নকল জিনিস খেলেই বিপদ, এমনকী হতে পারে ক্যানসারও! খাঁটি দারুচিনি চিনবেন কী করে?

Real Cinnamon Stick Powder Identification :

“দূর দ্বীপবাসিনী/ চিনি তোমারে চিনি/ দারুদিনিরও দেশে, তুমি বিদেশিনী গো/ সুমন্দ ভাষিণী”

সেই কবে কাজী নজরুল ইসলাম লিখে গিয়েছেন দারুচিনি দ্বীপের কথা। কেবল বাঙালি নয়, প্রতিটা ভারতীয়ের ঘরে একটু খুঁজলেই পাওয়া যাবে এই বিশেষ বস্তুটি। দারুচিনি বা দারচিনি। রান্নায় একটু দারুচিনির টুকরো বা মশলা দিয়ে দিলেই… আহা! সেই স্বাদই আলাদা! তবে কেবল ভারত নয়, গোটা বিশ্বেই ছড়িয়ে রয়েছে এই বিশেষ মশলাটি। কিন্তু আপনার ঘরে যে দারুচিনি রয়েছে, সেটি কি আদৌ খাঁটি? গবেষক ও ডাক্তাররা বলছেন, খাঁটি দারুচিনি অনেক উপকারী। কিন্তু নকল বা অন্য জাতের দারুচিনি খেলেই কিন্তু সমূহ বিপদ! শরীরে বাঁধবে রোগের বাসা।

দারুচিনির সাত সতেরো

দারুচিনি গাছের ছাল থেকে এই বিশেষ মশলাটিকে বের করা হয়। প্রথমে তো গাছের ছাল ভালো করে কেটে সংগ্রহ করা হয়। তারপর সেই শক্ত ছালের ভেতরের অংশটিকে বের করে নেওয়া হয়। সেটিই হল দারুচিনি মশলা। যার গন্ধই আপনাকে জানান দিয়ে দেবে। সেই বস্তুটি বের করে নেওয়ার পর শক্ত বাকলটি ফেলে দেওয়া হয়।

এরপর এই দারুচিনিকে ভালো করে শুকানো হয়। এর ফলে দুটো জিনিস হয়। এক, দারুচিনির ভেতরের তেলটি আরও প্রখর হয়। মূলত এই বিশেষ বস্তুটিই দারুচিনির গন্ধের কারণ। আর দুই, শুকিয়ে যাওয়ার ফলে দারুচিনি একটু একটু করে গুটিয়ে যায়। লম্বা, গোল সেই কাঠিগুলোকেই দারুচিনি স্টিক না সিনামন স্টিক হিসেবে বিক্রি করা হয়। সেগুলো গুঁড়ো করেও ব্যবহার করা হয়।

আরও পড়ুন : ভারতের পরাধীনতার শুরু গোলমরিচ থেকে! স্বাদে-গুণে ভরপুর এই মশলার ইতিহাস অবিশ্বাস্য

ভারতের প্রাচীন শাস্ত্রে দারুচিনির নানা গুণের বর্ণনা দেওয়া হয়েছে। দারুচিনির মধ্যে প্রচুর পরিমাণে অ্যান্টি অক্সিডেন্ট রয়েছে। সেইসঙ্গে আরও বেশকিছু উপকারী বস্তু রয়েছে। এসবের জন্য দারুচিনি মানুষের ব্লাড সুগার নিয়ন্ত্রণ করতে সাহায্য করে। এছাড়াও হৃদরোগের হাত থেকে রক্ষা করে, শরীরে প্রদাহ হতে দেয় না। সেইসঙ্গে দারুচিনির ভেতরের ওই বিশেষ তেল, যার নাম সিনামালডিহাইড, সেটি শরীরের মেটাবলিজম নিয়ন্ত্রণ করতে সাহায্য করে। কেবল রান্নায় নয়, চা, মিষ্টির পাশাপাশি বিভিন্ন তেল ও আয়ুর্বেদিক প্রোডাক্ট তৈরিতে ব্যবহার করা হয়।

দারুচিনির প্রকারভেদ

পৃথিবীতে প্রধানত দুই রকমের দারুচিনি পাওয়া যায়। এক, সেইলন সিনামন (Ceylon Cinnamon), যার বিজ্ঞানসম্মত নাম Cinnamomum verum। এই গাছ থেকেই এটি সংগ্রহ করা হয়। আরেকটি হল ক্যাশিয়া সিনামন (Cassia Cinnamon), যেটি Cinnamomum cassia গাছ থেকে পাওয়া যায়। খাঁটি আর নকল – দুটোর অহস্যই লুকিয়ে আছে এর মধ্যে।

কোনটা খাঁটি, কোনটা ক্ষতিকর

মশলা গবেষক ও বিজ্ঞানীরা বলেন, সেইলন সিনামন সাধারণত দক্ষিণ ভারত ও শ্রীলঙ্কায় পাওয়া যায়। এই বিশেষ দারুচিনির রং হালকা বাদামি। অনেকগুলো স্টিক একসঙ্গে থাকে, আর একটু নরম হয়। বিশেষজ্ঞরা বলেন, ভারত-শ্রীলঙ্কায় তৈরি হওয়া এই বিশেষ দারুচিনিটিই খাঁটি। আসল গুণ এর মধ্যেই আছে।

আরও পড়ুন : যে বাসনে রোজ রাঁধেন, সেখান থেকেই মারণ রোগ! অজান্তেই শরীরে তিল তিল করে বাড়ছে ক্যানসার

অন্যদিকে ক্যাশিয়া সিনামনকে চাইনিজ দারুচিনিও বলা হয়। শক্ত, খসখসে, গাঢ় বাদামি রঙের হয় এটি, সঙ্গে একটু লালের ছোঁয়া। বাজারে এই দারুচিনিই সবচেয়ে বেশি পাওয়া যায়। অথচ বিশেষজ্ঞরা বলছেন, গবেষণায় দেখা গিয়েছে, এই ক্যাশিয়া দারুচিনিই ক্ষতিকারক। কিন্তু কেন?

কেন ক্ষতিকারক

বিশেষজ্ঞরা বলছেন, ক্যাশিয়া দারুচিনির ভেতর এক ধরণের রাসায়নিকের উপস্থিতি লক্ষ্য করা গিয়েছে। এই বিশেষ রাসায়নিকের নাম ‘কৌমারিন’ (Coumarin)। এমনিতে এই বস্তুটি ঠিক আছে; কিন্তু বেশি মাত্রায় শরীরে জমলেই শুরু হয় বিভিন্ন রোগ। গবেষকরা দেখেছেন, অতিরিক্ত মাত্রায় শরীরে কৌমারিন গেলে সেটি লিভার, কিডনি এবং ফুসফুসের ক্ষতি করে। এমনকী সেই ক্ষতি কখনও কখনও মৃত্যুর দিকেও টেনে নিয়ে যায়। অনেকের মতে, এই কৌমারিন কার্সিনোজেনিক; অর্থাৎ ক্যানসারের কারণও হতে পারে। তাই ক্যাশিয়া দারুচিনি এড়িয়ে যাওয়াই ভালো।

আর এখানেই আসল সমস্যা। বাজারে ক্যাশিয়া বা চাইনিজ দারুচিনির পরিমাণই সবচেয়ে বেশি। আর মানুষজনও না জেনে এই দারুচিনিই কিনে ঘরে নিয়ে যান। কারণ, এটি তুলনামূলকভাবে সস্তা। অন্যদিকে, ভারত-শ্রীলঙ্কার দারুচিনি উৎকৃষ্ট মানের হলেও, দামের দিক থেকে তুলনায় অনেক বেশি। তাই সবসময় এটি কিনে আনা যায় না। তবুও দারুচিনি চিনে সঠিকভাবে, পরিমিত ব্যবহার করুন। মশলা যেন আপনার মৃত্যুর কারণ না হয়।

More Articles