ভারতে হু হু করে বাড়ছে দারিদ্র, পাল্লা দিয়ে বাড়ছে লাখপতি-কোটিপতির সংখ্যাও

একদিকে দেশের অসংখ্য মানুষ করোনা পরিস্থিতিতে দারিদ্ৰের অতলে তলিয়ে যাচ্ছেন, অন্যদিকে দেশের জনসংখ্যার তুলনায় স্বল্প-সংখ্যক হলেও নাগরিকদের একাংশ লাখোপতি কিংবা কোটিপতি বনে গিয়েছেন করোনা পরিস্থিতির পরবর্তী সময়ে।

২০২০ সালের মার্চে ভারতে করোনা হামলা চালানোর পরে বহু ভারতীয় দারিদ্ৰের অন্ধকারে তলিয়ে গিয়েছেন। এর দু'বছরের ভেতর চলতি বছরে দেশের স্বাধীনতার ৭৫ বছর পূর্তি হচ্ছে। স্বাধীনতার ৭৫ বছর উপলক্ষে দেশজুড়ে পালিত হচ্ছে স্বাধীনতার 'আজাদি কা অমৃত মহোৎসব'।

একদিকে দেশের অসংখ্য মানুষ করোনা পরিস্থিতিতে দারিদ্ৰের অতলে তলিয়ে যাচ্ছেন, অন্যদিকে দেশের জনসংখ্যার তুলনায় স্বল্প-সংখ্যক হলেও নাগরিকদের একাংশ লাখপতি কিংবা কোটিপতি বনে গিয়েছেন করোনা পরিস্থিতির পরবর্তী সময়ে। সরকারি তথ্যই একথা জানাচ্ছে। তবে কীভাবে তাঁরা লাখপতি অথবা কোটিপতি বনে গেলেন, এ-ব্যাপারে বিশদ কোনও তথ্য নেই। কেন্দ্রীয় সরকার জানায়নি, এঁরা আদতে কোন পেশার মানুষ।

২০২১-'২২ সালের মধ্যে সারা দেশের মোট ৭৬ লক্ষ নাগরিকের বাৎসরিক রোজগার বছরে ১০ লক্ষ ১ কোটি টাকার মধ্যে এসে দাঁড়িয়েছে। একথা সর্বজনবিদিত যে, অধিকাংশ ভারতীয় নাগরিকের ১৯৪৭ সালে দেশ স্বাধীন হওয়ার পর থেকে এ-পর্যন্ত নুন আনতে পান্তা ফুরোনোর দশা।

আরও পড়ুন: ‘ডিজিটাল’ ভারতেও কোটি কোটি মহিলা বঞ্চিত মোবাইল ব্যবহারে, নয়া সমীক্ষায় বৈষম্য স্পষ্ট

তবে অর্থনীতিবিদদের একাংশের মতে, ভারতের অর্থনীতি পরাধীন আমলের তুলনায় স্বাধীনতার ৭৫ বছরে অনেকটাই সমৃদ্ধ হয়েছে। বিশেষত, গত দু'দশকে দেশ অর্থনৈতিকভাবে উল্লেখযোগ্য সমৃদ্ধি লাভ করেছে। 'বহু জন হিতায় বহু জন সুখায়'-এর নীতি ভারতের মাটিতে কত দূর পর্যন্ত বাস্তবায়িত হয়েছে, তা নিয়ে বিতর্ক যদিও অব্যাহত।

ভারতের মোট জনসংখ্যার তুলনায় অতি নগণ্য সংখ্যক নাগরিক আয়কর জমা দিয়ে থাকেন। ২০২২-'২৩ সালের আর্থিক বছরে আয়কর রিটার্ন জমা দিয়েছেন অতি স্বল্প সংখ্যক ভারতীয় নাগরিক। শতাংশের হিসেবে সংখ্যাটা ১ দশমিক ৬ শতাংশ। এদিকে ২০২০ সালের হিসেব অনুসারে ভারতের মোট জনসংখ্যা ১৩৮ কোটি। ফলত, আয়করদাতার সংখ্যা যে অতি সামান্য সংখ্যক, তা বলার অপেক্ষা রাখে না। তবে কেন্দ্রীয় সরকার সম্প্রতি উদ্যোগ নিয়েছে, আরও বেশি বেশি সংখ্যক মানুষকে আয়করের আওতায় আনার জন্য নানাবিধ কৌশল নিতে।

তবে কেন্দ্রীয় কিংবা দেশের বিভিন্ন রাজ্যের সরকারগুলির কাছে এ-পর্যন্ত কোনও তথ্য নেই, ভারতীয় নাগরিকদের পরিবারপিছু মাসিক রোজগার কত। তবে ২০২১-'২২ আর্থিক বছরের হিসেব অনুযায়ী ভারতের বাসিন্দা ৭৬ লক্ষ নাগরিকের মাথাপিছু বাৎসরিক রোজগার ১০ লক্ষ থেকে ১ কোটি টাকার বেশি। এর আগের আর্থিক বছরে এই সংখ্যাটা ছিল চার লক্ষ কম। অর্থাৎ, ৭২ লক্ষ।

কেন্দ্রীয় সরকারি পরিসংখ্যান অনুসারে ২০২১-'২২ আর্থিক বছরে ভারতে বাৎসরিক এক কোটি টাকার বেশি রোজগার, এমন ভারতীয় নাগরিকের সংখ্যা এর আগের বছরের তুলনায় বেশ কিছুটা বেড়েছে। ২০২১-'২২ আর্থিক বছরে এক কোটি টাকার বেশি রোজগার ভারতীয় নাগরিকের সংখ্যা ১ লক্ষ ৩১ হাজার ৩৯০ জন। এর আগের আর্থিক বছরে এই সংখ্যাটা ছিল ১ লক্ষ ২৫ হাজার ২৩ জন।

একইসঙ্গে বাড়ছে দরিদ্র মানুষের সংখ্যাও। কেন্দ্রীয় সরকার জানিয়েছে, দরিদ্র মানুষকে আর্থিক সহায়তা করতে 'আত্মনির্ভর ভারত যোজনা'-য় কেন্দ্রীয় সরকার ২৯ লক্ষ ৮৭ কোটি টাকার আর্থিক প্যাকেজ ঘোষণা করেছে। এছাড়াও আরও কিছু সামাজিক কল্যাণ প্রকল্প চালু করা হয়েছে। উদাহরণ হিসেবে প্রধানমন্ত্রী গরিব কল্যাণ যোজনার কিংবা অন্যান্য প্রকল্পগুলি।

ভারতে যে বাণিজ্য সংস্থাগুলি ব্যবসা করছে, তার মধ্যে সবচেয়ে বেশি সংখ্যক কর্মী বছরে এক কোটি টাকার বেশি বেতন পান আইটিসি-তে। আইটিসি-তে মোট ২২০ জন কর্মীর বাৎসরিক বেতন ১ কোটি টাকা কিংবা তারও বেশি। প্রতি মাসে এঁদের মাথাপিছু বেতন ৯ লক্ষ কাছাকাছি। করোনা পরিস্থিতিতে আইটিসি-র চেয়ারম্যান সঞ্জীব পুরীর বাৎসরিক বেতন ছিল ১১ কোটি ৯৫ লক্ষ কোটি টাকা। তিন দশক আগে ১৯৮৬ সালে তিন দশক আগে্ সঞ্জীব পুরী আইটিসি-তে যোগ দিয়েছিলেন।

অন্যদিকে, আইটিসি-র এক্সিকিউটিভ ডিরেক্টর বি সুমন্ত এবং আর ট্যান্ডন দু'জনের বাৎসরিক বেতনের পরিমাণ ৫ কোটি ৭৬ লক্ষ টাকা এবং ৫ কোটি ৬০ লক্ষ টাকা। এপ্রসঙ্গে বলে রাখা ভালো আইসিটির মোট কর্মীসংখ্যা ২৩ হাজার ৮২৯ জন। এর ভেতর পুরুষ কর্মীর সংখ্যা ২১ হাজার ৫৬৮ জন এবং মহিলা কর্মীর সংখ্যা ২ হাজার ২৬১ জন। স্থায়ী কর্মী ছাড়াও আইটিসিতে অন্যান্য কর্মীর ২৫ হাজার ৫১৩ জন। গোটা ভারতের কোটি কোটি দরিদ্র মানুষের নিরিখে আইটিসি-র কোটিপতি বেতনপ্রাপ্ত আধিকারিকের সংখ্যা সিন্ধুতে বিন্দুসম, একথা বলা বাহুল্য।

সমীক্ষায় জানা গিয়েছে, দেশের বাণিজ্যনগরী মুম্বইয়ে মিলিয়নেয়ারের সংখ্যা সবচেয়ে বেশি। ২০ হাজার ৩০০ জন। এরপর দ্বিতীয় ও তৃতীয় স্থানাধিকারী ১৭ হাজার ৪০০ জন এবং ১০ হাজার ৫০০ জন।

অন্যদিকে, 'হুরুন ইন্ডিয়া ওয়েলথ রিপোর্ট' নামে আরেকটি সমীক্ষায় দেখা যাচ্ছে, ভারতে করোনা হামলার চালানোর ঠিক পরের বছর, অর্থাৎ, ২০২১ সালে ভারতে মিলিয়নেয়ারের সংখ্যা ১১ শতাংশ বেড়েছে। মিলিয়নেয়ারের সংখ্যা ৪ লক্ষ ৫৮ হাজার জন বেড়েছে।

কেন্দ্রীয় সরকার দাবি করেছে, ভারত আগামিদিনে অর্থনৈতিকভাবে দ্রুত সমৃদ্ধিলাভ করবে। 'হুরুন ইন্ডিয়া ওয়েলথ রিপোর্ট' প্রকাশিত সমীক্ষা অনুসারে দেখা যাচ্ছে, আগামী ৬ বছরে ভারতে মিলিয়নেয়ারের সংখ্যা আগামী চার বছরে ২০২৬ সালের মধ্যে ৩০ শতাংশ বাড়তে চলেছে।

এত টাকা উপার্জন করে কী করেন অভিভাবকরা? সমীক্ষায় জানা গিয়েছে, ৭০ শতাংশ মিলিয়নেয়ার জানিয়েছেন, সন্তানদের তাঁরা বিদেশে পড়াতে পাঠাবেন। ২৯ শতাংশ পাঠাবেন মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে, ১৯ শতাংশ পাঠাবেন ব্রিটেনে, ১২ শতাংশ অভিভাবক সন্তানদের ১২ নিউজিল্যান্ডে এবং ১১ শতাংশ অভিভাবক সন্তানকে জার্মানিতে পড়তে পাঠাবেন।

মিলিয়নেয়াররা মানসিকভাবে আছেন কেমন? এসম্পর্কে ৭২ শতাংশ মিলিয়নেয়ার জানিয়েছেন, তাঁরা মানসিকভাবে সুখী। পেশাগতভাবেও তাঁদের ভালোই চলছে।

ভারতীয় সমাজে লিঙ্গবৈষম্য প্রকট হলেও ধনের নিরিখে মেয়েরা এগিয়ে রয়েছেন। কোটাক-হুরুন সমীক্ষা অনুযায়ী, ভারতে মোট ১০০ জন মহিলা রয়েছে, যাঁদের মোট সম্পত্তির পরিমাণ দেশের জিডিপির ২ শতাংশ। এই মহিলাদের মধ্যে কয়েকটি নাম রোশনি নাদার মালহোত্রা, বাইকনের প্রতিষ্ঠাতা কিরণ মজুমদার শ, ডিভি'স ল্যাবরেটরিসের ডিরেক্টর নীলিমা মোটাপার্তি, জোহার সহ-প্রতিষ্ঠাতা রাধা ভেমবু, ইউএসভি-র লীনা গান্ধির তিওয়ারি, হিরো ফিনকর্পের এমডি রেনু মুনজাল, লালপাথ ল্যাবসের ডিরেক্টর বন্দনা লাল প্রমুখ।

More Articles