এক দশকেও মিটল না সমস্যা, দেশ ছাড়ছেন লাকি আলি?

তিনি দাবি করেছেন, এর সঙ্গে যুক্ত কিছু দুর্নীতিগ্রস্ত সরকারি কর্মচারী। এতদিন ধরে তিনি অপেক্ষা করেছেন, কিন্তু এইবার তিনি বড় পদক্ষেপ নেবেন। সরকার যদি কোনও তৎপরতা না দেখায় তবে তিনি পাকাপাকিভাবে দেশ ছেড়ে চলে যাবেন, ফের এই দেশ...

যারা নয়ের দশকে জন্মগ্রহণ করেছে, তাদের জীবনের সঙ্গে মাকসুদ মাহমুদ আলি ওরফে লাকি আলির নাম অনেকাংশেই জড়িয়ে আছে, জড়িয়ে আছে তাঁর গানের কারণেই। বলিউডের বিখ্যাত তারকা হৃতিক রোশনের ডেবিউ ফিল্ম ‘কহো না পেয়ার হ‍্যায়’-এর হিট সব গানে তখন লাকি আলির নাম। আলি তাঁর কেরিয়ার শুরু করেছিল ‘ও সনম’ গানটির মাধ্যমে, যা আজও বর্তমান প্রজন্মের কাছে সমানভাবে জনপ্রিয়। চিরকাল খানিক নিরিবিলিতেই থাকতে পছন্দ করতেন এই তারকা। বর্তমানে বেঙ্গালুরুর বাসিন্দা তিনি। সম্প্রতি তাঁর সোশ্যাল মিডিয়ায় করা একটি পোস্ট, শ্রোতামহলে রীতিমতো উদ্বেগের সৃষ্টি করেছে। তিনি সেই পোস্টে লিখেছেন, তাঁর পৈতৃক সম্পত্তি দখল করে রাখা হয়েছে। জমি ফেরত পাওয়ার আশায় তিনি একাধিকবার সরকারের দ্বারস্থ হওয়া সত্ত্বেও, কোনও লাভ হয়নি। এইদিন তিনি স্পষ্টই জানান, ক্ষমতা, প্রতিপত্তি এবং টাকার জোরে জমি-মাফিয়ারা তাঁর একশো একর জমি বেআইনিভাবে দখল নিয়ে রেখেছে। শুধু তাই নয়, তিনি দাবি করেছেন, এর সঙ্গে যুক্ত কিছু দুর্নীতিগ্রস্ত সরকারি কর্মচারী। এতদিন ধরে তিনি অপেক্ষা করেছেন, কিন্তু এইবার তিনি বড় পদক্ষেপ নেবেন। সরকার যদি কোনও তৎপরতা না দেখায় তবে তিনি পাকাপাকিভাবে দেশ ছেড়ে চলে যাবেন, ফের এই দেশে আর পা রাখবেন না।

এই পোস্টের পর স্বাভাবিকভাবেই শোরগোল পড়ে গেছে প্রিয় গায়কের অনুগামী মহলে। কমেন্ট বক্সে অনেকেই তাঁকে ঠান্ডা মাথায় পদক্ষেপ গ্রহণের পরামর্শ দিয়েছে, কেউ কেউ আবার কেন্দ্রীয় সরকারকে কাঠগড়ায় দাঁড় করাতেও পিছপা হয়নি।

যে মানুষটি বরাবরের জন্য লোকচক্ষু থেকে খানিক আড়ালেই থাকতে পছন্দ করতেন, তিনি কতখানি বিতৃষ্ণা থেকে এমন এক সিদ্ধান্তের কথা মিডিয়া-মাধ্যমে প্রকাশ করার সিদ্ধান্ত নিয়েছেন, সেকথা বলার অবকাশ বোধ হয় থাকে না। এখন প্রশ্ন হলো, ঠিক কী হয়েছে তাঁর পৈতৃক সম্পত্তিকে কেন্দ্র করে, যে কারণে বাষট্টি বছর বয়সে এসেও এহেন সিদ্ধান্ত গ্রহণে বাধ্য হচ্ছেন লাকি আলি? এর উত্তর খুঁজতে গেলে পিছিয়ে যেতে হবে বেশ কিছু বছর।

আরও পড়ুন: শ্রীলঙ্কার সংকটে বন্ধু ভারত, কীভাবে দেউলিয়া প্রতিবেশীকে সাহায্য করছে মোদি সরকার?

লাকি আলির বাবা, বিখ্যাত কৌতুক-অভিনেতা মেহমুদ বেঙ্গালুরুর ইয়েলাহাঙ্কায় ১৬৭ একর জমি কিনে সেখানে আলি স্টার্ড ফার্ম নামে একটি ফার্ম স্থাপন করেছিলেন। সেখানে তিনি একটি বাড়িও বানান। ২০০২ সালে তিনি চিকিৎসার কারণে আমেরিকায় চলে যান, এবং দুই বছর পরে অর্থাৎ, ২০০৪ সালে তাঁর মৃত্যু হয়। মেহমুদের মৃত্যুর পর থেকেই আলি পরিবারে জমি-সংক্রান্ত সমস্যার সূত্রপাত ঘটে। আলি জানান, প্রথম প্রথম তাঁর বাবার সঙ্গে সুসম্পর্ক স্থাপনের জন্য বিল্ডার্সের ভাই মাঝে মাঝেই আসতেন। কিন্তু যখন তাঁর বাবা অসুস্থ ছিলেন, তখন থেকেই নির্মাণ সংস্থার লোকজন দাবি জানাতে থাকে যে, মেহমুদ অসুস্থতার সময় রঘুনাথ নামে এক ব্যক্তিকে তাঁর সমস্ত সম্পত্তির ‘জেনারেল পাওয়ার অফ অ্যাটর্নি’ দিয়ে গেছেন এবং এই রঘুনাথ পরবর্তীতে তাঁদের কাছে সমস্ত সম্পত্তি বিক্রি করে দেয় ৩৫ লাখ টাকার বিনিময়ে। যদিও আলি তাঁদের কোনও কথাই বিশ্বাস করতে নারাজ ছিলেন, এবং সেইসময় এই ঘটনার সত্যতা যাচাই করার জন্য তিনি কোর্টে হাজির হয়েছিলেন। তিনি এই কথাও জানান যে, ফরেনসিক বিশেষজ্ঞদের মতে নথিতে থাকা সইটি ছিল একটি জাল সই। এছাড়াও মেহমুদ এই সম্পত্তির ৮৭ একর জমি তাঁর ছয় ছেলে ও একজন মেয়ের মধ্যে ভাগ করে দেওয়ার জন্য মোট চারটি ট্রাস্ট গঠন করেছিলেন। এই প্রসঙ্গ টেনে নিয়েও গায়ক যুক্তি দেখিয়ে বলেছিলেন, সুপ্রিম কোর্টের রায় অনুসারে আদালতের অনুমোদন ছাড়া ট্রাস্টের সম্পত্তি বিক্রি করা কার্যত বেআইনি।

২০১৫ সালের একটি রিপোর্ট থেকে জানা যায়, লাকি আলি প্রথম থেকেই এইচ জাসান্ত সেনয় নামে এক নির্মাণ সংস্থার মালিকের বিরুদ্ধে ইয়েলাহাঙ্কা গ্রামে তাঁদের পৈতৃক সম্পত্তির ১৬৫ একর জমি দখল করে রাখার কথা জানিয়েছিলেন। কিন্তু আলির পরিবারের সদস্যরা জানান, তাঁরা এই উক্তিকে সমর্থন করেন না। বরং মিডিয়ার সামনে তাঁরা গায়কের জমি জবরদখলের কথাটিকে পুরোপুরি ভিত্তিহীন বলেই ঘোষণা করেছিলেন। তাঁরা সেই সময় জানিয়েছিলেন, গ্রিন অরচার্ডস ফার্মহাউসই জমির আসল মালিক এবং জমির মালিকের বিরুদ্ধে তাঁদের কোন অভিযোগ নেই।

ঘটনার মোড় ঘোরে ২০১৪ সালে নভেম্বর মাসে। এই সময় ইয়েলাহাঙ্কার কাছে অবস্থিত গায়কের বাড়িতে সশস্ত্র গুন্ডাবাহিনী হামলা চালায়। কিন্তু সেই সময় তিনি একটি কনসার্টের কারণে দিল্লিতে ছিলেন। আলি আশঙ্কা করেছিলেন, সম্ভবত তাঁকে হত্যার উদ্দেশ্য নিয়েই সেইদিন গুন্ডাবাহিনী তাঁর বাড়িতে হানা দেয়। এই ঘটনার প্রেক্ষিতে পুলিশ আট জনকে সেইসময় গ্রেপ্তারও করেছিল। খুব স্বাভাবিকভাবেই গুন্ডাবাহিনী পাঠানোর পিছনে নাম জড়িয়ে পরে সেই নির্মাণ সংস্থার মালিকের। এই ঘটনার পরে আলি পুলিশের কাছে নির্মাতা, নির্মাতার ভাইয়ের সঙ্গে সন্দেহভাজন আরও তিনজনের নামে অভিযোগ জমা দিয়েছিলেন। যদিও সেই সময় পুলিশ গায়ককে যথাসম্ভব সাহায্য করেছিল এবং বাড়তি সুরক্ষাবাহিনী প্রদানের আশ্বাসও দিয়েছিল। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে বসবাসকারী লাকি আলির ভাইবোনরা এরপর আবার একবারের জন্য জমি মামলায় সাক্ষী দেওয়ার কারণে দেশে ফেরার কথা বললেও, পরবর্তীতে তাঁরা আর আসেননি।

সেই সময় থেকে আজ অবধি এই জমি সমস্যার কোনও সমাধান হয়নি। তাই হয়তো গায়ক খানিক ক্লান্ত হয়েই সমস্ত রাগ, অভিমান উগরে দিয়ে সোশ্যাল মিডিয়ায় পোস্টটি করেন। সত্য ঘটনা কী, তা একমাত্র সঠিক তদন্ত দ্বারাই বোঝা সম্ভব।

 

 

 

 

 

More Articles