতে। অস্তিত্বরক্ষায় অনেক সংস্থা নিউজপ্রিন্ট উৎপাদন বন্ধ করে মনোযোগী হয়েছে প্রিন্টিং এবং প্যাকেজিং সেক্টরে। কম দামে আমদানিনির্ভর ভারতীয় বাজারে অসম প্রতিযোগিতার কারণে দেশে নতুন করে তৈরি হয়নি বৃহৎ কোনও নিউজপ্রিন্ট শিল্পও।
কলকাতার প্রথম সারির একটি দৈনিক পত্রিকার প্রকাশক একটি সংবাদমাধ্যমকে দেওয়া সাক্ষাৎকারে বলছেন, ‘নিউজপ্রিন্ট সংকটে পত্রিকা চালানো দুষ্কর হয়ে উঠেছে। হাতে স্টক থাকলেও যুদ্ধ কতদিন চলবে জানি না, তাই তিনগুণ দামে নিউজপ্রিন্ট অর্ডার করতে হয়েছে। ২৪ পাতা বা ২২ পাতার কাগজ ১৬ পাতায় নামিয়ে আনতে হয়েছে, কখনও কখনও ১২ পাতা করতে হচ্ছে। পাতার সংকটে খবরের কনটেন্টের সঙ্গে আপস করতে হচ্ছে।’ এমনকী, বিজ্ঞাপন ফেলে দিতে হচ্ছে বলেও জানিয়েছেন তিনি, যেখানে বিজ্ঞাপন সংবাদপত্রের আয়ের অন্যতম উৎস।
ভারতের সংবাদপত্রের যৌথ ফোরাম এবং প্রেস কাউন্সিল গত শনিবার এক বিবৃতি জারি করে এমন পরিস্থিতিতে সরকারকে তাদের পাশে দাঁড়ানোর আহ্বান জানিয়েছে। দ্রুত সমাধানসূত্র হিসেবে ভারতে নিউজপ্রিন্ট আমদানির ওপর ভারত সরকারের আরোপিত পাঁচ শতাংশ কাস্টমস ডিউটি প্রত্যাহারের দাবি জানিয়েছেন ফোরামের সদস্যরা।