সন্তানের অত‍্যাচার সহ‍্য করেই বেঁচে রয়েছেন বেশিরভাগ ভারতীয় বাবা-মা! শিউরে ওঠার মতো তথ্য সামনে

ভারতীয় সমাজে বাবা-মায়ের ওপর সন্তানের অত্যাচারের ঘটনা ক্রমেই বাড়ছে।

বাবা-মায়ের প্রতি সন্তানের কর্তব্য পালন করা ভারতীয় সংস্কৃতির অঙ্গ। কথায় বলে, 'কুপুত্র যদিবা হয়, কুমাতা কদাপি নয়'। এই ধরনের উপদেশ পরিবারের অন্দরে শিশুর জ্ঞান হওয়া ইস্তক শেখানো হয়। বাবা-মায়েরাও আশা করেন, সন্তান তাঁদের দেখভাল করবে।

তবে আশা অনেক ক্ষেত্রেই দুরাশা হয়ে যাচ্ছে। কেননা, ছেলেমেয়েরা অনেক সময়ই চূড়ান্ত স্বার্থপরতার পরিচয় দিচ্ছে। বৃদ্ধ বাবা-মায়ের প্রতি লাগাতার অত্যাচার চালাচ্ছে সন্তান-সন্ততিই। দুর্ভাগ্যজনক, এই বিষয়টি সম্পর্কে প্রয়োজনীয় তথ্য কেন্দ্রীয় সরকারের হাতেও নেই। হাতে নেই রাজ্য সরকারেরও। এমনকী, পরিবারের অন্দরে বাবা-মায়ের ওপর ছেলেমেয়ের অত্যাচারের ঘটনা সম্পর্কে নির্দিষ্ট তথ্য পুলিশ-প্রশাসনের হাতেও নেই। গবেষকরা জানিয়েছেন, এর কারণ সন্তানের হাতে অত্যাচারিত বাবা-মায়েরা অধিকাংশ ক্ষেত্রেই লজ্জায় কুণ্ঠাবোধ করছেন থানা-আদালতে নালিশ ঠুকতে। সহ্য করে চলেছেন লাগাতার অত্যাচার।

বিষয়টি নিয়ে সমাজতাত্ত্বিক গবেষণা এখনও ব্যাপকভাবে হয়নি। আশা করা যায়, আগামিদিনে বিষয়টি নিয়ে গবেষণার কাজ হবে। তাতে জানা যাবে নির্দিষ্ট তথ্য।

আরও পড়ুন: পরিচারিকাকে গরম তাওয়ার ছ‍্যাঁকা, প্রস্রাব চাটানো! অভিযুক্ত খোদ ‘বেটি বাঁচাও’-এর কাণ্ডারি, কে এই সীমা পাত্র?

ভারতীয় সমাজে বাবা-মায়ের ওপর সন্তানের অত্যাচারের ঘটনা যে ক্রমেই বাড়ছে, এর পরোক্ষ প্রমাণ অবশ্য রয়েছে। কারণ সারা দেশেই বৃদ্ধাশ্রমের সংখ্যা বেড়েছে। সন্তানের কাছে পরিত্যক্ত বাবা-মায়েদের শেষ জীবনের আশ্রয় অনেক ক্ষেত্রেই বৃদ্ধাশ্রম। নাহলে সম্পূর্ণ নিরাশ্রয় হয়ে চোখের জল ফেলতে হবে। বাবা-মায়ের প্রতি ছেলেমেয়েদের ঔদাসীন্য অথবা কর্তব্য পালন না করাটা যে গোটা সমাজের পক্ষে ক্ষতিকারক, তা বলার অপেক্ষা রাখে না।

সর্বশেষ সেনসাস রিপোর্ট অনুসার, ভারতে বর্তমানে ৬০ বছর অথবা ৬০ বছরের বেশি বয়সের নাগরিকের সংখ্যা ১০ কোটি ছাড়িয়েছে। বয়স্ক নাগরিকদের মধ্যে বৃদ্ধর চেয়ে বৃদ্ধার সংখ্যাই বেশি। সারা দেশে ৫ কোটির বেশি বয়স্ক নাগরিক বৃদ্ধা। ৬০ বছর কিংবা ৬০ বছরের বেশি বয়সের নাগরিকের বৃদ্ধ নাগরিকের সংখ্যা ৫ কোটিরও বেশি। এছাড়া সরকারি ও বেসরকারি সমীক্ষার রিপোর্ট অনুসারে, আগামী কয়েক বছরে ভারতে বৃদ্ধ নাগরিকের সংখ্যা আরও অনেকটাই বাড়তে চলেছে।

'ইউনাইটেড ন্যাশনাল পপুলেশন ফান্ড' এবং 'হেল্প এজ ইন্ডিয়া'-র গবেষণা অনুসারে, ২০২৬ সালে ভারতীয় নাগরিকদের মধ্যে ১৭ কোটিতে এসে দাঁড়াবে ৬০ বছরের চেয়ে বেশি বয়স্ক নাগরিক।

বৃদ্ধ-বৃদ্ধারা সন্তানের হাতে অত্যাচারের শিকার হলেও ওঁরা সেই অত্যাচার প্রতিহত করতে পারছেন না‌, বৃদ্ধ বয়সে শারীরিক জোর হারিয়ে ফেলায়। অনেক ক্ষেত্রে এই অত্যাচারের সাক্ষী থেকে প্রতিবেশীরা উদাসীনতাবশত তা এড়িয়ে যাচ্ছেন। বারণ করার মতো কেউ নেই। বৃদ্ধ-বৃদ্ধারা শারীরিক ও মানসিক হেনস্থার শিকার হচ্ছেন পুত্রসন্তানের পাশাপাশি কন্যাসন্তানের মাধ্যমে। এই ধরনের ঘটনাগুলি পারিবারিক নির্যাতন এবং বেআইনি।


এ-ব্যাপারে এই পর্যন্ত যতটুকু তথ্য স্বেচ্ছাসেবীদের হাতে এসেছে, তাতে দেখা যাচ্ছে, বৃদ্ধ বাবার তুলনায় বৃদ্ধা মায়েরাই হেনস্থার শিকার হচ্ছেন বেশিমাত্রায়। সন্তানকে ঘিরে রকমারি রঙিন স্বপ্ন, অসীম আকাঙ্ক্ষা বাবা-মায়েদের ছিল, তা ধুলোয় পর্যবসিত হচ্ছে। অনেক ক্ষেত্রে জীবনের শেষ প্রান্তে এসে। দেশজুড়ে এই ধরনের ঘটনা ঘটে চলা যে সামাজিক অবক্ষয়ের কারণ, সেও বলার অপেক্ষা রাখে না। যদিও বৃদ্ধ বয়সে মা-বাবা পেটানোর অসুখ গোটা সমাজেই রক্তবীজের মতো ছড়িয়ে পড়েনি। আজও ছেলেমেয়েদের মধ্যে অনেকেই বয়স্ক বাবা-মাকে গুরুজন হিসেবে সেবা করা কর্তব্য বলে মনে করেন।

মনস্তাত্ত্বিকদের মতে, বাবা-মায়েদের উচিত শৈশব-কৈশোরে ছেলেমেয়েকে এমনভাবে শিক্ষা দেওয়া, যাতে ছেলেমেয়ের মধ্যে মূল্যবোধ জাগ্রত হয়। পারিবারিক এই শিক্ষা সমস্যা সমাধানের অন্যতম উপায়। শুধু যে বৃদ্ধ বয়সেই বাবা-মায়েরা ছেলেমেয়ের হাতে মানসিক এবং শারীরিক নির্যাতনের শিকার হচ্ছেন, এমনই নয়। একাধিক সমীক্ষার ফলাফল খতিয়ে দেখা যাচ্ছে, অনেক ক্ষেত্রে কিশোর-কিশোরীরাও বাবা-মায়ের ওপর মানসিক ও শারীরিক নিপীড়ন চালাচ্ছে। এদের বয়স ১২ থেকে ১৭ বছরের মধ্যে। আবার বেশ কিছু ক্ষেত্রে ১০ বছর পেরোলেই বাবা-মায়ের সঙ্গে দুর্ব্যবহার করছে ছেলেমেয়েদের একাংশ।

এ-পর্যন্ত এ-ব্যাপারে যে গবেষণাগুলি হয়েছে, তাতে দেখা যাচ্ছে, বাবা-মাকে নির্যাতন করার মানসিকতা সম্পর্কজনিত গোলমালের কারণে। বেশ কিছু ক্ষেত্রে বাবা-মায়েরা সন্তানের সঙ্গে বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক গড়ে তুলতে ব্যর্থ হওয়ায় ও গোড়ায় গলদ থাকায় এই করুণ পরিস্থিতি। বাবা-মায়ের সঙ্গে দুর্ব্যবহার কিংবা বাবা-মায়ের ওপর শারীরিক-মানসিক হেনস্থা চালানোটা কেবল ভারতেরই নয়, পৃথিবীর অন্যান্য দেশেরও সমস্যা। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রেও উদ্বেগজনকভাবে বাড়ছে এই ধরনের ঘটনা। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, কানাডা-সহ পৃথিবীর অন্য দেশগুলিতে বাবা-মায়ের ওপর মানসিক ও শারীরিকভাবে নির্যাতন চালিয়ে সন্তানরা পার পেয়ে যাচ্ছে। প্রধানত এর কারণ ছেলেমেয়ের বিরুদ্ধে পুলিশে নালিশ ঠুকতে লজ্জাবোধ করছেন অনেক বাবা-মা-ই।


ছেলেমেয়েরা বাবা-মায়ের ওপর অত্যাচার চালাচ্ছে কেন, এ-সম্পর্কে যে সমীক্ষাগুলি হয়েছে, সেগুলি থেকে জানা গিয়েছে, বাবা-মায়ের সঙ্গে সন্তানের মতের অমিল হলে সন্তানের আচরণ হিংস্র হয়ে উঠছে। রাগের বশবর্তী হয়ে বাবা-মাকে নির্যাতন করছে নানা উপায়ে। বাস্তববোধের অভাব এর আরেকটি কারণ বলে মনে করেন মনস্তাত্ত্বিকরা। যেসমস্ত ছেলেমেয়ে বাবা-মাকে নির্যাতন করছে, এদের একাংশ আবার মাদকাসক্তও। মানসিক অসুস্থতার কারণে ছেলেমেয়ের মধ্যে সামান্য কারণে বাবা-মায়ের প্রতি রাগ-অভিমান বাড়ছে। যার পরিণতি সন্তানের নির্যাতন সহ্য করা।

এদিকে বাবা-মায়ের প্রতি সন্তানের অত্যাচারের প্রসঙ্গ যুগ যুগ ধরে অবহেলিত ছিল। এই নিয়ে গবেষকরা মাথা ঘামাতে শুরু করেন সাতের দশকের শেষাশেষি সময়ে। গবেষকরা খতিয়ে দেখেছেন মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, কানাডা, অস্ট্রেলিয়ায় উদ্বেগজনক হারে বাবা-মায়েরা সন্তানের হাতে লাঞ্চিত। বৃদ্ধবৃদ্ধাদের পাশাপাশি কিশোর-কিশোরী ছেলেমেয়েরা বাবা-মাকে মারধর করছে কিংবা দুর্ব্যবহার করছে। এর অন্যতম একটি কারণ, সমাজবিচ্ছিন্ন মানসিকতা। বাবা-মায়ের প্রতি সন্তান অত্যাচার চালালে পৃথিবীর সব দেশেই তা বেআইনি।

একদিকে বাবা-মায়েদের ওপর ছেলেমেয়ের অত্যাচার চলছে যেমন, একইভাবে বাবা-মায়েরাও সন্তান মানুষ করতে চেয়ে নাবালক-নাবালিকা ছেলেমেয়ের ওপর নির্যাতন চালাচ্ছে। ইউনিসেফ-এর সমীক্ষায় ধরা পড়েছে, ভারতীয় সমাজে বাবা-মায়েরা শাসন করার নামে ছেলেমেয়েদের ব্যাপক মারধর করছেন। ছেলেমেয়েদের শাসন করার নামে কার্যত নির্যাতন চালাচ্ছেন। এক্ষেত্রে ৩০ কিসিমের শাস্তিমূলক উপায় ব্যবহার করা হচ্ছে। এদেশে লঘু দুষ্টুমির জন্যে শিশুদের শাসনের জন্য বাবা-মায়েদের কাছে বরাদ্দ উপায়গুলির মধ্যে রয়েছে মারধর করা, চড় মারা থেকে শুরু করে লাঠি, রড, বেল্ট দিয়ে বেধড়ক প্রহার। এছাড়া মৌখিকভাবে শাসন হিসেবে বাবা-মায়ের একাংশের ছেলেমেয়েদের গালিগালাজ করা থেকে শুরু করে কথায় কথায় নেতিবাচক সমালোচনা করা অথবা অনবরত নাবালক-নাবালিকা সন্তানের পিছনে লেগে থেকে খিটখিট করাও ভারতীয় সমাজে জলভাত।

More Articles