রবীন্দ্রনাথের লেখা শ্রীলঙ্কার জাতীয় সংগীত, স্বীকৃতি পেয়েছিলেন অন্য কেউ? আজও জারি বিতর্ক

রবীন্দ্রনাথ বা সামারাকুন, যেইই শ্রীলঙ্কার জাতীয় সংগীতের রূপকার হোন না কেন, একটা কথা শেষে বলতেই হয়, ২ জনের নামের সঙ্গে জড়িয়ে আছে একটা প্রতিষ্ঠান, যার নাম বিশ্বভারতী। একজন এই প্রতিষ্ঠানের রূপকার, অন্যজন এর ছায়ায় লালিত।

 

মা লঙ্কা আমি তোকে প্রণাম করি!

হে মা, তোর সমৃদ্ধি বিপুল,

দয়া আর মমতায় তুই অতুল...

ভালবাসায় পূর্ণ, এক শক্তিশালী রাষ্ট্র,

আমরা সবাই এক হয়ে, আগ বাড়াই।

হে মা আমাকে পূর্ণ স্বাধীনতার দিকে নিয়ে যা।

অরাজক শ্রীলঙ্কা। উত্তাল সময়ের মধ্য দিয়ে যাচ্ছে দ্বীপরাষ্ট্র। অর্থনীতি এই দেশকে পৌঁছে দিয়েছে খাদের কিনারে। সেখান থেকে উত্তরণের উপায় খুঁজছে কলম্বো। শ্রীলঙ্কা যখন বুকে পাথর বেঁধে ঘুরে দাঁড়ানোর চেষ্টা করছে, তখন এই লাইনগুলো তো হতেই পারে জাগরণের মন্ত্র। স্বাধীন শ্রীলঙ্কার নিজস্ব জাতীয় সঙ্গীত হলো– মা লঙ্কা, আমি তোমাকে প্রণাম করি। গানটির আসল রচয়িতা ও সুরকার কে, তা নিয়ে নানা মুনির নানা মত।

'শ্রীলঙ্কা মাতা’ গানের রচয়িতা সম্পর্কে বিভিন্ন মত আছে। সবচেয়ে প্রচলিত ধারণা হচ্ছে, শ্রীলঙ্কার খ্যাতিমান সংগীত-ব্যক্তিত্ব আনন্দ সামারকুন রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের দ্বারা অনুপ্রাণিত ও উৎসাহিত হয়ে গানটি লিখেছিলেন। অনেকে বলেন, রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর পুরো গানটি লেখেন। কেউ কেউ বলেছেন, গানটির সুরকার রবীন্দ্রনাথ এবং রচয়িতা সামারাকুন। রবীন্দ্রনাথ সরাসরি এই গান রচনায় যুক্ত ছিলেন এই ধারণা ভারতীয় ঐতিহাসিক লিপি ঘোষ এবং শ্রীলঙ্কার ঐতিহাসিক Sandagomi Coperahewa অস্বীকার করেছেন। আনন্দ সামারাকুন বিশ্বভারতী বিশ্ববিদ্যালয়ে রবীন্দ্রনাথের ছাত্র ছিলেন। শ্রীলঙ্কা ফিরে যাওয়ার পর তিনি মাহিন্দা কলেজে গান শেখাতেন। মাহিন্দা কলেজের শিক্ষার্থীরা প্রথমে নমো নমো মাতা গানটি পরিবেশন করেন। পরবর্তীতে মিউসেস কলেজ নামে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের গায়ক দল গানটি পরিবেশন করার পর তা শ্রীলঙ্কায় জনপ্রিয় হয়। সেই সময় বেতারে সম্প্রচারিত জনপ্রিয় গানগুলোর মধ্যে অন্যতম ছিল এটি।

আরও পড়ুন: গোটা বিশ্ব তাকিয়ে আছে, কোন পথে হাঁটবে এবার শ্রীলঙ্কা?

১৯৪৮ সালে শ্রীলঙ্কা ব্রিটেনের হাত থেকে মুক্তি পায়। স্বাধীন দেশ হিসেবে আত্মপ্রকাশ করে এই দ্বীপরাষ্ট্র। কিন্তু স্বাধীনতার পরও শ্রীলঙ্কায় ব্রিটেনের জাতীয় সংগীত ব্যবহার করা হতো। ১৯৫০ সালে শ্রীলঙ্কার অর্থমন্ত্রী জে আর জয়বর্ধনে শ্রীলঙ্কা সরকারকে আনন্দ সামারাকুনের অনুবাদকৃত নমো নমো মাতা গানটিকে শ্রীলঙ্কার জাতীয় সংগীত করার আবেদন জানান। তখন শ্রীলঙ্কা সরকার গৃহ ও গ্রামোন্নয়নমন্ত্রী এডুইন বিজয়রত্নর নেতৃত্বে জাতীয় সংগীত প্রণয়ন-সংক্রান্ত একটি কমিট গঠন করে। উক্ত কমিটি অনেকগুলো গান নির্বাচন করে। শেষ পর্যন্ত আনন্দ সামারাকুনের নমো নমো মাতা জাতীয় স‌ংগীত হিসেবে স্বীকৃতি পায়। এই কমিটি সামারাকুনের মত নিয়ে গানটির দশম পংক্তিতে কিছু পরিবর্তন ও পরিবর্ধন আনে। ১৯৫১ সালের ২২ নভেম্বর সরকার গানটিকে শ্রীলঙ্কার জাতীয় সংগীত হিসেবে ঘোষণা করে। ১৯৫২ সালে এম নলথম্বি গানটি তামিল ভাষায় অনুবাদ করেন। ১৯৫২ সালে শ্রীলঙ্কার প্রথম স্বাধীনতা দিবসে গানটি আনুষ্ঠানিকভাবে গাওয়া হয়।

যাঁরা গানটি রবীন্দ্রনাথের লেখা ও সুর বলে দাবি করেন, তাঁরা বলেছেন, আনন্দ সামারাকুন ছিলেন রবীন্দ্রনাথের প্রিয় পাত্র। ১৯৩৮-এ তিনি গুরুদেবের কাছে তাঁর দেশের জন্য গান লিখে দেওয়ার অনুরোধ করেন। রবীন্দ্রনাথ 'নমো নমো শ্রীলঙ্কা মাতা' গানটি লিখে আনন্দকে দেন। ১৯৪০-এ দেশে ফিরে ১৯৪৬-এ গানটি সিংহলি ভাষায় অনুবাদ করে একটি রেকর্ড বের করেন আনন্দ। একটা মহল থেকে এই নিয়ে ঝড় ওঠে। তাঁরা বলেন, যদি এই কথাগুলো সত্য বলে ধরে নেওয়া হয়, তাহলে আনন্দ সামারাকুন অসততা তো করেছেনই, এমনকী, মেধাসত্ব আইন লঙ্ঘন করার অপরাধও করেছেন। রবীন্দ্রনাথের গানের অনুবাদটি তাঁর নিজের রচনা বলে চালিয়ে দিয়ে তিনি অন‍্যায়ভাবে জাতীয় সংগীতকার হয়েছেন। তাঁর আত্মহত্যার পিছনে কোনও গ্লানি কাজ করেছিল কি না, তা নিয়েও প্রশ্ন তোলে নানা মহল।

গানটির রচয়িতা রবীন্দ্রনাথ, এই ধারণার বিপক্ষে যুক্তি দিয়েছেন শ্রীলঙ্কার ইতিহাসবিদ Sandagomi Coperahewa। তাঁর যুক্তি, রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের সব গান ও কবিতা যেখানে গ্রন্থভুক্ত, সেখানে এই গানের কোনও উল্লেখ নেই। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর নিজেও কখনও এই গানটি তাঁর লেখা বলে দাবি করেননি। অতএব, শ্রীলঙ্কার জাতীয় সংগীত রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের লেখা নয়। এটি তাঁর ছাত্র আনন্দ সামারাকুনের লেখা।

১৯৩০ সালে তরুণ সামারাকুন বিশ্বভারতীতে কলাবিভাগের ছাত্র হিসেবে যোগ দেন। তাড়াতাড়ি তিনি হয়ে ওঠেন রবীন্দ্রনাথের প্রিয় পাত্র। রবীন্দ্রসংগীতের সুর ও কথা বারবার মুগ্ধ করেছে তাঁকে। তাঁর গানে তাই রবীন্দ্র-প্রভাব দেখা যায়। তাই কি এই গান নিয়ে এত বিতর্ক? সামারাকুন শ্রীলঙ্কার গানের একটা নতুন ঘরানা তৈরি করতে চাইছিলেন। অবশ্যই সেখানে ছিল রবীন্দ্র-চর্চা ও রবীন্দ্রসংগীতের প্রভাব। একটি গানে তিনি দুই তরুণ-তরুণীর মধ্যে সংলাপের ধরনে গান লিখেছিলেন। এই গানটি প্রবল সাফল্য পাওয়ার পর সামারাকুন অসংখ্য গান লেখেন। সংগীতজ্ঞ হিসেবে সাফল্য পান। তাঁর জীবনে সুখদুঃখ হাত ধরাধরি করে এসেছে। ১৯৪৫ সালে সামারাকুনের পাঁচ বছরের ছেলের মৃত্যু হয়। মনের শান্তির জন্য ভারতে চলে আসেন। চিত্রকর হিসেবে নতুনভাবে সম্মান পান। তিনি আবার গানের জগতে ফিরে আসেন ১৯৫১ সালে। আদর্শ শিল্পী ছিলেন তিনি। যন্ত্রণা আর বিতর্ক তাঁর পিছু ছাড়েনি কখনও। শ্রীলঙ্কার জাতীয় সংগীত নিয়ে বিতর্ক আজও চলছে।

আজ গণবিক্ষোভে উত্তাল শ্রীলঙ্কা। অর্থনীতি ধসে পড়েছে। রাস্তার মোড়ে মোড়ে জনসমুদ্র উপচে পড়ছে। সনৎ জয়সূর্যর মতো তারকাও তাতে শামিল হয়েছেন। অর্থনৈতিক সংকট কাটিয়ে উঠতে এই মুহূর্তে আন্তর্জাতিক অর্থভান্ডারের সঙ্গে কথা চলছে কলম্বোর। এই অবস্থায় এই গানের কথাগুলো কি একটা মৃতপ্রায় দেশের ঘুরে দাঁড়ানোর মন্ত্র হতে পারে না?

রবীন্দ্রনাথ বা সামারাকুন, যেইই শ্রীলঙ্কার জাতীয় সংগীতের রূপকার হোন না কেন, একটা কথা শেষে বলতেই হয়, ২ জনের নামের সঙ্গে জড়িয়ে আছে একটা প্রতিষ্ঠান, যার নাম বিশ্বভারতী। একজন এই প্রতিষ্ঠানের রূপকার, অন্যজন এর ছায়ায় লালিত।

More Articles