সতীর জননাঙ্গ পড়েছিল, এখানে নারীর কাছে এখনও বশ পুরুষ, যে কাহিনি প্রচলিত

কালিকাপুরাণ-এ বলা হয়েছে এই স্থানে কামনার অনুরূপ ফল পাওয়া যায়। তাই এই স্থান কামরূপ নামে খ্যাত। বিশেষত কলিযুগে এই স্থান অতীব জাগ্রত। এই স্থানকে বলা হয় 'কামরূপ-কামাখ্যা'।

সতীর দেহ কাঁধে নিয়ে দেবাদিদেব মহাদেব তাণ্ডবনৃত্য শুরু করলেন। মহাপ্রলয় উপস্থিত হলো। ত্রিভুবন ধ্বংসের মুখে ধাবিত হলো। পিতা ব্রহ্মার আদেশে তখন বিষ্ণু সুদর্শন চক্রকে আদেশ দিলেন, সতীর দেহ খণ্ড-বিখণ্ড করে দিতে। সতীর দেহ ৫১টি খণ্ডে বিভক্ত হয়ে ছড়িয়ে পড়ল। সতীর দেহের যোনিমণ্ডল পড়ল কামরূপের কামাখ্যা মাতার অবস্থান, অর্থাৎ 'নীল পর্বতে'। সতীর যোনিমণ্ডল নীল পর্বতে পড়ার সঙ্গে সঙ্গে, পাহাড়টি পাতালে প্রবেশ করতে শুরু করল। ব্রহ্মা-বিষ্ণু-সকল দেবতা মিলেও সেই পাতালপ্রবেশ আটকাতে পারলেন না। তখন স্বয়ং মা কামাখ্যা এই পাতালপ্রবেশ রুখে দিলেন।

সতীর দেহ খণ্ডবিখণ্ড হয়ে ৫১টি অংশে বিভক্ত হয়ে বিভিন্ন জায়গায় পড়ে এক একটি শক্তিপীঠ তথা সতীপীঠের সৃষ্টি হল। যখন সতীর দেহ মহাদেবের বক্ষ থেকে সম্পূর্ণরূপে বিলুপ্ত হলো, তখন মহাদেব সংবিৎ ফিরে পেলেন। তারপর তিনি গভীর ধ্যানে মগ্ন হলেন। কিন্তু তাঁর এই ধ্যান ভাঙানোর জন্য শত চেষ্টা করেও সকলেই অকৃতকার্য হলো। এরপর কামদেব গেলেন তাঁর ধ্যান ভাঙাতে। মহাদেবের ত্রিনয়নের তেজরশ্মিতে তিনি সম্পূর্ণরূপে ভষ্মীভূত হলেন। কামদেবের স্ত্রী রতি তখন মহাদেবের সামনে গিয়ে অনুনয়-বিনয় করতে লাগলেন কামদেবের প্রাণ ফিরিয়ে দেবার জন্য। মহাদেব কামদেবের প্রাণ ফিরিয়ে দিলেন, কিন্তু কামদেব পূর্বাবস্থায় ফিরতে পারলেন না। তখন ওই বিকৃত রূপ নিয়ে কামদেব ও তাঁর স্ত্রী রতি মহাদেবের আরাধনা করতে লাগলেন। দেবাদিদেব তখন কামদেবকে নির্দেশ দিলেন, নীল পর্বতে গিয়ে, যে স্থানে সতীর যোনিমণ্ডল আছে, সেখানে মা কামাখ্যার মন্দির তৈরি করতে। তিনি বললেন, যেদিন মন্দির তৈরির কাজ শেষ হবে সেই দিনই কামদেব পূর্বাবস্থায় ফিরতে পারবেন, অর্থাৎ পুনরায় তাঁর পূর্বের রূপ ফিরে পাবেন। এরপর কামদেব নীল পর্বতে মন্দির তৈরি করার পর পূর্ব রূপ ফিরে পেয়েছিলেন। সেই কারণেই এই পাহাড়ের নাম হয়েছে 'কামরূপ'। অনেকে এই কামরূপ নামকরণ নিয়ে ভিন্ন মত পোষণ করেন। তাঁদের মতে, এই স্থানে সকল মনস্কামনা পূরণ হয়,তাই এই স্থানের নাম 'কামরূপ'।

পূর্বে মন্দিরের গাত্রে ৬৪ যোগিনী ও অষ্টাদশ ভৈরবের মূর্তি খোদিত ছিল বলে জনশ্রুতি শোনা যায়। কিন্তু কালের নিয়মে প্রাকৃতিক বিপর্যয়ে সবকিছুই ধ্বংসপ্রাপ্ত হয় এবং এক বিশাল জঙ্গলের সৃষ্টি হয়। সেই সময় কোচবিহারের রাজা ছিলেন 'বিশ্বসিংহ'। অসমের অনেক ছোট ছোট রাজা তাঁর অধীনস্থ ছিলেন।একসময় এই সকল ছোট ছোট রাজা একত্রিত হয়ে বিশ্বসিংহের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র করেন এবং তাঁকে সিংহাসনচ্যুত করবার মতলব করেন। বিশ্বসিংহ এবং তাঁর ভাই শিবসিংহ বিদ্রোহ দমনের উদ্দেশ্যে যাত্রা করেন। পূর্বদিকে যেতে যেতে তাঁরা পথ হারিয়ে ফেলেন এবং সঙ্গের সৈন্যসামন্তদেরও হদিশ মেলে না। রাজা বিশ্বসিংহ তখন কাতর হয়ে দেবী কামাখ্যাকে স্মরণ করলেন। এমন সময় এক অশীতিপর বৃদ্ধা রাজার সম্মুখে উপস্থিত হয়ে বললেন রাজা যুদ্ধে জয়লাভ করবেন, বিদ্রোহ দমন করবেন এবং এখনই সকল সৈন্যসামন্ত-সহ পথের দিশা পাবেন। কিন্তু যুদ্ধে জয়লাভের পর এই জঙ্গলে দেবী কামাখ্যার সোনার মন্দির তৈরি করে দিতে হবে। মহারাজ বিশ্বসিংহ তৎক্ষণাৎ রাজি হয়ে গেলেন। আশ্চর্যজনকভাবে সেই বৃদ্ধার প্রতিটি বাক্য ফলে গেল। যুদ্ধে জয়লাভের পর রাজা বিশ্বসিংহ জঙ্গল পরিষ্কার করিয়ে মন্দির তৈরি করাতে লাগলেন। সারাদিন ইট গাঁথা হয়, কিন্তু কোনো এক অজ্ঞাত কারণে রাতের মধ্যেই সেই গাঁথুনি খসে পড়ে। এইভাবে কিছুদিন চলার পর রাজা স্বপ্নে দেখলেন, সেই বৃদ্ধা তাঁকে বলছেন, সোনার মন্দির তৈরি করার কথা রাজা ভুলে গেলেন কী করে! রাজা বললেন,'মা এত সোনা আমি কোথায় পাব?' জনশ্রুতি শোনা যায়, এরপর পরদিন থেকে রাজাদেশে প্রতিটি ইটের নিচে এক ভরি করে সোনা দিয়ে গাঁথা হলো।তারপর আর একবারও গাঁথুনি খুলে পড়ল না।

আরও পড়ুন: এই কুণ্ডের জল পান করলেই সেরে যাবে রোগ, ঘরের কাছের এই সতীপীঠ নিয়ে রয়েছে নানা কিংবদন্তি

পরবর্তীকালে মন্দিরের ভগ্নদশা পুনর্নির্মাণ করলেন রাজা বিশ্বসিংহের পুত্র নরনারায়ণ। তিনি শুনেছিলেন, সন্ধ্যাবেলায় আরতির সময় মা কামাখ্যা দর্শন দেন।দেবী দর্শনের আশায় তিনি সন্ধ্যারতির সময় উপস্থিত হলেন, পুজোর সময় প্রচণ্ড আলোর ছটায় তাঁর চোখ ঝলসে গেল, তিনি দৃষ্টি হারালেন, কুপিতা দেবী মা তাঁকে অভিশাপ দিলেন, রাজা বা রাজপরিবারের কেউ কখনও যদি মন্দিরের কাছে আসে, তাহলে তাঁদের বংশ লোপ পাবে। সেই থেকে কোচবিহারের রাজপরিবারের কেউ কখনও কামাখ্যা মাতার মন্দিরে আসেন না।

Kamrup Kamakhya

কামাখ্যা মায়ের মন্দিরে কোনও মূর্তি নেই। শুধু একটি পাথরের তৈরি সরু গর্ত দেখা যায়। গর্ভগৃহটি ছোট এবং অন্ধকারাচ্ছন্ন। সরু একটি সিঁড়ি বেয়ে এখানে পৌঁছতে হয়। ভেতরে ঢালু পাথরের একটি খণ্ড আছে, যেটি যোনি-আকৃতিবিশিষ্ট। ভূগর্ভস্থ প্রস্রবণের জল বেরিয়ে এই গর্তটি সবসময় জল ভর্তি রাখে, এই গর্তটিই দেবী কামাখ্যা নামে পূজিতা হন, দেবী এখানে নিরাকার। এই শক্তিপীঠ 'দেবী পীঠ' নামে প্রসিদ্ধ। ৫১টি শক্তিপীঠের শ্রেষ্ঠ শক্তিপীঠ 'কামাখ্যা'। আশ্চর্যের বিষয় এই যে, কামাখ্যা মন্দির চত্বরে অন্যান্য মন্দিরগুলিতেও একই রকম যোনি-আকৃতিবিশিষ্ট পাথর দেখা যায়, যা ভূগর্ভস্থ জল দ্বারা পরিপূর্ণ থাকে। এই জল কখনও শুকায় না। প্রতি বছর অম্বুবাচী উপলক্ষে কামাখ্যা মন্দিরের বেদি থেকে নিরন্তর লাল বর্ণের রক্তধারা বইতে থাকে। এইসময় দেবী মা হন সাধারণ নারীর মতোই রজঃস্বলা। তখন মা কামাখ্যা-কে একটি সাদা কাপড় দিয়ে ঢেকে দেওয়া হয় এবং মন্দিরের দরজা তিন দিনের জন্য বন্ধ করে দেওয়া হয়। এই সময় মন্দিরে ঢোকা সম্পূর্ণ নিষিদ্ধ। মূল ফটকের বাইরে অম্বুবাচী উপলক্ষে কামাখ্যা মন্দিরে বিশাল মেলা ও উৎসব এবং পূজা-অর্চনা চলতে থাকে। এইসময় ব্রহ্মপুত্রের জলও লালচে বর্ণ ধারণ করে। আজ পর্যন্ত এর কোনও বৈজ্ঞানিক ব্যাখ্যা মেলেনি, তবে এর নেপথ্যে নিশ্চিতভাবেই কোনও প্রাকৃতিক কারণ আছে।

এখানে মাতা সতীর যোনি অঙ্গ পতিত হওয়ার ফলে এই জায়গাটিকে 'কুব্জিকাপিঠ'ও বলা হয়। কামাখ্যা দেবী হলেন তন্ত্রসাধনার দেবী। তাই কামাখ্যা হলো তান্ত্রিক ও তন্ত্রসাধকদের সাধনা-স্থল। কামাখ্যা নিয়ে বিভিন্ন গল্প প্রচলিত আছে। সেই গল্পে বলা হয় এ নাকি এক ভয়ংকর স্থান। এখানে আশপাশের জঙ্গলে আর নির্জন পথে নাকি দর্শন পাওয়া যায় ভূত-পেত্নী ডাকিনী-যোগিনীর। এসবই প্রচলিত রটনা। তবে এই জঙ্গলে চিতাবাঘ রয়েছে। কামাখ্যা হল জাদু-টোনা, তন্ত্র-মন্ত্রর দেশ। কামরূপ-কামাখ্যা নারীশাসিত পাহাড়ি ভূখণ্ড। এখানে নারীরা ছলা-কলা, কামকলায় পারদর্শিনী, এখানে তারা পুরুষদের মন্ত্রবলে ভেড়া বানিয়ে রাখে- তবে এই গল্পকথার কোনও ভিত্তি নেই। তবে একথা সত্য যে, কামাখ্যা তান্ত্রিকদের কাছে একটি পবিত্র তীর্থস্থান। শুধু তান্ত্রিকদের কাছে কেন, হিন্দুদের কাছে কামাখ্যা হলো অত্যন্ত পবিত্র তীর্থ। এখানে এলে সকল মনোবাসনা পূর্ণ হয়। এই মন্দিরের গায়ে ৬৪ যোগিনী আর ১৮টি ভৈরব মূর্তি খোদাই করা আছে। কথিত আছে, যেসব সাধক এই মন্দিরে কামাখ্যা দেবীর সাধন-ভজন করেন তাঁরা জগতের তিনটি ঋণ অর্থাৎ পিতৃ ঋণ, ঋষি ঋণ এবং দেবীঋণ থেকে মুক্তি লাভ করেন। মন্দিরের চূড়াগুলি মৌচাকের মতো দেখতে, কিন্তু কেন এইভাবে বানানো হয়েছে, সেকথা জানা যায় না। এই মন্দিরকে দশমহাবিদ্যার মন্দির বলা হয়ে থাকে। এখানে অধিষ্ঠাত্রী দশ দেবী হলেন, ভুবনেশ্বরী, ছিন্নমস্তা, মাতঙ্গী ভৈরবী, তারা, বগলামুখী, কালী কমলা, ধূমাবতী ও ত্রিপুরেশ্বরী।

Kamrup Kamakhya

কামাখ্যা মন্দিরে চারটি কক্ষ আছে। গর্ভগৃহ ও তিনটি মণ্ডপ। মণ্ডপগুলির স্থানীয় নাম চলন্ত, পঞ্চরত্ন ও নাটমন্দির। কামাখ্যা মন্দির নিয়ে রহস্য এবং জনশ্রুতির শেষ নেই। কালিকাপুরাণ-এ বলা হয়েছে এই স্থানে কামনার অনুরূপ ফল পাওয়া যায়। তাই এই স্থান কামরূপ নামে খ্যাত। বিশেষত কলিযুগে এই স্থান অতীব জাগ্রত। এই স্থানকে বলা হয় 'কামরূপ-কামাখ্যা'।

 

More Articles