এই স্টিয়ারিংয়ে হাত রাখতেন হেমন্ত মুখোপাধ্যায়, এখন কেমন আছে নীলু?
তখন দেশ সবে স্বাধীন হয়েছে। ভারতে, গাড়ির রাজ্যে, উত্তরপাড়ার রাজকুমার অ্যাম্বাসাডরের তখনও অভিষেক হয়নি; তাই কলকাতার রাস্তা দাপিয়ে বেড়াচ্ছে মার্কিন আর ইংলিশ মোটরগাড়ি। আমেরিকান গাড়ির মধ্যে ক্যাডিল্যাক, বুইক, ডজ, হাডসন, পন্টিয়াক, ন্যাস, স্টুডিবেকার, লাস্যাল আর ওল্ডসমোবিলের রাস্তাজুড়ে রাজত্ব চলছে। এছাড়া ফোর্ড তো আছেই। ইংলিশ গাড়ির মধ্যে অস্টিন, মরিস আর মাঝে মাঝে রোলস রয়েস, রোভারের আনাগোনা।
কলকাতার পুলিশ কমিশনার চড়তেন ডজ কিংসওয়ে। এখন গাড়িটি পুলিশের সংগ্রহশালাতে সাজানো আছে। রাজ্য পুলিশের সর্বোচ্চ কর্তা চড়তেন জার্মান গাড়ি 'ওপেল'। পশ্চিমবঙ্গে মুখ্যমন্ত্রী ড. বিধানচন্দ্র রায় চড়তেন বুইক আর কলকাতার বাইরে গেলে বদ্যিনাথ ভট্টাচার্যর ক্যাডিল্যাক।
টালিগঞ্জ স্টুডিওপাড়াতেও নানা বাহারি গাড়ি নজরে পড়ত। নিউ থিয়েটার্সে দুর্গাদাস বন্দ্যোপাধ্যায় আসতেন হুডখোলা এম.জি চড়ে। প্রমথেশ বড়ুয়া সাহেবের ছিল বুইক সুপার এইট। যমুনা বড়ুয়া আর চন্দ্রাবতী দেবী আসতেন ফোর্ড আর উলস্ লে চড়ে, বা কখনও ওল্ডসমোবিলে। কলকাতার ট্যাক্সি ছিল পন্টিয়াক, হাডসন, ফোর্ড বা শেভ্রোলে।
তিনি তখন বেশ নাম করেছেন। ১৯৪৮ সালে, সুকান্ত ভট্টাচার্যর লেখায়, সলিল চৌধুরীর সুরে 'রানার' বাংলা আধুনিক গানের জগতে এক ইতিহাস তৈরি করল। পরের বছর, অর্থাৎ, ১৯৪৯-এর পুজোতে প্রকাশিত হল ১৯৪৩-এর দুর্ভিক্ষের পটভূমিতে সলিল চৌধুরীর লেখা 'কোনও এক গাঁয়ের বধূর কথা তোমায় শোনাই শোনো, রূপকথা নয় সে নয়'। সুপারডুপার হিট! মিত্র ইন্সটিটিউশনের হেডমাস্টারমশাই মুকুন্দবাবু যে ছাত্রকে স্কুল থেকে বের করে দেবেন বলে সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন ক্লাসে গান গাওয়ার অপরাধে, সেই হেমন্ত এখন হেমন্ত মুখোপাধ্যায়। শুরু হল হেমন্ত-যুগ। ব্যাকব্রাশ করা চুল, হাতা-গোটানো শার্ট আর ধুতি, চোখে কালো ফ্রেমের চশমা; তিনি তখন বাঙালির 'কাল্ট ফিগার'। ১৯৫০-এ বের হল সলিল চৌধুরীর সুরে 'অবাক পৃথিবী অবাক করলে তুমি' আর 'বিদ্রোহ আজ বিদ্রোহ চারিদিকে'। আর কোনওদিন পিছন ফিরে তাকাতে হয়নি হেমন্তকে। 'অনেক আগে যেমন ছিলেন এখন আছেন তেমনত/ বাংলাদেশের মনের মানুষ গানের রাজা হেমন্ত/ হাত গোটানো শার্ট ও ধুতি একই রকম বসন ত/ নাম হেমন্ত হলে কি হয়/ কণ্ঠে চিরবসন্ত।'
হেমন্ত মুখোপাধ্যায় তখন ভবানীপুরের ইন্দ্র রায় রোডে থাকেন। ১৯৫০-এ কিনে ফেললেন এক আমেরিকান ঢাউস গাড়ি, প্লাইমাউথ। মেরিন ব্লু রঙের গাড়িটি হেমন্তবাবুর পয়মন্ত গাড়ি। হেমন্ত তখন হয়ে উঠেছেন হেমন্ত কুমার। নাগিনের তালে দেশ দুলছে। সঙ্গে সঙ্গে 'অগ্নিপরীক্ষা', 'শাপমোচন', 'সপ্তপদী', 'ইন্দ্রাণী'-তে উত্তমকুমারের লিপে সুপারডুপার হিট গান। বেসিক রেকর্ডে 'পথ হারাব বলে এবার', 'আমায় প্রশ্ন করে নীল ধ্রুবতারা' আর 'আমি ঝড়ের কাছে রেখে গেলাম'। অন্যদিকে, 'বেকারার করকে হামে' আর 'হ্যায় আপনা দিল' তাঁকে ভারতজোড়া খ্যাতি এনে দিয়েছে।
বম্বে থেকে কলকাতাতে এলেই সঙ্গী প্লাইমাউথ। কখনও ছেলেবেলার বন্ধু কবি সুভাষ মুখোপাধ্যায় বা সমরেশ রায়কে নিয়ে গাড়ি ছোটে কলকাতার বাইরে, স্ত্রী বেলা আর ছোট্ট ছেলে-মেয়েরও খুব পছন্দের গাড়ি ছিল এটি। মাঝে মাঝে দেখা যেত দক্ষিণ কলকাতা থেকে উত্তরে প্লাইমাউথ ছুটে চলেছে। চালকের মুখে সিগারেট, গাড়ির ছাদে তাল দিতে দিতে এক হাতে স্টিয়ারিং ধরে অবলীলায় গাড়ি চালাচ্ছেন হেমন্ত।
১৯৭০ থেকে তেলের দাম বাড়তে শুরু করল। বড় গাড়ি ছেড়ে হেমন্ত সাদা ফিয়াটে অভ্যস্ত হয়ে গেছেন। সাতের দশকের শেষের দিকে হেমন্ত তাঁর সেই বিখ্যাত প্লাইমাউথ গাড়িটি বিক্রি করে দেন সুপ্রভাতচন্দ্র লাহিড়িকে। সুপ্রভাতবাবু এই গাড়িটি কয়েক দশক ব্যবহার করেন। তারপর কালের প্রবাহে কলকাতার প্রায় সব বড় গাড়ি বসে পড়ে; এবং মেরিন ব্লু প্লাইমাউথ তার ব্যতিক্রম নয়।
সুপ্রভাতবাবুর ইঞ্জিনিয়ার সন্তান স্বপন লাহিড়ি মশাইয়ের জাদুস্পর্শে প্লাইমাউথ আবার তার সজীবতা এবং স্বকীয়তা ফিরে পেয়েছে। গাড়ি-মহলে প্লাইমাউথের নাম- 'নীলু'। এই নীলুতে চড়েই একদিন স্বপনবাবু নববধূকে লাহিড়ি পরিবারে এনেছিলেন। সেও এখন ইতিহাস!
নীলুর তখন স্থান হয়েছে রাজপুরের বাড়িতে আর স্বপনবাবু চাকরি নিয়ে মধ্যপ্রাচ্যে। প্রায় ৩৫ বছর ধরে স্বপনবাবুর ঐকান্তিক প্রচেষ্টায় নীলুর স্বাস্থ্য অটুট রাখা সম্ভব হয়েছে। গাড়ির ইঞ্জিন প্লাগ অবধি ২০w মোবিলে চুবিয়ে রাখা হয়েছিল। প্রতি বছর দেশে ফিরে স্বপনবাবু মোবিল চেক করতেন আর প্রতি পাঁচ বছর পরে পুরোনো মোবিল ফেলে নতুন মোবিল দেওয়া হত। এর ফলে গাড়ির ইঞ্জিন সচল রইল।
২০১৬ সালে চাকরি থেকে অবসর নেওয়ার পরে স্বপনবাবুর ধ্যানজ্ঞান হল নীলুকে আবার সচল করা।
পুরনো গাড়ির মিস্ত্রি পাওয়া খুব কঠিন। এখনকার মিস্ত্রিরা কারাবোরেটর, ডিস্ট্রিবিউটার, পয়েন্ট জানে না। শার্লক হোমসের মতো স্বপনবাবু মিস্ত্রি খোঁজা শুরু করলেন এবং পেয়ে গেলেন ধনঞ্জয় দাসকে। মজার ব্যাপার, এই গাড়িটি যতদিন হেমন্তবাবুর কাছে ছিল, তার দেখভাল করতেন এই ধনঞ্জয় দাস।
ধনঞ্জয়বাবুর বয়স এখন ৭৫ বছর কিন্তু 'স্যারের গাড়ি' সারাতে হবে শুনে তিনি রাজি হলেন। ইলেকট্রিকের কাজের জন্য সহায়তা পেলেন বিখ্যাত মিস্ত্রি গুণোবাবুর। ৮০ বছরের গুণোবাবুর গ্যারেজ ল্যান্সডাউন মার্কেটের উল্টোদিকে। এই শহরের যাঁরা পুরোনো গাড়ির চর্চা করেন, গুণোবাবুকে তাঁরা সবাই চেনেন।
প্লাইমাউথের ইঞ্জিন কখনও খোলা হয়নি। ইঞ্জিন, ক্লাচ, ব্রেক সারিয়ে নীলু নতুন জীবন পেল। স্বপনবাবু এবং বৃদ্ধ মেকানিকদের লড়াই সফল হল, যেদিন নীলু ৩৫ বছর পরে বাড়ির বাইরে বেরল। গাড়িটির অরিজিনালিটি রাখার জন্য ছয় ভোল্টের ব্যাটারি ব্যবহার করা হয়েছে। হেডলাইট ছয় ভোল্টের সিলড বিম। স্বপনবাবু মাথা খাটিয়ে ইলেকট্রিক্যাল সার্কিটটি তৈরি করেছেন। একেবারে দেশি প্রযুক্তিতে প্রাণ পেয়েছে নীলু।
আরও পড়ুন-বয়স ১০৯, আজও কলকাতার রাস্তায় দাপিয়ে বেড়াচ্ছে এই ‘অযান্ত্রিক’
রাজপুর থেকে বারুইপুর বাইপাসে নীলুকে প্রায়ই দেখা যায়। শব্দহীন ইঞ্জিন, মেরিন ব্লু রঙ, লাহিড়িদার হাতের জাদুর ছোঁয়াতে নতুন রঙ পেয়েছে নীলু। নীলু যদি কথা বলতে পারত, হয়তো বলত, এই গাড়িতে বসে কোনও রোদঝলমল দিনে হেমন্ত গুনগুণ করে গাইতেন 'ও আকাশ সোনা সোনা' অথবা কোনও সন্ধ্যায় গেয়ে উঠতেন, 'ও শাম কুছ আজিব থি'।
নীলু চলছে তো চলছে। ক্লান্তিহীন যাত্রা। এই পথ যদি না শেষ হয় তবে কেমন হত তুমি বলো তো- এই প্রশ্ন করলে নীলু বলে ওঠে, তুমিই বলো। আর চলতে থাকে অনন্তের দিকে।