ধর্মতলার লেনিন থেকে ভিক্টোরিয়ার পরী, ফিরে দেখা স্ট্যাচুর শহর কলকাতা

একটু আগে পর্যন্ত আকাশে বেশ আলো ছিল। এবার একে একে স্ট্রিট ল্যাম্পগুলো জ্বলে উঠছে ধর্মতলা মোড়ে। টিপু সুলতান মসজিদ থেকে আজানের শব্দ ভেসে আসছে। তার গা ঘেঁষে স্টেটসম্যান হাউজের দিকে ছুটে চলেছে অসংখ্য গাড়ি। চুপচাপ দাঁড়িয়ে এ সবই দেখছেন কমরেড লেনিন। কলকাতা শহরে দশকের পর দশক ধরে একাই দাঁড়িয়ে আছেন তিনি। খানিক দূরে অবশ্য তাঁর পরম মিত্র মার্ক্স-এঙ্গেলসও রয়েছেন। তবে দুজনের মুখোমুখি দেখা হয় না কখনও। খানিকক্ষণ পর লেনিন দেখলেন, ‘সন্ধের মুখে যে মেয়েটাকে একটা ট্যাক্সি এসে তুলে নিয়ে গিয়েছিল, সন্ধে গড়িয়ে গেলে, হাই তুলতে তুলতে সে আবার এসে দাঁড়িয়েছে গাছতলায়।’ বড় ঘুম পাচ্ছে লেনিনের। এতদিন ধরে একটানা দাঁড়িয়ে থাকা তো বড় সহজ কথা নয়। তার উপর নিস্তরঙ্গ জীবন। কিছুই যেন ঘটে না এ শহরে।  রাত বাড়ল, কার্জন পার্কের কোনও একদিকে তাকালেন লেনিন, দেখলেন, ‘লাল নিশান নিয়ে একদল মজুরের এক বিশাল মিছিল আসছে।’ তিনি এবার হাঁক ছাড়লেন জোড়ে, ‘শতাব্দী শেষ হয়ে আসছে- একটু পা চালিয়ে ভাই, একটু পা চালিয়ে।’

আরও পড়ুন-এই স্টিয়ারিংয়ে হাত রাখতেন হেমন্ত মুখোপাধ্যায়, এখন কেমন আছে নীলু?

এমন কত শতাব্দী কেটে যায়, কলকাতার বোবা মূর্তিরা দাঁড়িয়ে থাকে, নিশ্চল। তাদের পাথুরে চোখে কত যুগের ইতিহাস। যাঁরা দিন আনেন, দিন খান, বা যাঁরা হাজার হাজার দিন ইতিমধ্যেই খেয়ে ফেলেছেন, সে সকল রাম, শ্যাম, যদু, মধুর গল্প কথা। বহু দিন  আগে  কলকাতার মূর্তিরা একে একে এসে পৌঁছেছিল এ শহরে। কী ভাবে এল তারা?  সে গল্প আজও বিস্ময় জাগায়।

ইডেন গার্ডেন রোডের বঙ্কিমচন্দ্র

১৯৬৭ সালের কথা। জাতীয় কংগ্রেসের একাধিপত্বকে বৃদ্ধাঙ্গুষ্ঠ দেখিয়ে পশ্চিমবঙ্গে সবে ক্ষমতায় এসেছে যুক্তফ্রন্ট সরকার। ঠিক তার ২০ বছর আগে স্বাধীনতা লাভ করেছে ভারত। তবু দেশে শান্তি আসেনি। আগে ছিল ‘মালিক সাহেব’দের যুগ, ১৯৪৭ এর পর ক্ষমতায় এলেন ‘গোলাম সাহেব’রা। ইংরেজ অধ্যুষিত ভারতের একসময়কার রাজধানী কলকাতার বুকে যত্রতত্র ছড়িয়ে আছে ঔপনিবেশিকতার ছাপ। কোথাও মাথা উঁচু করে সগৌরবে দাঁড়িয়ে আছে লর্ড কার্জনের মূর্তি, আবার কোথাও সন্ধান মিলবে লর্ড  অকল্যান্ডের। এমতাবস্থায় তৎকালীন যুক্তফ্রন্টের অন্যতম শরিক ভারতের কমিউনিস্ট পার্টি (মার্ক্সবাদী) ভাবল, এই ঔপনিবেশিক বাতাবরণের এক বিকল্প আখ্যান তৈরি হওয়া দরকার। এরপর একে একে বহু ঔপনিবেশিক প্রভুর মূর্তি সরিয়ে তার জায়গায় বসানো হল ভারতের স্বাধীনতা সংগ্রামী বা মনীষীদের মূর্তি। যেমন ধরা যাক, নর্থব্রুকের জায়গায় এলেন সূর্য সেন, লর্ড কার্জনের জায়গা নিলেন শ্রী অরবিন্দ। রাজভবনের ঠিক বিপরীতে ছিল পঞ্চম জর্জের একটা মূর্তি। তাকে সেখান থেকে সরিয়ে তার জায়গায় গড়ে তোলা হল বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের মূর্তি। তারপর  বঙ্কিম পাকাপাকিভাবে আকাশবাণী ভবনের উল্টোদিকেই থেকে গেলেন।

ধর্মতলার মোড়ে লেনিন

তপতী গুহ ঠাকুরতা একবার দেবীপ্রসাদ রায়চৌধুরীর তৈরি সুরেন্দ্রনাথ বন্দ্যোপাধ্যায়ের মূর্তির সন্ধানে কার্জন পার্কের আশেপাশে ঘোরাফেরা করছিলেন। বহুক্ষণ কেটে গেছে, সুরেনবাবু দেখা দিচ্ছেন না। এমন সময় সুরেন বন্দ্যোপাধ্যায়ের পরিবর্তে তপতী সন্ধান পেলেন ক্যালকাটা ট্রান্সপোর্ট কর্পোরেশনের এক বৃদ্ধ কর্মচারীর। তিনি বেশ আগ্রহ নিয়ে তাঁর সঙ্গে গল্প জুড়ে দিলেন।  কথাবার্তা চালাতে চালাতেই তপতী জানতে পারলেন ও তল্লাটে সুরেন্দ্রনাথ ছাড়াও বহু ভারতীয়ের মূর্তি রয়েছে। যেমন ধরা যাক রানি রাসমণি। এমনকী একজন সাহেবের মূর্তিও নাকি ভদ্রলোক দেখেছেন সেখানে।  সাহেবের মূর্তি তো এখানে কেন! অ

বশেষে জানা গেল তিনি ভ্লাদিমির লেনিনের কথা বলছিলেন। ১৯৭০ সালে কলকাতার ইডেন গার্ডেনে বড় করে লেনিনের ১০০ তম জন্মদিন উদযাপন করেন পশ্চিমবঙ্গের বামপন্থীরা। সে সময় সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়, এরপর থেকে ধর্মতলা স্ট্রিটের নাম হবে লেনিন সরণি। এবং শুধু তাই নয়, ধর্মতলার ঠিক মধ্যিখানে লেনিনের একটা বিরাট মূর্তি তৈরির সিদ্ধান্তও নেওয়া হয়। অবশেষে ১৯৭২ সালে মূর্তি উন্মোচিত হয়। তারপর থেকেই লেনিন কলকাতার বাসিন্দা।

ভিক্টোরিয়ার কালো পরী

সমস্ত দিনের শেষে ক্লান্ত দণ্ডবায়স উড়ে এসে বসে ভিক্টোরিয়ার মাথায়। আহ্লাদী দৃষ্টিতে তাকায় পরীর দিকে। পরী অভিমানে মুখ ফিরিয়ে নেয়। এমন দৃশ্যের বর্ণনাই দিয়েছিলেন সাহিত্যিক নবারুণ ভট্টাচার্য। বিশ শতকের তিরিশের দশক থেকে ভিক্টোরিয়ার পরী দাঁড়িয়ে আছে, হাতে একটা কালো বাঁশি নিয়ে। তাকে ঘিরে গড়ে উঠেছে হরেক রকমের উদ্ভট গল্প। ভিক্টোরিয়া মেমোরিয়ালের এই  আকর্ষণ তৈরির দায়িত্ব দেওয়া হয় বিলেতের এইচ এইচ মার্টিন কোম্পানি কে। সেই কোম্পানির প্রধান স্থপতি ছিলেন রবার্ট লিন্ডসে ক্লার্ক। তাঁর নেতৃত্বেই গড়ে ওঠে ১৬ ফুটের এই ব্রোঞ্জের মূর্তি। লিন্ডসে কে নিয়ে বিস্তারিত কোনও তথ্য পাওয়া যায় না, তবে ১৯২৬ সালে ‘ইকো’ নামক এক পত্রিকায় তাঁকে নিয়ে একটা খবর প্রকাশিত হয়। কলকাতার বেগানা ‘অ্যাঞ্জেল অফ ভিক্টরি’ আসলে কার হাতে সেজে উঠেছিল, তার সন্ধান করতে গেলে এই ‘ইকো’ই সম্ভবত একমাত্র সম্বল।

টালিগঞ্জ মোড়ের ‘মহানায়ক’

চল্লিশের দশকের কথা। মেদিনীপুরের কালিন্দী গ্রামে পড়াশুনো করতে পাঠানো হল নিরঞ্জন নামে এক কিশোর কে। সেখানকার অল্পবয়সী ছেলে-মেয়েদেরর সঙ্গে নিরঞ্জনের দিন কেটে যেত আনন্দে। কালে কালে তাঁর বয়স বাড়ল। এক সময় নিরঞ্জন ঠিক করলেন, ধরা-বাঁধা চাকরি তিনি করবেন না। শিল্পী হবেন, পাথর কেটে মূর্তি তৈরি করবেন। অথচ তাঁর বাড়িতে সকলেই চান তিনি চাকরি করুন। অভাবের সংসার, এর মধ্যে ছেলে চাকরি করে দু পয়সা রোজগার না করলে চলবে কেমন করে? নিরঞ্জন জেদ ধরেই রইলেন। এক প্রতিবেশীর কাছ থেকে ১০ টাকা ধার করে তিনি  কলকাতা চলে এলেন। ভর্তি হলেন গভর্নমেন্ট আর্ট কলেজে। সে সময় তাঁর শিক্ষক ছিলেন কিশোর রায়, গোপাল ঘোষের মতো ব্যক্তিরা। সারাদিন কলেজে ক্লাস করেন নিরঞ্জন, রাতে বাড়ি ফিরে কোনো দিন খাওয়া জোটে, কোনো দিন জোটে না। সেই নিরঞ্জনই পরবর্তীকালে ব্রিস্টল ক্যাথিড্রলের সামনে তিনি রাজা রামমোহন রায়ের একটা পেল্লায় মূর্তি তৈরি করেছিলেন। সেখান থেকেই নিরঞ্জন প্রধানের নাম দিকে দিকে ছড়িয়ে  পড়ল। তারপর একে একে সত্যজিৎ রায়-সহ আরও নানা বিখ্যাত মানুষজনের মূর্তি গড়ে তিনি পাথরে প্রাণ প্রতিষ্ঠা করলেন। অবশেষে ২০০৪ সালে টালিগঞ্জ মোড়ে মহানায়ককে সম্মান জানাতে তিনি উত্তম কুমারের একটা পূর্ণাঙ্গ মূর্তি তৈরি করেন।

এভাবেই কলকাতার দৈনন্দিন জীবন যাপনের সঙ্গে মিশে গেছে তার মূর্তিরা। দিন যায়, তাদের পাশ কাটিয়ে হুহু করে বয়ে চলে অসহায় সময়। কলকাতা পাল্টে যায় দ্রুত। তার বুকের উপর গড়ে ওঠে নতুন নতুন মল, মাল্টিপ্লেক্স। তবু তারা থেকে যায়।

 

তথ্যঋণঃ Under My Wings A Wind – Telegraph

Banishing Visual Reminders of Subjugation In Kolkata – Wire

More Articles