যাত্রা শেষ ইন্টারনেট এক্সপ্লোরারের, মুছে গেল কয়েক দশকের স্মৃতি

১৯৯৫ সালের ১৬ আগস্ট ৯৫টি ভাষায় জন্ম এই ব্রাউজারের। কার্যত সেই সময় ব্রাউজার বলতে সকলেই একে বুঝত। ইন্টারনেট ব্যবহারকারী প্রথম প্রজন্মের স্মৃতিজুড়ে তাই স্থায়ী অবস্থান তার।

১৯৯৫ সালের সকাল। কচিকাঁচারা কেউ স্কুল যেতে ব্যস্ত, কেউ বা আবার পাড়ার মাস্টারের কাছে পড়তে যাচ্ছে ঝাঁক বেঁধে। পাড়ার চায়ের দোকান রাজনীতির খবরে সরগরম, চায়ে পে চর্চা চলছে, তখন তো আর করোনার ভয় ছিল না। সবাই নিজের দৈনন্দিন কাজ করছে আপন তালে। বইমুখো মানুষ তখনও কম্পিউটারের দাস হয়ে ওঠেনি। বা বলা ভালো, সকল মানুষের কাছে সেই কম্পিউটার কেনার মতো সাধ ও সাধ্য ছিল না। সেই নয়ের দশকে মানুষ যখন কম্পিউটার কী, তার কাজ কী, সেইসব জানার চেষ্টা চালাচ্ছে- সেই সময় নতুন এক ঝড় উঠল, ইন্টারনেট পরিষেবা।

ইন্টারনেট ১৯৬৯ সালে বিশ্বে চালু হলেও ভারতে আসতে সময় লেগেছিল। ১৯৯৫ সালে প্রথমবার দেশে 'ভারত সঞ্চার নিগম লিমিটেড'-এর (BSNL) সৌজন্যে ইন্টারনেটের কমার্শিয়াল ব্যবহার শুরু হয়। শুরুর দিকে ইন্টারনেট মানেই ছিল বিরাট ব্যাপার, ৯.৬ কেবিপিএস ইন্টারনেটের জন্য দিতে হতো প্রায় ২.৫ লাখ টাকা।

নয়ের দশকে ইন্টারনেট ব্যবহারে প্রয়োজনের চেয়েও বিলাসিতার তকমা ছিল বেশি। ইন্টারনেট ব্যবহার করতে শেখা, বুকমার্ক করা, প্রথম ইমেল অ্যাকাউন্ট খোলা– নেটদুনিয়ায় হাতেখড়ি হয়েছিল একটা ব্রাউজারের হাত ধরেই। টেক জায়েন্ট মাইক্রোসফটের হাত ধরে গুটি গুটি পায়ে এসে পৌঁছেছিল ‘ইন্টারনেট এক্সপ্লোরার’ ওয়েব ব্রাউজার। ১৯৯৫ সালের ১৬ আগস্ট ৯৫টি ভাষায় জন্ম এই ব্রাউজারের। কার্যত সেই সময় ব্রাউজার বলতে সকলেই একে বুঝত। ইন্টারনেট ব্যবহারকারী প্রথম প্রজন্মের স্মৃতিজুড়ে তাই স্থায়ী অবস্থান তার। নড়বড়ে মাউজ হাতে ইন্টারনেট এক্সপ্লোরারই হয়তো প্রথম মানুষকে বইমুখো থেকে ওয়েবমুখো করেছে।

আরও পড়ুন: কোথায় হারিয়ে গেল বাংলার কার্টুন সংস্কৃতি?

উইন্ডোজ ৯৫-এর সঙ্গে যুক্ত হয়ে প্রথম ব্রাউজার হিসেবে আত্মপ্রকাশ করে আইই বা ইন্টারনেট এক্সপ্লোরার। প্রথমে যখন আই.ই (ইন্টারনেট এক্সপ্লোরার) বাজারে ছাড়া হয়, তখন এটিকে কিনতে হতো। কিন্তু মাইক্রোসফট কর্পোরেশন ব্রাউজারের বাজারে নিজের আধিপত্য বিস্তারের লক্ষ্যে নতুন মার্কেটিং স্ট্র‍্যাটেজি ঠিক করে। যার পরিপ্রেক্ষিতে আই.ই-কে উইন্ডোজ অপারেটিং সিস্টেমের সঙ্গে বিনামূল্যে জুড়ে দেওয়া হয়। আর এর পর থেকেই শুরু হয় আই.ই-র উত্থান। এই ব্রাউজার উন্মোচনের পরই তা তৎকালীন ইন্টারনেট ব্রাউজার 'নেটস্কেপ'-কে বাজারছাড়া করে।

এক্সপ্লোরারের বিভিন্ন ভার্সন
১৯৯৫-২০১৩ সালের মধ্যে ইন্টারনেট এক্সপ্লোরারের মোট ১১টি ভার্সান রিলিজ করেছিল মাইক্রোসফট।

IE 2.0 এবং IE 1.0: এগুলো ১৯৯৫ সালে প্রথম প্রকাশিত হয়।
IE 3.0: ১৯৯৬ সালে প্রকাশিত হয়েছিল।
IE 4.0: প্রকাশিত হয়েছিল ১৯৯৭ সালে। এটি সিএসএস এবং ডোম (DOM) সমর্থন বা সাপোর্ট করত।

IE 5.0: ১৯৯৯ সালে প্রকাশিত হয়, প্রথম বড় ব্রাউজার যা এক্সএমএল সমর্থন বা Support করে।

IE 5.5: প্রকাশিত হয়েছিল ২০০০ সালে‌। এই ভার্সন এক্সএমএল/এক্সএসএল, সিএসএস ইত্যাদি সমর্থন বা Support করত।

IE 6.0: ২০০১ সালে প্রকাশিত হয়েছিল। এটি ছিল উইন্ডোজ এক্সপি-র স্ট্যান্ডার্ড ব্রাউজার।

IE 7.0: ভার্সনটি প্রকাশ হয় নভেম্বর, ২০০৬ সালে। এটি ছিল সার্ভিস প্যাক ২-এর সঙ্গে উইন্ডোজ এক্সপি-র স্ট্যান্ডার্ড ব্রাউজার। Advanced printing, Instant Search box, RSS feeds, Tabbed browsing ইত্যাদি নতুন সুবিধা যুক্ত করা হয় এক্ষেত্রে।

IE 8.0: মাইক্রোসফট এটি প্রকাশ করে মার্চ, ২০০৯ সালে। এতে যুক্ত করা হয় Accelerators, Web Slice, Compatibility View, SmartScreen Filter ইত্যাদি। ইন্টারনেট এক্সপ্লোরারের এই ভার্সনটি সম্পূর্ণরূপে সিএসএস ২.১ সমর্থন করে।

IE 9.0: মাইক্রোসফট এটি প্রকাশ করে মার্চ, ২০১১ সালে। এতে যেসব নতুন সুবিধা যুক্ত করা হয়, সেগুলো হলো- Unified Address Bar, Pin Websites To Windows 7 Taskbar, Revamped Interface, এইচটিএমএল৫ সমর্থন ইত্যাদি।

এর মাঝে ২০০৪ সালে বাজারে নতুনভাবে আসে ফায়ারফক্স ব্রাউজার, যার আর্বিভাবের পর থেকেই ইন্টারনেট এক্সপ্লোরারের জনপ্রিয়তায় ভাটা পড়ে। তারপর ২০০৮ সালে আসে গুগল ক্রোম। ইন্টারনেট এক্সপ্লোরারের কাছে তা যেন ‘গোদের ওপর বিষফোড়া’-র মতো অবস্থা হয়েছিল। Google Chrome, UC Browser, Firefox, Operamini-র মতো প্রতিযোগীদের সংখ্যা বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে ইউজারদের কাছে জনপ্রিয়তা হারাতে থাকে IE। সময়ের সঙ্গে সঙ্গে আপডেটেড টেকনোলজি ইন্টারনেট এক্সপ্লোরারে সাপোর্ট না করায় অন্যান্য ব্রাউজার বরাবরই একে টেক্কা দিয়ে এসেছে। মাইক্রোসফট নানাভাবে চেষ্টা করে IE-কে আগের মতো জনপ্রিয় করে তুলতে, কিন্তু তা আর ধোপে টেকেনি। ধীরে ধীরে পিছিয়ে পড়তে থাকে IE।

IE-র এতগুলো ভার্সন বাজারে এলেও তাদের কিছু দুর্বলতা লক্ষ্য করা যায়, যেমন– IE-তে কোনও অ্যাড ব্লকের অপশন ছিল না, এবং IE 7-এর নতুন সংস্করণের পর থেকেই এই ব্রাউজারটি ধীর গতির হতে শুরু করে। বাগিং-এর সমস্যা দেখা দেয়, হ্যাকারদের কাছে এই ব্রাউজারটি হ্যাক করা সহজলভ্য হয়ে ওঠে। এর নিরাপত্তা ব্যবস্থারও অবনতি হতে থাকে। প্লাগ ইনের অভাবও দেখা যেতে শুরু করে। এটা সত্যি যে, আই-ই ৭, ফায়ারফক্সের আগ্রাসন বন্ধ করার জন্যই মাইক্রোসফটের পক্ষ থেকে পাল্টা জবাব, কিন্তু অনেকেরই ধারণা, ফায়ারফক্সের গ্রোথ রেটের কাছে আই-ই ৭ শেষ পর্যন্ত টিকতে পারেনি। ২০১৩-তে শেষবারের মতো নতুনভাবে IE রিলিজ হলেও এরপর থেকে IE-র আর কোনও নতুন আপডেট আসেনি।

গুঞ্জন, জল্পনা শোনা যাচ্ছিল অনেকদিন থেকেই, তুলে নেওয়া হবে প্রাচীন IE-কে। কফিনে পেরেক তখন পড়ল, যখন ২০১৫ সালে নতুন ব্রাউজার ‘Edge’ বাজারে আনে মাইক্রোসফট। তখন থেকেই ইন্টারনেট এক্সপ্লোরার বন্ধ করে দিয়ে নতুন ব্রাউজারটির ওপর বাড়তি মনোযোগ দিতে শুরু করেছিল আমেরিকার এই সংস্থাটি। ২০২০ সালে মাইক্রোসফট টিম ইন্টারনেট এক্সপ্লোরার সাপোর্ট বন্ধ করেছিল। ২০২১-এ মাইক্রোসফট ৩৬৫ থেকে ইন্টারনেট এক্সপ্লোরার সাপোর্ট বন্ধ করা হয়। সম্প্রতি প্রকাশিত রিপোর্ট অনুযায়ী ১৫ জুন, ২০২২ থেকে পুরোপুরি বন্ধ হয়ে যাচ্ছে ২৭ বছরের বৃদ্ধ IE।

গত কয়েকবছর একেবারে গুরুত্বহীন হয়েই ছিল একসময়ের জনপ্রিয় এই ব্রাউজার। ফলে বহু গ্রাহকের মন জয় করা এক্সপ্লোরারের মৃত্যুঘণ্টা বাজা প্রায় নিশ্চিতই হয়ে পড়েছিল। শুরু হয়েছিল IE-কে নিয়ে মিম বানানো, IE হয়ে উঠেছিল এক হাসির খোরাক। মাইক্রোসফট সূত্রে জানা যাচ্ছে, ব্রাউজার ‘মাইক্রোসফট এজ’-কে আরও বেশি করে গ্রাহকদের কাছে তুলে ধরতেই ‘ইন্টারনেট এক্সপ্লোরার’-কে অন্তিম বিদায় জানানোর সিদ্ধান্ত নিয়েছে তারা। শন লিন্ডারসে জানিয়েছেন, “Microsoft Edge-এর মধ্যেই রয়েছে Internet Explorer mode (IE Mode)। ফলে সব লেগাসি ওয়েবসাইট সরাসরি Microsoft Edge ব্রাউজার ব্যবহার করে খোলা যাবে। Microsoft Edge-এ এই সাপোর্ট আসার পরে ১৫ জুন থেকে Windows 10-এর কিছু ভার্সনে Internet Explorer 11 সাপোর্ট বন্ধ করবে Microsoft। Microsoft Edge শুধু একটি দ্রুত গতির ব্রাউজার নয়, এটি অনেক সুরক্ষিত ও একটি আধুনিক ব্রাউজার। যেসব পুরনো ওয়েবসাইট আগে শুধু Internet Explorer ব্যবহার করেই খুলত, এখন Microsoft Edge ব্যবহার করেও সেইসব লেগাসি ওয়েবসাইট ওপেন করা যাবে,” বলেন তিনি। পরিসংখ্যান বলছে, বিশ্বে ডেক্সটপ ব্রাউজার ব্যবহারকারীদের ৬৫ শতাংশই গুগল ক্রোম ব্যবহার করেন। অন্যদিকে ইন্টারনেট এক্সপ্লোরার ব্যবহার করেন মাত্র ২ শতাংশ মানুষ। অন্যদিকে মাইক্রোসফটেরই অপেক্ষাকৃত নতুন ব্রাউজার এজ ব্যবহার করেন ৮ শতাংশ ডেক্সটপ ব্রাউজার ব্যবহারকারী।

নয়ের দশক ও শূন্য দশকে যারা বাড়ি, স্কুল অথবা অফিস থেকে কম্পিউটারের মাধ্যমে ইন্টারনেট ব্যবহার করত, তাদের সকলেরই Internet Explorer-এর সঙ্গে অনেক স্মৃতি জড়িয়ে রয়েছে। চিঠি চালাচালি বাদ দিয়ে তখন শুরু হয়েছিল ইন্টারনেট চ্যাট বা মেলের যুগ। নয়ের দশকের মানুষের কাছে IE ছিল স্বপ্নের মতো। সেই সময় যাঁরা ইন্টারনেট ব্যবহার করতেন, তাঁদের কাছে IE ছিল একমাত্র বন্ধুর মতোই। কত স্মৃতি জড়িয়ে রয়েছে এই ইন্টারনেট এক্সপ্লোরারের সঙ্গে। ২০০৩ সালে সাফল্যের শিখরে পৌঁছেছিল Internet Explorer। সেই সময় বিশ্বব্যাপী ব্যবহৃত সব ইন্টারনেট ব্রাউজারের 95 শতাংশ Internet Explorer ধরে রেখেছিল। সেই সময়ের মানুষদের কত বন্ধুত্ব, প্রেম-ভালবাসার সাক্ষী এই ওয়েব ব্রাউজার। সময়ের বিবর্তনে যা বিলুপ্ত। যেভাবে চিরকালীন নিয়মে পুরনোকে জায়গা ছেড়ে দিতে হয় নবীনকে, সেই কালের নিয়ম এবার খেটে গেল এক্সপ্লোরারের ক্ষেত্রেও।

 

More Articles