শ্রীলঙ্কার সংকটে বন্ধু ভারত, কীভাবে দেউলিয়া প্রতিবেশীকে সাহায্য করছে মোদি সরকার?
সমস্যা ছিল শ্রীলঙ্কাকে সাহায্যের ক্ষেত্রে। তামিলদের স্বার্থের কথা ভেবে এবং পরবর্তী সময় শ্রীলঙ্কার সুবিধার কথা ভেবে ভারত দ্বিপাক্ষিক সম্পর্ককে আরও মজবুত করার দিকে নজর দিয়েছে।
১৯৪৮ সালে ব্রিটেন থেকে স্বাধীনতা লাভের পর শ্রীলঙ্কা সবচেয়ে খারাপ অর্থনৈতিক পরিস্থিতির মধ্য দিয়ে যাচ্ছে। বেশ কিছুদিন ধরে ধুঁকছে এই দেশটির অর্থনীতি। সম্প্রতি নিত্যপ্রয়োজনীয় জিনিস ও জ্বালানির সংকটের কারণে দেশজুড়ে অরাজক পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়েছে। খাবারের দাম আকাশছোঁয়া। অনেক সময় শ্রীলঙ্কার বাসিন্দারা একবেলা খেয়ে দিন কাটাচ্ছেন। চরম সংকটে শ্রীলঙ্কার প্রেসিডেন্ট গোতাবায়া রাজাপক্ষে ও প্রধানমন্ত্রী রনিল বিক্রমাসিং পদত্যাগ করবেন বলে জানিয়েছেন। শ্রীলঙ্কার চরম সংকটে পাশে থাকার আশ্বাস দিয়েছে ভারতের বিদেশ মন্ত্রক। ভারত শ্রীলঙ্কার এই চরম সংকটে ইতিমধ্যে ৩.৮ বিলিয়ন মার্কিন ডলারের বেশি সাহায্য করেছে বলে বিদেশ মন্ত্রক জানিয়েছে। এই প্রথম শ্রীলঙ্কা নিয়ে কোনও বিবৃতি দিল ভারত।
ভারতের পাশে থাকার বার্তা
ভারতের পাশে থাকার বার্তা দিয়ে বিদেশ মন্ত্রকের মুখপাত্র অরিন্দম বাগচী জানিয়েছেন, "শ্রীলঙ্কার সরকার ও সাধারণ মানুষ প্রতিকূল অবস্থার মধ্য দিয়ে যাচ্ছে। আমরা সেই দিকে নজর রাখছি। ভারত ইতিমধ্যেই শ্রীলঙ্কার জনগণের পাশে দাঁড়িয়েছে। ইতিমধ্যে ভারত শ্রীলঙ্কাকে ৩.৮ বিলিয়ন মার্কিন ডলারের বেশি সাহায্য করেছে।‘’
বিদেশ মন্ত্রকের মুখপাত্র বিবৃতি দিয়ে এও জানান, "শ্রীলঙ্কা নিকটতম প্রতিবেশী। দুই দেশের বন্ধন নিবিড়। শ্রীলঙ্কা আমাদের প্রতিবেশী দেশের অগ্রাধিকার নীতির মধ্যে পড়ে। চলতি বছরে ভারত দ্বীপরাষ্ট্রকে ৩৮০ কোটি টাকার আর্থিক সহায়তা দিয়েছে, যাতে তারা চলতি আর্থিক পরিস্থিতির মোকাবিলা করতে পারে।"
আরও পড়ুন: চরমে কাগজ সংকট, বই নেই পড়ুয়াদের! পাকিস্তান এগোচ্ছে শ্রীলঙ্কার পথেই?
এদিকে শ্রীলঙ্কার বর্তমান পরিস্থিতি নিয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করে সেখানকার মানুষকে সমবেদনা জানিয়েছেন কংগ্রেস সভানেত্রী সোনিয়া গান্ধী। শ্রীলঙ্কাকে সাহায্যের জন্য আন্তর্জাতিক মহলের কাছে আবেদন জানিয়েছেন তিনি।
বর্তমান পরিস্থিতি
সরকারে রদবদল ঘটিয়ে রোষ সামাল দেওয়ার চেষ্টা করা হয়েছিল বটে, তারপর ২ মাসও কাটল না। ফের গণবিক্ষোভে উত্তাল শ্রীলঙ্কা। রাস্তার মোড়ে মোড়ে জনসমুদ্র উপচে পড়েছে। সনৎ জয়সূর্যর মতো তারকাও তাতে শামিল হয়েছেন। অর্থনৈতিক সংকট কাটিয়ে উঠতে এই মুহূর্তে আন্তর্জাতিক অর্থভাণ্ডারের সঙ্গে কথা চলছে কলম্বোর। সেখান থেকে অর্থসাহায্য নিয়ে আপাতত খাদ্য-সহ নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্য যাতে আমদানি করা যায়, তার চেষ্টা চলছে। কিন্তু ঋণ নেওয়ার ক্ষেত্রে দেখানোর জন্য যথেষ্ট পরিমাণ বিদেশি মুদ্রা সঞ্চিত নেই কোষাগারে। তার জেরে দিনতিনেক আগে শ্রীলঙ্কাকে দেউলিয়া ঘোষণা করেন প্রধানমন্ত্রী রনিল বিক্রমাসিং। তারপরই ফের ফুঁসছে শ্রীলঙ্কা। গত কয়েক দিন ধরে গণবিক্ষোভ শুরু হয়েছে সেখানে। তবে শনিবার কার্যত জনসমুদ্র নেমে আসে কলম্বোর রাস্তায়। বাস, ট্রেন, লরিতে চেপে লক্ষ লক্ষ মানুষ রাজধানীতে এসে পৌঁছন। জাতীয় পতাকা গায়ে জড়িয়ে সরকার-বিরোধী স্লোগান দেন তাঁরা। প্রেসিডেন্ট গোতাবায়া রাজাপক্ষে-র ইস্তফার দাবি ওঠে। সিঁদুরে মেঘ দেখে একদিন আগেই প্রেসিডেন্টের বাসভবন ছেড়ে কার্যত পালিয়ে যান তিনি। বিক্ষোভে যোগ দিয়েছে পুলিশ, সেনাকর্তা ও সৈনিকদের একাংশ।
বন্ধুতার হাত
অনেকদিন ধরেই অর্থসংকটে ভুগছে শ্রীলঙ্কা। ভারত আগেও জাহাজবোঝাই খাদ্যশস্য পাঠিয়েছে। শ্রীলঙ্কার এই দুর্দিনে মুখ ফিরিয়ে থাকা নয়, বরং সম্পর্ক আরও জোরদার করার চেষ্টা চালাচ্ছে ভারত। শ্রীলঙ্কার সঙ্গে বাণিজ্যিক সম্পর্কের ক্ষেত্রে ভারতকে টপকে গেছে চিন। এখনও নতুন করে দ্বীপরাষ্ট্রের সঙ্গে সম্পর্ক জোরালো করার সম্ভাবনা দেখছে পররাষ্ট্র মন্ত্রক।
সহিংস আন্দোলনের মধ্য দিয়ে নতুন প্রধানমন্ত্রী হিসেবে দায়িত্ব নেন রনিল বিক্রমাসিং। দায়িত্ব গ্রহণের পরই ভারত-সহ আন্তর্জাতিক বিভিন্ন সংস্থার কাছে সহায়তা চেয়েছেন নতুন প্রধানমন্ত্রী। এতদিন চিনের সঙ্গে শ্রীলঙ্কার বড় অঙ্কের ঋণচুক্তি থাকলেও বর্তমানে অর্থনৈতিক সংকটের পরিস্থিতিতে ধীরে ধীরে সবচেয়ে বড় সাহায্যকারী দেশ হিসেবে নিজের অবস্থান জোরালো করেছে নয়া দিল্লি।
জ্বালানির মতো আবশ্যিক পণ্য আমদানি ব্যয় পরিশোধের জন্য দেশটি তিন বিলিয়ন ডলারের জরুরি ঋণও চেয়েছে। বিশ্ব ব্যাঙ্ক ৬০০ মিলিয়ন ডলার দিতে রাজি হয়েছে। এই অবস্থায় ভারত ১.৯ বিলিয়ন ডলার দেওয়ার প্রতিশ্রুতি দিয়েছে। আমদানির জন্য অতিরিক্ত আরও ১.৫ বিলিয়ন ডলারও ধার দিতে পারে ভারত।
এদিক ভারত ইতিমধ্যে ৬৫ হাজার টন সার ও ৪ লাখ টন জ্বালানি পাঠিয়েছে শ্রীলঙ্কায়। আরও চিকিৎসার সরঞ্জাম পাঠানোর অঙ্গীকার করেছে নয়াদিল্লি।
পুরনো সম্পর্ক
কয়েক শতক ধরে শ্রীলঙ্কার প্রায় অভিভাবকের ভূমিকা পালন করে আসছে ভারত। যতই এই সেতু নিয়ে বিতর্ক থাক, বলা হয়, ভারতের সঙ্গে প্রতিবেশী দেশের সম্পর্ক সেই রাম সেতুর সময় থেকে। দেশের ১২ শতাংশ তামিল জনগণ এবং ভারতের শান্তিরক্ষা বাহিনীর বলিদান দুই দেশের ঐক্য ও অখণ্ডতা আরও সুদৃঢ় করেছে। শ্রীলঙ্কার প্রেসিডেন্ট মাহিন্দা রাজাপক্ষের নির্বাচনের সময় ২০০৫ সালে কলম্বো বেজিংয়ের দিকে ঝুঁকে পড়েছিল।
সম্প্রতি শ্রীলঙ্কার প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে মাহিন্দা রাজাপক্ষের ভাই গোতাবায়ার জয়ের ফলে দিল্লি-কলম্বো সম্পর্ক নয়া মোড় নেয়। সম্পর্কের জমিটাকে ফের মজবুত করার তাগিদে প্রেসিডেন্ট পদে গোতাবায়ার শপথ নেওয়ার পরদিনই বিদেশমন্ত্রী জয়শঙ্করকে শ্রীলঙ্কা পাঠান প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি। জয়শঙ্করের মাধ্যমে শ্রীলঙ্কার প্রেসিডেন্টকে ভারত সফরের জন্য আমন্ত্রণ জানান মোদি। আমন্ত্রণ রক্ষা করেন সদ্য-নির্বাচিত প্রেসিডেন্ট। তিনি ভারত সফর করেন। প্রেসিডেন্ট গোতাবায়ার সঙ্গে মূলত রাজনৈতিক বিষয় নিয়ে কথা বলেন মোদি। গোতাবায়া স্পষ্ট করেন, ভারতের নিরাপত্তা বিঘ্নিত হয়, এমন কোনও পদক্ষেপ করবে না শ্রীলঙ্কা। চিনের বিকল্প হিসেবে ভারত এবং অন্যান্য দেশের বিনিয়োগের বিষয়টি নিয়েও কথা হয়। বর্তমান পরিস্থিতিতে ভারত সন্ত্রাস দমনে ৩৬০ কোটি এবং অন্যান্য ঋণ হিসেবে ২৮৭০ কোটি টাকা দেওয়ার কথা ঘোষণা করে। এই অনুদান যে দুই দেশের পুরনো সম্পর্ককে অন্য মাত্রা দেয়, তা বলাই বাহুল্য।
এখন শ্রীলঙ্কায় চরম অরাজকতা। কিন্তু বেশ কিছুদিন ধরেই শ্রীলঙ্কায় বিনিয়োগের ক্ষেত্রে ভারতের সমস্যা ছিল। সমস্যা ছিল শ্রীলঙ্কাকে সাহায্যের ক্ষেত্রেও। সে যাই হোক, তামিলদের স্বার্থের কথা ভেবে এবং পরবর্তী সময় শ্রীলঙ্কার সুবিধার কথা ভেবে ভারত দ্বিপাক্ষিক সম্পর্ককে আরও মজবুত করার দিকে নজর দিয়েছে। এই সংকটেও ভারত প্রতিবেশী দেশের জনগণের হাত ছাড়েনি।