টাকা সুরক্ষিত থাকবে, আসবে মোটা অঙ্কের সুদ, ডেট ফান্ড সম্পর্কে আজই জানুন

আপনি যদি ইকুইটি মিউচুয়াল ফান্ড এবং ডেট ফান্ডের মধ্যে সঠিক বিকল্প বেছে নিতে অপারগ থাকেন, তাহলে অবশ্যই ডেট ফান্ডে টাকা বিনিয়োগ করুন।

রিজার্ভ ব্যাঙ্কের দ্বারা রেপো রেট বৃদ্ধি করার পরেই ধীরে ধীরে সারা দেশে বাড়তে শুরু করেছে বিভিন্ন সুদের হার। আর এই রেপো রেট বৃদ্ধির পরেই নতুন করে খবরে উঠে এসেছে ডেট ফান্ড বা মিউচুয়াল ফান্ডের ঋণ তহবিল। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, যদি আপনারা ধীরে ধীরে ইনভেস্টমেন্ট করে একটা নিয়মিত আয় করতে চান, তাহলে আপনার জন্য সবথেকে ভাল অপশন হচ্ছে ঋণ তহবিল। কিন্তু আপনি কি জানেন ঋণ তহবিল কত টাকা রিটার্ন দিতে পারে? ইকুইটি ফান্ড বোঝা এবং তা নিয়ে কাজ করা অপেক্ষাকৃত অনেক বেশি সহজ। কিন্তু, ঋণ তহবিল বিষয়টি অনেকেরই অজানা। অনেক বিনিয়োগকারী এমন রয়েছেন, যাঁরা ইকুইটি তহবিলে নিয়মিত বিনিয়োগ করলেও ঋণ তহবিলে বিনিয়োগ করেন না। অনেকে হয়তো এটাই বোঝেন না, যে ফিক্সড ইনকাম ফান্ড কীভাবে রিটার্ন জেনারেট করে। চলুন বিস্তারে জেনে নেওয়া যাক, মিউচুয়াল ফান্ডের ঋণ তহবিল বা ডেট ফান্ডের ব্যাপারে।

ঋণ তহবিল কীভাবে আপনাকে সাহায্য করে?
ঋণ তহবিল বা ডেট ফান্ড মূলত তারাই বেশি ব্যবহার করেন, যাঁরা নতুন নতুন নিজেদের বিনিয়োগের যাত্রা শুরু করেছেন। সেই সময় মার্কেটের সমস্ত বিষয় হয়তো আপনার অজানা থাকে। তাই নতুন বিনিয়োগের সময় কখনওই আপনি বিপজ্জনক মার্কেটে বিনিয়োগ করতে ইচ্ছুক থাকেন না। মিউচুয়াল ফান্ডের ক্ষেত্রে ইকুইটি ফান্ড মূলত এরকম বিপজ্জনক ফান্ডের সঙ্গে যুক্ত থাকে। তাই অনেক নতুন বিনিয়োগকারী এই ইকুইটি ফান্ড এড়িয়ে যাওয়ার চেষ্টা করেন। তাই এই সমস্ত গোষ্ঠীর মানুষের কাছেই সবথেকে বেশি লাভজনক হয়ে ওঠে ফিক্সড ইনকাম সিকিউরিটি ফান্ড বা ঋণ তহবিল।

ডেট ফান্ড মূলত কাজ করে স্থায়ী রোজগারের বিভিন্ন নির্দিষ্ট বন্ডের ক্ষেত্রে। এই সমস্ত বন্ডের মধ্যে রয়েছে কর্পোরেট বন্ড, সরকারি বন্ড, ট্রেজারি বিল, কমার্শিয়াল পেপার, ডিপোজিট সার্টিফিকেট এবং অন্যান্য মার্কেট সিকিউরিটি। যখন আপনি স্থায়ী ইনকাম সিকিউরিটির ক্ষেত্রে ইনভেস্ট করবেন, সেই সময় আপনি বন্ড প্রদানকারী সংস্থার একজন ঋণদাতা হয়ে উঠতে পারবেন। বলতে গেলে, আপনি সেই কোম্পানিকে একপ্রকার টাকা ঋণ দেবেন। এই ঋণ দেওয়ার কারণে আপনার বিনিয়োগ হয়ে উঠবে অনেকটাই বেশি সুরক্ষিত এবং ইকুইটি মার্কেটের মতো বিপদ আপনার এই বিনিয়োগের ক্ষেত্রে থাকবে না। যাকে আপনি টাকা ঋণ দিয়েছেন, তাকে অবশ্যই আপনার টাকা ফেরত দিতে হবেই। তাই এটা আপনি নিশ্চিত থাকবেন, আপনার তেমন একটা ক্ষতি হবে না, আপনি নিজের টাকা সময়মতো ফেরত পেয়ে যাবেন।

আরও পড়ুন: কোন পথে সঞ্চয় করলে নিশ্চিন্ত থাকবেন বয়সকালে?

কিন্তু আপনি এই বিনিয়োগ করে টাকা রোজগার কীভাবে করবেন? যখন আপনি ঋণ দিচ্ছেন, তখন আপনি বন্ড প্রদানকারী সেই সংস্থার কাছ থেকে একটা স্থায়ী শর্তে নির্দিষ্ট পরিমাণ সুদের হার প্রতি মাসে অথবা প্রতি বছরে গ্রহণ করতে পারেন। এটাই হবে আপনার অতিরিক্ত আয়। যে সংস্থা বন্ড দিয়ে আপনার কাছ থেকে ঋণ গ্রহণ করবে, সেই সংস্থা একটি নির্দিষ্ট সময় অন্তর আপনাকে আপনার টাকা সুদসমেত ফেরত দেবে। এই বিষয়টাকে মিউচুয়াল ফান্ডের ভাষায় বলে কুপন। আর যেহেতু বন্ড অনুযায়ী টাকা ঋণ দেওয়ার সময়ই সুদের হার নির্ধারণ করা হয়ে যায়, তাই এই বিশেষ মিউচুয়াল ফান্ডকে স্থায়ী আয়ের মিউচুয়াল ফান্ড বলা হয়।

কীভাবে রিটার্ন হিসেব করা হয়?
মিউচুয়াল ফান্ডে যখন আপনি বিনিয়োগ করবেন, তখন সবার আগে আপনাকে ভাবতে হবে রিটার্নের ব্যাপারে। ইকুইটি ফান্ড রিটার্ন কীভাবে জেনারেট করে, সেটা হয়তো অনেকেই জানেন। কিন্তু ডেট ফান্ড কীভাবে রিটার্ন জেনারেট করে জানেন? এই ডেট ফান্ড দুইভাবে রিটার্ন জেনারেট করতে পারে। প্রথমটি হলো, যদি আপনি ডেট মিউচুয়াল ফান্ডে বিনিয়োগ করেন, তাহলে প্রাপ্ত সুদ অথবা কুপন থেকে আপনি রিটার্ন পেয়ে যাবেন। আর দ্বিতীয়টি হলো, বিনিয়োগের ওপর প্রাপ্ত অতিরিক্ত ক্যাপিটাল।

প্রথমত, কুপন হলো এমন একটি বিষয় যা সরাসরি নির্ভর করে কোনও মিউচুয়াল ফান্ডের প্রদত্ত সুদের হারের সঙ্গে। যদি কোনও ফিক্সড ইনকাম সিকিউরিটিতে আপনি ইনভেস্ট করেন, তাহলে আপনি প্রতি সময় অন্তরে একটা নির্দিষ্ট পরিমাণ টাকা সুদ হিসেবে পেতে থাকবেন। যদি AAA রেটেড কোন কোম্পানির ৫ বছরের বন্ড আপনি গ্রহণ করেন তাহলে, প্রতি বছরে একটা নির্দিষ্ট সময়ে আপনি সুদের টাকা পাবেন। কোনও কোম্পানির রেটিং যত ভালো হবে, তত সেই কোম্পানির ঋণখেলাপি করার সম্ভাবনা কম। যদি ৫ বছরের জন্য আপনি ৭ শতাংশ হারে সেই কোম্পানির বন্ড গ্রহণ করেন, তাহলে ম্যাচিউরিটির সময় পাঁচ বছর পরে কুপন এক্সপায়ার করবে এবং সময়মতো আপনি টাকা পাবেন।

অন্যদিকে, যদি আপনি পাঁচ বছরের জন্য টাকা ইনভেস্ট চালিয়ে রাখেন, তাহলে পাঁচ বছর পর যখন কুপন এক্সপায়ার করবে, সেই সময় আপনি আপনার প্রিন্সিপাল ইনভেস্টমেন্ট ফেরত পেয়ে যাবেন একসঙ্গেই। তবে এখানে একটা বিষয় মাথায় রাখা উচিত, যখন কোনও কোম্পানির বন্ড আপনি গ্রহণ করছেন, সেই সময় শুধুমাত্র সুদের হার দেখে এগিয়ে যাবেন না। যদি আপনি দেখেন কোনও কোম্পানি বেশি সুদ দিচ্ছে, তাহলে বুঝে নেবেন, সেই কোম্পানির বন্ড হয় বেশি বিপজ্জনক, নতুবা সেই কোম্পানির ঋণখেলাপি করার রেকর্ড রয়েছে। যে সমস্ত কোম্পানি অত্যন্ত বেশি সুদ দিচ্ছে, সেই কোম্পানির বন্ডে বিনিয়োগ না করাই ভালো।

পাশাপাশি, শুধুমাত্র সেই সমস্ত কোম্পানির বন্ডে টাকা বিনিয়োগ করবেন, যাদের রেটিং AAA অথবা তার থেকেও বেশি। তারা হয়তো খুব একটা ভালো সুদ দেবে না, কিন্তু তাদের পোর্টফোলিও অনেক ভালো হবে। মিউচুয়াল ফান্ডের ডেট ফান্ডে বিনিয়োগ করার সময় সবসময় খেয়াল রাখবেন কোম্পানির পোর্টফোলিও কী। যে কোম্পানির পোর্টফোলিও যত ভালো, সেই কোম্পানিতে বিনিয়োগ করা তত বেশি ঝুঁকিবিহীন।

ঋণ তহবিল থেকে রিটার্ন জেনারেট করার আরও একটি রাস্তা হল ক্যাপিটাল গেন। এই ক্যাপিটাল নির্ভর করে মূলত ফিক্সড ইনকাম সিকিউরিটি ফান্ডের দামের পরিবর্তনের ওপর। অন্যদিকে, এর সঙ্গে সরাসরিভাবে জড়িত থাকে কোনও একটি ডেট ফান্ডের ইল্ড। প্রথমত, কোনও ফান্ডের সর্বাধিক মূল্য নির্ভর করে সেই বন্ডের সম্পূর্ণ রিটার্নের ওপর। এই বিষয়টাকে যদি আরও ভালোভাবে ব্যাখ্যা করা যায়, তাহলে বলতে হয়, কুপন রেটের থেকে কিন্তু সম্পূর্ণ রিটার্ন বা ইল্ড কিছুটা হলেও আলাদা। এই ইল্ডের সঙ্গে বন্ডের মূল দাম সম্পূর্ণ ব্যস্তানুপাতিক সম্পর্কে থাকে।

যদি কোনও বন্ডের দাম কমে যায়, অর্থাৎ সেই বন্ডের চাহিদা কমে যায়, তখন বৃদ্ধি পায় সেই বন্ডের ইল্ড। সেই সময় যারা এই বন্ডে ইনভেস্ট করেছেন, তাদের রিটার্নের পরিমাণ অনেকখানি বেড়ে যায়। অন্যদিকে, যখন কোনও বন্ডের চাহিদা বেড়ে যায়, অর্থাৎ সেই বন্ডের দাম আগের থেকে অনেকটা বেড়ে যায়, সেই সময় রিটার্ন অনেকটা কম থাকে। আসল কুপন রেটের থেকেও অনেকখানি কমে যায় বন্ডের রিটার্ন মূল্য। বন্ডের এই ইল্ড বেশ কিছু বিষয়ের ওপর নির্ভর করে। রিজার্ভ ব্যাঙ্কের রেপো রেট, মূল্যবৃদ্ধির পরিসংখ্যান, জিডিপি প্রোজেকশন-সহ একাধিক বিষয় নির্ভর করে বন্ডের মূল্য নির্ধারণের ওপর। পাশাপাশি, যদি ইকুইটি অনেকখানি ওপরের দিকে উঠে আসে, তাহলেও বন্ডের প্রয়োজনীয়তা অনেকটা কমে, সেক্ষেত্রেও বন্ডের দাম কমে আসে এবং ইল্ড বেড়ে যায়।

সম্ভাব্য ঝুঁকি
ইকুইটি ফান্ড এবং ডেট ফান্ডের মধ্যে তুলনা করলে, ডেট ফান্ড অনেকটা বেশি স্থিতিশীল বলেই মনে করেন অর্থনৈতিক বিশেষজ্ঞরা। তবে, এক্ষেত্রে কিন্তু কিছু পরিমাণ ঝুঁকি থেকেই যায়। বন্ড এবং মানি মার্কেটের ইন্সট্রুমেন্টগুলি যদি সময়মতো আপনার অর্থ প্রদান করতে ব্যর্থ হয় কিংবা আর্থিক দুর্দশা এবং অন্য কোনও কারণবশত এই ফান্ডের মোট রিটার্নের উল্লেখযোগ্য অংশ ঝুঁকিপূর্ণ হয়ে ওঠে, সেক্ষেত্রে আপনার ক্ষতির সম্ভাবনা কিন্তু রয়েছে।

উদাহরণ হিসেবে ধরে নিন, কোনও ব্যক্তি ১০ বছর ধরে কোনও একটি বন্ডে টাকা দিচ্ছেন। সময়সীমা যেহেতু অনেকটা বেশি, তাই বাজারে ওঠানামার সম্ভাবনাও অনেকটা বেশি রয়েছে। সেক্ষেত্রে আপনারা লাভের পরিমাণ অনেক বেশি দেখলেও, ক্ষতির আশঙ্কাও রয়েছে একই সঙ্গে। কম সময়ের বন্ডের ক্ষেত্রেও এই একই সমস্যা দেখা দিতে পারে। যদি, কোনও একটি বেশি ঝুঁকিপূর্ণ বন্ডে কম সময়ের জন্য আপনি বিনিয়োগ করেন, তাহলেও কিন্তু সমস্যা থেকেই যায়। তাই কখনওই বেশি ঝুঁকিপূর্ণ বন্ডে বিনিয়োগ করবেন না, রেটিং ভালো দেখে তবেই তাদের বন্ড গ্রহণ করা ভালো।

খরচ
এই ধরনের সমস্ত ফান্ডের ক্ষেত্রে দুই ধরনের খরচ আপনারা দেখতে পাবেন। প্রথমটি হলো, এক্সিট লোড, এবং দ্বিতীয়টি হলো, এক্সপেন্স রেশিও। এক্সিট লোড কী? যদি মেয়াদ শেষ হওয়ার আগে কোনও ব্যক্তি তাঁর হাতে থাকা ইউনিট বিক্রি করে দেন তাহলে তাঁর ইউনিটের থেকে প্রাপ্ত অর্থের কিছু পরিমাণ টাকা কেটে নেওয়া হয়। সেই টাকা সরাসরি চলে যায় সংশ্লিষ্ট ফান্ড হাউজের কাছে। যে পরিমাণ টাকা কেটে নেওয়া হয়, তা হয় ১ শতাংশ। সেবি এই পুরো বিষয়টিকে নিয়ন্ত্রণ করে থাকে।

অন্যদিকে এক্সপেন্স রেশিও বলতে বোঝায়, ফান্ড ম্যানেজারের সমগ্র ফান্ডের তদারকির জন্য প্রাপ্ত পারিশ্রমিক। এটি সাধারণত ০.২৫ শতাংশ থেকে এক শতাংশ পর্যন্ত হয়ে থাকে। বিক্রি হওয়া ইউনিট থেকে প্রাপ্ত অর্থের একটি নির্ধারিত পরিমাণ কেটে নিয়ে এই এক্সপেন্স রেশিও নির্ধারণ করা হয়। এই অর্থ সরাসরি সংশ্লিষ্ট ফান্ড হাউজ আপনার প্রাপ্য টাকা থেকে কেটে নেবে, এবং তারপরেই অবশিষ্ট অর্থ আপনার ব্যাঙ্ক অ্যাকাউন্টে পাঠিয়ে দেবে।

মিউচুয়াল ফান্ডের ডেট ফান্ডের ক্ষেত্রে যেমন রয়েছে লাভ, তেমনই কিন্তু রয়েছে কিছু ঝুঁকির সম্ভাবনা। যদি আপনার মনে এই নিয়ে কিছু ধন্ধ থেকে যায় এবং আপনি ইকুইটি মিউচুয়াল ফান্ড এবং ডেট ফান্ডের মধ্যে সঠিক বিকল্প বেছে নিতে অপারগ থাকেন, তাহলে অবশ্যই ডেট ফান্ডে টাকা বিনিয়োগ করুন। অন্যদিকে, আপনি যদি সবে সবে নিজের বিনিয়োগ শুরু করে থাকেন, তাহলে অবশ্যই শুরু করুন ডেট ফান্ড দিয়েই। তারপর ধীরে ধীরে মার্কেটের ওঠানামা বুঝে নিয়ে ইকুইটি মিউচুয়াল ফান্ডের দিকে বিনিয়োগ শুরু করতেই পারেন।

More Articles