পুড়ে খাক জঙ্গল, মরছে বন্যপ্রাণী! কী কারণে ছারখার হিমাচল প্রদেশের প্রকৃতি?

সরকারের দেওয়া তথ্যই বলছে, এপ্রিল ১ থেকে জুন ৩০-এর মধ্যে ২,৭৬৩টি দাবানলের ঘটনা ঘটেছে। বা প্রত্যেকদিন ৩১টি করে দাবানল।

হিমাচল প্রদেশ। পাহাড় এবং অরণ্যে ঘেরা ভারতের এক রাজ্য। যার সৌন্দর্য চাক্ষুষ করতে শুধু দেশ না, বিদেশ থেকেও ছুটে আসেন পর্যটকরা। আসেন প্রকৃতির সান্নিধ্য পেতে। আজ সেই স্বর্গরাজ্য প্রবল চাপে। তাপমাত্রা বাড়ছে তার। প্রকৃতির রোষ, মানুষের প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষ দোষের দরুন যা বাড়ছে। ঠিক কী হচ্ছে হিমাচলে?

শুধু এই বছর, অর্থাৎ ২০২২ সালের এপ্রিল থেকে জুনের মধ্যে ২,৭৬৩টি দাবানলের ঘটনা ঘটেছে হিমাচলে। হ্যাঁ, মাত্র তিন মাসে এতবার পুড়েছে এই রাজ্যের বনানী। এই রাজ্যের মোট ভৌগোলিক এলাকার ৬৬ শতাংশই জঙ্গলে ঘেরা। এই ৬৬ শতাংশ জীববৈচিত্র্যর দিক থেকেও খুবই সমৃদ্ধ এবং এখনও বাড়তে থাকা এই ভঙ্গুর হিমালয় পর্বতমালার জন্য এই সবুজের গুরুত্ব অপরিসীম। সেই সঙ্গে গোটা হিমাচল প্রদেশের মানুষের কাছেও এর গুরুত্বের শেষ নেই। শুধু পরিবেশগত দিক নয়, অর্থনৈতিকভাবেও এই রাজ্যের চালিকাশক্তি এই ৬৬ শতাংশ সবুজ। সেই রাজ্যে স্বাভাবিকভাবেই এত ঘন ঘন দাবানলের ঘটনা ভীষণ চিন্তায় ফেলেছে সাধারণ মানুষ থেকে শুরু করে প্রশাসনকে।

তাদের মধ্যেই একজন হলেন রোশন লাল। বয়স ৬৬। এখনও ১২ জুনের ঘটে যাওয়া দাবানলের প্রতিঘাত সামলে উঠতে পারেননি তিনি। হিমাচলের কিন্নর প্রদেশের জাঙ্গি গ্রামের একজন বাসিন্দা তিনি। পেশায় কৃষিবিদ। তিনি খুব স্পষ্টভাবেই জানাচ্ছেন, কস্মিনকালেও তিনি এত ভয়াবহ দাবানল দেখেননি। আগুন প্রায় তিন কিলোমিটারজুড়ে ছড়িয়ে ছিল এবং শয়ে শয়ে গাছকে তা গ্রাস করে নেয়। প্রায় তিন দিন লেগে যায় সেই আগুন নেভাতে। কিন্তু ততক্ষণে ১৬১ হেক্টর জঙ্গল ভষ্মীভূত।

আরও পড়ুন: দিল্লিবাসীর নাভিশ্বাস! পরিবেশ ধ্বংসের পরিণাম ফলছে, বাসের অযোগ্য হবে রাজধানী?

আগুনের গ্রাসে শেষ হয়ে গেছে শয়ে শয়ে চিলগোজা পাইন গাছ, যা থেকে উৎপন্ন হওয়া ভোজ্য বাদাম জাঙ্গি গ্রামের মানুষের উপার্জনের অন্যতম উৎস। সেই সঙ্গে প্রাণহানি হয়েছে হিমালয়ান তাহর এবং ভাল্লুকের মতো প্রাণীদের। এত ঘন জঙ্গলে এমন ঘটনা ঘটার কারণ খুঁজতে গিয়ে বেশ চিন্তায় পড়েছেন বিশেষজ্ঞরা। তাঁরা মনে করছেন, উত্তর ভারতের তাপপ্রবাহ শুষ্ক করেছে এখানকার আবহাওয়া, এবং দীর্ঘ সময় ধরে এমন অবস্থা চলার কারণে হয়তো এত ভয়ংকর দাবানলের মতো ঘটনা ঘটেছে।

সবথেকে চিন্তার বিষয় হলো, এমন ঘটনা এখন গোটা হিমাচল প্রদেশে খুব সাধারণ হয়ে গেছে। সরকারের দেওয়া তথ্যই বলছে, এপ্রিল ১ থেকে জুন ৩০-এর মধ্যে ২,৭৬৩টি দাবানলের ঘটনা ঘটেছে। বা প্রত্যেকদিন ৩১টি করে দাবানল।

এই তালিকায় শীর্ষে রয়েছে ধর্মশালা জেলা। সেখানে এই তিন মাসে ঘটেছে ৬১৮টি দাবানল। তারপরে রয়েছে চম্বা (৫২২), মান্ডি (৩৬৪), সিমলা (২৮৬), হামিরপুর (২৮৫), রামপুর (১৯০), বিলাশপুর (১৫১) এবং সবশেষে সোলান (১১০)। হিমাচল প্রদেশের Forest Protection and Fire Control Division চালু হয় ২০০৭ সালে। চালু হওয়ার পর এত দাবানল এই প্রথম। ডিভিশনের কর্তারা বলছেন, এই সংখ্যা এমন হারে বৃদ্ধি পাওয়া খুব আতঙ্কের। এর আগে ২০১৮-'১৯ সালে ২,৫৪৪টি দাবানলের ঘটনা ঘটেছিল। কিন্তু সেই বছরেও দাবানলের ঘটনা সারা বছর ধরে হয়েছিল। মাত্র তিন মাসে নয়।

এই তিন মাসে মোট ২৩,২৩৯ হেক্টর জঙ্গল ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। যা হিমাচল প্রদেশের মোট সবুজের ০.৪৫ শতাংশ। আর্থিক ক্ষতির হিসেব করলে দেখা যাচ্ছে ৬৪ কোটি টাকার ক্ষতি। এই ক্ষতিগ্রস্ত এলাকার মধ্যে ১৮,৬০০ হেক্টর পুরনো জঙ্গল, এবং ৪,৫০০ হেক্টর নতুন। রাজ্য সরকারের রোপণ করা অঞ্চল। সেই সঙ্গে, এই দাবানলকে আটকাতে প্রাণ হারিয়েছেন তিন জন বন দফতরের আধিকারিক।

হিমাচল প্রদেশের মুখ্য বন সংরক্ষক অনিল শর্মা বলছেন, বেশিরভাগ দাবানলের ঘটনাই ঘটে মানুষের গাফিলতির কারণে। কখনও কেউ ধূমপান করে সিগারেটের জ্বলন্ত অংশ জঙ্গলে ফেলে দিচ্ছেন, কখনও কোনও চাষি কৃষিকাজে আগুন জ্বালিয়ে তা সম্পূর্ণভাবে না নিভিয়েই চলে আসছেন। কিছু ক্ষেত্রে তো একেবারে উদ্দেশ্যপ্রণোদিতভাবেই এই কাজ করা হয়।

কিন্তু ২০২২ সালে শুধুমাত্র মানুষের প্রত্যক্ষ অংশগ্রহণকেই দায়ী করতে রাজি নন অনিল শর্মা। বিশ্ব উষ্ণায়নের কারণে যেভাবে তাপপ্রবাহ বাড়ছে তা এই ঘন ঘন দাবানলের পিছনে দায়ী বলে তিনি মনে করেন। উত্তর ভারতের এই বছরের তাপপ্রবাহ বাতাসকে শুষ্ক করে রেখেছে সময়সীমার চেয়ে অনেকটাই বেশি, এবং সেই কারণে জঙ্গলে পড়ে থাকা শুকনো ঝরা পাতা বারবার জ্বলে উঠেছে এবং শেষ করে দিয়েছে শয়ে শয়ে গাছ।

হাওয়া দপ্তরের রিপোর্ট বলছে, মার্চ এবং এপ্রিলে বৃষ্টির ঘাটতি থেকেছে যথাক্রমে ৯৫% এবং ৯০%। ২০০২ সালের পর এই প্রথম এত বৃষ্টিপাতে ঘাটতি। মে এবং জুন, যখন হিমাচল প্রদেশের বৃষ্টিতে ভেসে যাওয়ার কথা, তখনও ঘাটতি থেকেছে ২৩% এবং ৪৮%। সেই সাথে সবথেকে ভয়াবহ তথ্যটি দিয়ে রাখা প্রয়োজন। ২০২২ সালে হিমাচল প্রদেশ তাপপ্রবাহ সহ্য করেছে ২৭ দিন, যা নজিরবিহীন।

রোশন লাল এইসবের জন্য সবার আগে দায়ী করছেন অনিয়ন্ত্রিত উন্নয়নের কর্মকাণ্ডকে। নির্বিচারে পরিবেশ ধ্বংস করে একের পর এক উন্নয়নমূলক প্রকল্প আসলে পরিবেশের ওপরেই মারাত্মক চাপ ফেলছে, এবং এইভাবে পরিবেশ তার প্রতিক্রিয়া জানাচ্ছে।

যতদিন পর্যন্ত না জনগণকে সচেতন করা যাচ্ছে, সেই সঙ্গে সরকারের তরফ থেকে সার্বিক এবং গঠনমূলক কোনও ভূমিকা নেওয়া হচ্ছে, ততদিন এই ধরনের ঘটনা ঘটবে, এর সংখ্যা বাড়বে এবং সঠিক সময়ে পদক্ষেপ না নেওয়া হলে একদিন আর বাঁচানোর মতো কিছুই অবশিষ্ট থাকবে না। আমরা কি সেই দিনের অপেক্ষায় থাকব?

More Articles