তাপপ্রবাহে রেকর্ড মৃত্যু, প্রাকৃতিক বিপর্যয়ের ভয়াবহ প্রভাব পড়ছে ভারতীয় অর্থনীতিতেও

২০২২ সালে ভয়াবহ তাপপ্রবাহ দু'দেশকেই ফের চ্যালেঞ্জের মুখে দাঁড় করিয়েছে।

সমতলের তাপমাত্রা ৪০ ডিগ্রি সেলসিয়াসে পৌঁছলে এবং পাহাড়ি এলাকার তাপমাত্রা ৩০ ডিগ্রি ছুঁলে অথবা তার চেয়ে বেশি হলে তা তাপপ্রবাহ হিসেবে চিহ্নিত করেছে ভারতের আবহাওয়া দফতর। চলতি বছরের মার্চ থেকে শুরু করে এপ্রিল পর্যন্ত অভূতপূর্ব তাপপ্রবাহের জেরবার হতে হয়েছে ভারত ও পাকিস্তানকে। কেন্দ্রীয় সরকারের দেওয়া পরিসংখ্যানে দেখা গিয়েছে, ১৯৮০ সাল থেকে শুরু করে এই পর্যন্ত তাপপ্রবাহের বলি মানুষের সংখ্যা অন্ততপক্ষে ৬০ শতাংশ বেড়েছে।

 

তাপমাত্রা চড়চড় করে অস্বাভাবিকভাবে বৃদ্ধির জেরে তাপপ্রবাহের মূল কারণ বিশ্ব উষ্ণায়ন। বিশ্ব উষ্ণায়ন রোধ করা সম্ভব না হলে আগামী কয়েক দশক ভয়াবহ তাপপ্রবাহে ভারত ব্যাপক ক্ষতিগ্রস্ত হবে। সেই সঙ্গে তাপপ্রবাহের জেরে মৃতের সংখ্যা বাড়বে বলে আশঙ্কা বিশেষজ্ঞদের।

 

আবহাওয়া দপ্তর জানিয়েছে, প্রতি বছর মার্চ থেকে জুন পর্যন্ত ভারতে তাপপ্রবাহ চলে। সাধারণত দেশের যে রাজ্যগুলোতে ব্যাপক তাপপ্রবাহ চলে, সেই রাজ্যগুলোর মধ্যে রয়েছে পাঞ্জাব, হরিয়ানা, দিল্লি, উত্তরপ্রদেশ, বিহার, ঝাড়খণ্ড, পশ্চিমবঙ্গ, ওড়িশা, মধ্যপ্রদেশ, রাজস্থান, গুজরাত ছাড়াও মহারাষ্ট্র, কর্নাটক, অন্ধ্রপ্রদেশ এবং তেলেঙ্গানার একাংশ। কখনও কখনও তামিলনাড়ু কিংবা কেরলও প্রবল তাপপ্রবাহের কবলে পড়ে।

 

আরও পড়ুন: পৃথিবীজুড়ে ফিরছে এই সংক্রামক রোগ, আক্রান্ত ভারতও! কতটা ক্ষতিকর, প্রতিকার কী?

 

সম্প্রতি মহারাষ্ট্র সরকারের স্বাস্থ্য দপ্তরের প্রকাশিত তথ্য অনুসারে, ২০২২ সালের মার্চ ও এপ্রিলে তাপপ্রবাহের জেরে মহারাষ্ট্রেই কেবল ২৫ জনের মৃত্যু হয়েছে। এছাড়া মার্চ ও এপ্রিল মাসে হিট স্ট্রোকে আক্রান্ত হয়েছেন ৩৭৪ জন।

 

মহারাষ্ট্র সরকার এই খতিয়ান পেশ করলেও ওয়াকিবহাল মহল মনে করছে, তাপপ্রবাহের জেরে ও হিট স্ট্রোকে আক্রান্ত ও মৃতের সংখ্যা সরকারি হিসেবের চেয়ে কয়েকগুণ বেশি। উল্লেখ্য, চলতি বছরের মার্চে মহারাষ্ট্রের উত্তর এবং মধ্যভাগের জেলাগুলোতে টানা তাপপ্রবাহের ফলে তাপমাত্রা বেড়ে ৪০ ডিগ্রি থেকে ৪৬ ডিগ্রি সেলসিয়াসে পৌঁছয়।

 

গত মার্চ থেকে সারা ভারতে দু'মাসের বেশি সময় ধরে যে তাপপ্রবাহ চলেছিল তার বলি ঠিক কতজন, সেই হিসেব এখনও মেলেনি। তবে কেন্দ্রীয় সরকারি সংস্থা 'ন্যাশনাল ডিজাস্টার ম্যানেজমেন্ট অথরিটি'-র তথ্য অনুসারে, গত ৫০ বছরে ভারতে তাপপ্রবাহের বলি হয়ে মৃত্যু হয়েছে ১৭,০০০-এর বেশি নাগরিকের। তাপপ্রবাহে মৃতেরা অধিকাংশই দরিদ্র শ্রেণির মানুষ এবং সংখ্যাগরিষ্ঠই প্রবীণ নাগরিক।

 

লক্ষ লক্ষ ভারতীয় জীবিকার তাগিদে খোলা জায়গায় কাজ করেন। এঁদের মধ্যে রয়েছেন হকার, যানবাহনের চালক, ট্রাফিক পুলিশ, বেসরকারি নিরাপত্তারক্ষী, নির্মাণশিল্প কিংবা কৃষিক্ষেত্রে কর্মরত মানুষজন। তাপপ্রবাহ চলাকালীন ঘরের বাইরে পা না রাখাটাই আবহাওয়া দপ্তর নিরাপদ বলে জানালেও রোজগারের তাগিদে বিভিন্ন পেশায় যুক্ত দরিদ্র মানুষের সেই সাবধানবাণী মেনে চলার উপায়ও ছিল না।

 

তাপপ্রবাহের ফলে জনস্বাস্থ্য যেভাবে খাদের কিনারায় এসে পৌঁছেছে, তা নিয়ন্ত্রণে কেন্দ্রীয় সরকারের সদিচ্ছা নিয়েও প্রশ্ন তুলেছে ওয়াকিবহাল মহল। এই অভিযোগও উঠছে, ২০১৮ সালে জলবায়ুর পরিবর্তন রোধে এবং জনস্বাস্থ্য সম্পর্কে কেন্দ্রীয় সরকার 'অ্যাকশন প্ল্যান' তৈরি করলেও তা এখনও খাতায়-কলমে বন্দি। কেন্দ্রীয় সরকার তাপপ্রবাহকে 'জাতীয় বিপর্যয় মোকাবিলা আইন'-এর অন্তর্গত না করাতে তাপপ্রবাহ মোকাবিলায় সরকারি বাজেটে বরাদ্দও নামমাত্র।

 

গবেষকরা জানিয়েছেন, গত ২০০ বছরের নিরিখে ২০০৬ সাল পর্যন্ত সময়সীমায় ভারতের বার্ষিক তাপমাত্রা ২ ডিগ্রি বেড়েছে। ২০৩০ সালের মধ্যে এই তাপমাত্রা ১.৫ ডিগ্রি সেলসিয়াস থেকে ২ ডিগ্রি সেলসিয়াস পর্যন্ত বাড়বে বলে পূর্বাভাস। গ্রিন হাউস গ্যাস নিঃসরণের হার কমানো না গেলে ভারতের বাসিন্দাদের একটা বড় অংশকে গ্রীষ্মে সাহারা মরুভূমির মতো প্রবল তাপ সইতে হবে।

 

বলা বাহুল্য, এর ফলে কোটি কোটি দরিদ্র মানুষ ঘোরতর বিপদে পড়বেন, কেন্দ্রীয় সরকার এবং রাজ্য সরকারগুলো পরিস্থিতি মোকাবিলাতে যথাযথ 'অ্যাকশন প্ল্যান' গ্রহণ করে তা বাস্তবায়িত না করলে।

 

সমীক্ষায় আরও জানা গিয়েছে, পরিস্থিতি পরিবর্তিত না হলে ২০৩০ সালের মধ্যে তাপপ্রবাহের নেতিবাচক প্রভাব পড়বে ভারতের অর্থনীতির ওপরেও। কাজের জন্য নির্ধারিত ঘণ্টার ক্ষতি হবে। এই ক্ষতির পরিমাণ ৩ কোটি ৪০ লক্ষ পূর্ণ সময়ের কাজের সমতুল।

 

এ-ব্যাপারে 'ইন্টারন্যাশনাল লেবার অর্গানাইজেশন' যে খতিয়ান পেশ করেছে, তাতে দেখা যাচ্ছে, তাপপ্রবাহ চলাকালীন কৃষিক্ষেত্র এবং নির্মাণশিল্পে কর্মরত শ্রমিকদের কাজের গতি শ্লথ হয়ে পড়ায় ব্যাপক আর্থিক ক্ষতির মুখে পড়বে ভারত।

 

শিকাগো বিশ্ববিদ্যালয়ের 'এনার্জি পলিসি স্টাডিজ'-এর সমীক্ষাতেও ধরা পড়েছে তাপপ্রবাহের জেরে ভারতে অর্থনৈতিক ক্রিয়াকর্মে ক্ষয়ক্ষতির খতিয়ান। গবেষকরা সতর্ক করেছেন, তাপপ্রবাহের ফলে যাঁরা বাইরে কাজ করছেন কেবল তাঁরাই নন, বিপদে পড়বেন ক্ষুদ্র শিল্প সংস্থাগুলোতে কর্মরতরাও। তীব্র দাবদাহে কর্মীদের কর্মক্ষমতাও অনেকটাই হ্রাস পাবে।

 

ভারতে যেভাবে দ্রুত গতিতে, অস্বাভাবিকভাবে জলবায়ুর পরিবর্তন হচ্ছে, তা নিয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করেছে দিল্লির গবেষণা সংস্থা 'কাউন্সিল অন এনার্জি, এনভায়রনমেন্ট অ্যান্ড ওয়াটার'। এই সংস্থার তরফে গবেষক অবিনাশ মোহান্তি বলেছেন, জলবায়ুর অস্বাভাবিক পরিবর্তনের ফলে ভারতের ৭৫ শতাংশ জেলা এখন হটস্পটে পরিণত হয়েছে। ভারতের ৩৫টি রাজ্যের মধ্যে ২৭টি রাজ্য এবং কেন্দ্রশাসিত এলাকাগুলোতে জলবায়ুর অস্বাভাবিক পরিবর্তনের অত্যন্ত নেতিবাচক প্রভাব পড়েছে।

 

গত দু'দশকে তাপপ্রবাহ এবং অন্যান্য প্রাকৃতিক বিপর্যয় মোকাবিলা করতে বারংবার ব্যর্থ হয়েছে ভারত। 'কাউন্সিল অন এনার্জি, এনভায়রনমেন্ট অ্যান্ড ওয়াটার'-এর ২০২১ সালের সমীক্ষা অনুসারে, তাপপ্রবাহ-সহ অন্য প্রাকৃতিক দুর্যোগ মোকাবিলাতে ব্যর্থতার ফলে আর্থিক ক্ষয়ক্ষতির পরিমাণ দাঁড়িয়েছে ১৩.১৪ লক্ষ কোটি।

 

ভারতের পাশাপাশি পাকিস্তানেও তাপপ্রবাহের ফলে পরিস্থিতি বর্তমানে সঙ্গিন। গত দু'মাস ধরে পাকিস্তানেও লাগাতার তাপপ্রবাহ চলেছে। ১৯৬১ সালের পর চলতি বছরের মার্চে সবচেয়ে উত্তপ্ত ছিল পাকিস্তান।

 

২০১৫ সালে ভারত ও পাকিস্তানে ভয়াবহ তাপপ্রবাহে রেকর্ড সংখ্যক মানুষের মৃত্যুর পরে 'ন্যাশনাল ডিজাস্টার ম্যানেজমেন্ট অথরিটি' তাপপ্রবাহ মোকাবিলাতে প্রথমবার জাতীয় গাইডলাইন তৈরি করে। ওই বছর ভারতে তাপপ্রবাহের বলি হন ২,৫০০ জন। পাকিস্তানে মৃত্যু হয় ১,২০০ জন নাগরিকের।

 

২০২২ সালে ভয়াবহ তাপপ্রবাহ দু'দেশকেই ফের চ্যালেঞ্জের মুখে দাঁড় করিয়েছে। প্রসঙ্গত, গত এপ্রিলে উত্তর-পশ্চিম এবং মধ্য ভারতের তাপমাত্রা গত ১২২ বছরের নিরিখে রেকর্ড সৃষ্টি করেছে।

 

 

More Articles