খাদে গাড়ি, ভাঙা মেরুদণ্ড! তবু স্বপ্ন দেখাচ্ছেন ভারতের প্রথম হুইলচেয়ার ডিজে

India's First Wheel Chair DJ: ২০১৪ সালের ওই দুর্ঘটনা বরুণকে আজীবনের জন্য হুইলচেয়ারে বন্দি করেছে। কিন্তু বরুণ খাঁচা ভেঙেছেন। প্রতিবন্ধকতাকে সক্ষমতায় পালটেছেন।

সাল ২০১৪। বন্ধুদের সঙ্গে মানালি ট্রিপ! হইহই আনন্দের মাঝে ঘটে গিয়েছিল মারাত্মক দুর্ঘটনা। খাদে গাড়ি পড়ে গিয়ে থেঁতলে যায় একটা দিক! বন্ধুদের অনেকেই সুস্থ শরীরে ফিরে এলেও বরুণের জীবন আর কখনই সহজ হলো না। বীভৎস ওই দুর্ঘটনার পরে তাঁকে দ্রুত চিকিৎসার জন্য দিল্লিতে নিয়ে আসা হয়, সেখানে তাঁর অপারেশন হয়। তিন দিন পর যখন জ্ঞান ফেরে বরুণের, বুঝতে পারেন পা নড়ছে না। ডাক্তারকে জিজ্ঞাসা করলেন। উত্তরে যা বললেন চিকিৎসক সমস্ত ইচ্ছা-ভালোবাসা-স্বপ্ন ভেঙে দেওয়ার জন্য তা যথেষ্ট! চিকিৎসক জানালেন, আর কখনই হাঁটতে পারবেন না বরুণ। মেরুদণ্ডের একটি কর্ড ভেঙে গিয়েছে, কোমরের নিচের অংশ তাই সম্পূর্ণ অবশ। হতভম্ব বরুণ মায়ের দিকে ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়েছিলেন। মা কেঁদে চলেছেন অঝোরে। জীবনের এই দুর্ঘটনার পর থেকে লড়াই করে চলেছেন বরুণ। হাঁটতে পারেন না ঠিকই। তবে দুনিয়াকে নাচাতে পারেন। ভারতের একমাত্র হুইলচেয়ার ডিজে বরুণ এখন অনুপ্রেরণার ডাকনাম।

ডিজে-জগতে অবশ্য বরুণ খুল্লার পরিচিত আমিশ আন্ডারগ্রাউন্ড নামেই। গতানুগতিক ভাবে চলা সহজ। স্বাভাবিক পথ, স্বাভাবিক গতি, স্বাভাবিক যাপন- সহজ। কিন্তু প্রতিকূল স্রোতে নদী পার হওয়ার চেষ্টা করাটাই বিপজ্জনক। নিজেকে ভাঙতে হয়, শূন্য থেকে শুরুর আজব খেলায় নিজেকে রোজ হারতে হয়। ২০১৪ সালের ওই দুর্ঘটনা বরুণকে আজীবনের জন্য হুইলচেয়ারে বন্দি করেছে। কিন্তু বরুণ খাঁচা ভেঙেছেন। প্রতিবন্ধকতাকে সক্ষমতায় পালটেছেন। ভারতের প্রথম বিশেষভাবে সক্ষম ডিজে তিনি। ২০১৭ সালের ডিসেম্বরে জেসন ডেরুলো, উইজ খলিফা এবং মার্টিন গ্যারিক্সের মতো আন্তর্জাতিক ব্যক্তিত্বদের উপস্থিতিতে বহু-ধারার সঙ্গীত উত্সব 'টাইম আউট ৭২' শুরু করেন বরুণ।

“আমার মায়ের কথা আমাকে শক্তি জুগিয়েছে এবং আমি সিদ্ধান্ত নিই যে, আমি যখন বেঁচে আছি জীবনকে সেরাটাই দেব। ডিজে হওয়া আমার সত্যিকারের ইচ্ছা ছিল এবং আজ আমি বলতে পারি এটিই একমাত্র আবেগ যার জন্য আমি বেঁচে আছি। তাই ফিজিওথেরাপির পাশাপাশি দুই বছর ধরে ইউটিউব ভিডিও দেখে এবং বই পড়ে নিজে থেকেই মিউজিক প্রোডাকশন শেখা শুরু করি। আমার স্বপ্ন আমাকে কখনই বিষণ্ণতার গর্তে তলিয়ে যেতে দেয়নি। আমার এখনও মনে আছে আমার বিছানায় শুয়ে থাকার দিনগুলো, প্রায় ২ বছর ধরে সূর্যাস্ত দেখিনি। শুধু গান শেখা শুরু করি। অক্লান্ত পরিশ্রমের ফল পাওয়া যায়। গানের সঙ্গে সঙ্গেই আমি গাড়ি চালানো শিখেছি এবং নিজে থেকেই এখন বিভিন্ন জায়গায় ঘুরতে শুরু করেছি”, দ্য ট্রাইবাল বক্সকে বলেছিলেন বরুণ।

আরও পড়ুন- আকাশ ছোঁয়ার স্বপ্ন! পথ দেখাচ্ছেন ভারতের প্রথম রূপান্তরকামী ড্রোন পাইলট

গান শেখাতেই থেমে যাননি বরুণ। ভারতের সেরা ডিজে স্কুলগুলিতে পড়াশোনার আবেদন করেন। কিন্তু হুইলচেয়ারে ডিজে! আবেদন নাকচ হয়ে যায় অধিকাংশ ক্ষেত্রেই। হাল ছাড়েননি বরুণ। গুরগাঁওয়ের একটি আকাডেমি বরুণের আবেগকে যত্ন করে ঠাঁই দেয়। তবে শুধু শিখলেই তো হল না, কাজ চাই! কাজের জন্য আবেদন করেছিলেন বরুণ নানা জায়গাতেই। কিন্তু সেই একই প্রশ্নে এসে গোঁত্তা খায়। হুইলচেয়ারে ডিজে! হুইলচেয়ার দিয়েই দীর্ঘকাল মাপা হয়েছে বরুণের যোগ্যতা, ক্ষমতা। "আমি যে অন্য ডিজেদের থেকে আলাদা নই তা বোঝানোটাই বড় চ্যালেঞ্জ ছিল। আমি সবসময় বলতাম আমার কাজ এবং আমার গানের ভিত্তিতে আমাকে বিচার করুন বা সমালোচনা করুন, আমার হুইলচেয়ারের ভিত্তিতে নয়। আমি হুইলচেয়ারে আছি বলে আমাকে কাজ দেবেন না প্লিজ, যদি আমার গান পছন্দ করেন তবেই আমাকে কাজ দিন," জানিয়েছিলেন বরুণ। ৫-৬ মাস এভাবে চলার পরে, দিল্লির একটি ক্লাব তাঁর কাজের ভিত্তিতেই নিয়োগ করে বরুণকে।

বর্তমানে বরুণ একজন বিখ্যাত এবং স্বনামধন্য ডিজে যিনি টাইমআউট ৭২ (গোয়া) এবং গ্রীশম উৎসবের (দিল্লি টুরিজম) মতো সঙ্গীত উৎসবে অংশ নিয়েছেন। বিভিন্ন ক্লাব এবং পাব এখন নিজে থেকেই তাঁর কাছে কাজের প্রস্তাব নিয়ে আসে। কলেজ জীবন থেকে স্নাতকোত্তর পর্যন্ত, বন্ধুদের পার্টির জন্য রেকর্ড তৈরি করতেন বরুণ। অ্যামিটি থেকে মাস কমিউনিকেশনে স্নাতকোত্তর পড়ার সময়ই, ডিজে হবেন বলে ঠিক করেছিলেন তিনি। দক্ষিণ দিল্লির সাউন্ডস অফ সোল নামের একটি ডিজে স্কুলে যোগও দিয়েছিলেন৷ মাঝে ২০১৪-র সেই দিনটি না এলে হয়তো এভাবেই এগিয়ে যেতে পারতেন, সহজে। প্রতিকূলতা মানুষকে ভাঙে, গড়েও। যেমন নিজেকে গড়ে তুলেছেন বরুণ। হুইলচেয়ারের ঊর্ধ্বে তাঁর সঙ্গীত এখন লাখো মানুষের পায়ে তাল জোগায়, মনে আশাও।

 

More Articles