পরমহংস রামকৃষ্ণ থেকে নেতাজি: সকলের প্রিয় তেলেভাজার দোকান ছড়িয়ে এই শহরেই

সেরা টেস্টের দৌড়ে যারা ইঞ্চিখানেক এগিয়ে তাদের হালহদিশ রইল। কলকাতার প্রথম সারির কয়েকটি চপের দোকানের সুলুকসন্ধান রইল এখানে।

ঘেমো গরম, মন ছুটে যায় ঠান্ডায় গলা ভিজিয়ে নিতে। কিন্তু একথা বলাই বাহুল্য যে, বিকেল হলে আমবাঙালির মন তেলেভাজার কড়াইয়ের দিকে বোল্টের গতিতে ছুটে যায়। ডুবন্ত তেলে চুপচুপে তেলেভাজার অনুষঙ্গ ছাড়া বাঙালির বৈকালিক আড্ডা জমে ওঠে না। শ্রীশ্রীরামকৃষ্ণ, বিবেকানন্দ এবং নেতাজির বড্ড প্রিয় খাবার ছিল তেলেভাজা। সময় গড়িয়েছে। বাঙালির টিফিন তালিকায় বহুদিন আগেই ঢুকে পড়েছে পিৎজা, বার্গার, স্যান্ডউইচের মতো বিদেশি খাবার। কিন্তু তেলেভাজার কদর আজও কমেনি।


বর্ষা যখন দোরগোড়ায়, বাঙালির তখন দুটো খাবারের কথা মনে আসবেই আসবে। এক, খিচুড়ি, দুই হল তেলেভাজা। ভাবুন তো, মুষলধারে বৃষ্টি হচ্ছে। ঘর ঘুটঘুটে অন্ধকার, হাড় হিম করা ভূতের গল্প, আর আপনি তখন মুড়ির সঙ্গে গরম গরম বেগুনি-পিঁয়াজি সহযোগে চা-পর্ব সারছেন। জমে উঠবে না বিকেলটা! এই বিশেষ খাবারটির প্রতি বাঙালির দুর্বলতা বহুকালের। তবে তেলেভাজা মানে শুধুই বেগুনি আর আলুর চপ নয় কিন্তু! কত ভ্যারিয়েশন তাতে। রয়েছে পিঁয়াজি, ফুলুরি, মোচার চপ। রয়েছে পনিরের চপ এবং মাছের চপের মতো ফ্রাইও। এমনকী, হালফিলের ফুলকপি, লঙ্কা, টোম্যাটোর সঙ্গে মটন চপ এবং ভেটকির চপও বঙ্গজীবনের দাবিদার হয়ে উঠেছে!

 

তেলেভাজার কথা উঠলে হাইজিন, স্বাস্থ্য সচেতনতার মতো এলিট কথাকে স্ট্রেট ড্রাইভে বাউন্ডারির বাইরে পাঠিয়ে দিতে ওস্তাদ বাঙালি। এই শহরের প্রায় প্রতি গলি বা ফুটপাথজুড়ে এই অনির্বচনীয় স্বাদ তার পশরা সাজিয়ে বসে থাকে। সবাই এক সেবার কর এক। সেরা টেস্টের দৌড়ে যারা ইঞ্চিখানেক এগিয়ে তাদের হালহদিশ রইল। কলকাতার প্রথম সারির কয়েকটি চপের দোকানের সুলুকসন্ধান রইল এখানে।

 

আরও পড়ুন: গরমে হাঁসফাঁস, প্রাণজুড়োনো কলকাত্তাইয়া সরবতের সেরা ঠিকানা

 


লক্ষ্মীনারায়ণ সাউ অ্যান্ড সন্স

কলকাতার ঐতিহ্যশালী তেলেভাজার দোকানগুলোর মধ্যে অন্যতম হল এটি। ১৯১৮ সালে খেদু সাউ নামে এক ব্যক্তির হাত ধরে এই চপের দোকানের যাত্রা শুরু। সে সময় ছোট্ট ঝুপড়িতে ব্যবসা শুরু করে খেদু, যা আজ কলেবরে অনেকটাই বেড়েছে। শোনা যায়, সে সময় খেদু সাউয়ের চপের দোকানে ভিড় জমাতেন অনেক স্বাধীনতা সংগ্রামীও! এমনকী, নেতাজিও নাকি এই দোকানে প্রায়ই তেলেভাজা খেতে আসতেন। তাই তো আজও নেতাজির জন্মদিনে খেদু সাউয়ের উত্তরসূরিরা বিনামূল্যে নানা স্বাদের চপ খাইয়ে থাকেন পথচলতি মানুষদের। জহর রায় এবং ভানু বন্দ্যোপাধ্যায়ের মতো বিখ্যাত অভিনেতাদেরও নাকি পায়ের ধুলো পড়েছে এই দোকানে। বুঝতেই পারছেন, এমন বিখ্যাত তেলেভাজার দোকানে একবার ঢুঁ না মারলেই নয়!

ঠিকানা: ১৫৮ বিধান সরণি, কলকাতা।

মাস্ট ট্রাই: এখানকার আলুর চপ এবং পিঁয়াজি খুব মুখরোচক। আবার ভেজিটেবল চপ এবং আমের চপও খেতে মন্দ নয়।

 


কালিকা

আজ থেকে প্রায় ৫০ বছর আগে, কালীপুজোর দিন এই দোকান খোলা হয়। তাই দোকানের নাম কালিকা। শিয়ালদহ-কলেজ স্ট্রিট চত্বরে কালিকার তেলেভাজার জনপ্রিয়তা আকাশছোঁয়া। এর পিছনে একটা কারণ যদি হয় চপের স্বাদ, তা হলে দ্বিতীয় কারণটা অবশ্যই চপের সাইজ! অন্যান্য তেলেভাজার দোকানে যে আকারের বেগুনি-আলুর চপ পাওয়া যায়, তার চেয়ে ঢের বড় কালিকার চপ। আর এই দোকানের ইউএসপি হলো আমিষ তেলেভাজা। চিংড়ির কাটলেট থেকে ভেটকির চপ, নানা স্বাদের সমাহার ঘটেছে এখানে।

ঠিকানা: ২৯ সূর্য সেন স্ট্রিট। কলেজ স্কোয়্যার থেকে কিছুটা এগিয়ে ডান দিকে।

মাস্ট ট্রাই: ডিমের ডেভিল এবং ভেটকির চপ। এখানকার আলুর চপ এবং মোচার চপও বেশ জনপ্রিয়।

 


মুখোরুচি

কলকাতার চপের দোকান নিয়ে যখন আলোচনা, তখন মুখোরুচি-র নাম না করলেই নয়। এখানকার তেলেভাজা নাকি রামকৃষ্ণ পরমহংসদেবের খুব প্রিয় ছিল! নাট্যকার গিরিশ ঘোষও নাকি প্রায়ই ঢুঁ মারতেন এই চপের দোকানে! আজ থেকে বেশ কয়েক দশক আগে ফাগুলাল সাউ শুরু করেন এই চপের দোকান, যার জনপ্রিয়তা আজও একটুও কমেনি।

ঠিকানা: বরাহনগরের গোপাল লাল ঠাকুর রোডের কাছে।

মাস্ট ট্রাই: এখানকার আলুর চপ এবং ফুলুরি বেজায় মুখরোচক।

 


পটলার চপের দোকান

উত্তর কলকাতার বাসিন্দাদের কাছে এটা খুবই চেনা নাম। বাগবাজার স্ট্রিটের এই তেলেভাজার দোকানটি আজ থেকে প্রায় নব্বই বছর আগে খোলা হয়। শুরু করেন শশিভূষণ সেন নামে এক ব্যক্তি। সেই থেকেই সুনামের সঙ্গে ব্যবসা করে আসছে পটলার চপের দোকান। এই দোকানে শুধুমাত্র নিরামিষ চপ বিক্রি হয়। অর্থাৎ কলকাতার বাকি চপের দোকানগুলোতে যেখানে আলুর চপ আর বেগুনির পাশাপাশি দেদার বিকোচ্ছে মটন এবং মাছের চপ, সেখানে পটলার চপের দোকানে আলুর চপ, ভেজিটেবল চপ, মোচার চপ এবং পটলের চপ লাইন দিয়ে কিনছেন স্থানীয়রা।

ঠিকানা: ১৮ সি বাগবাজার স্ট্রিট।

মাস্ট ট্রাই: আলুর চপ ও ভেজিটেবল চপ

 

কলকাতার অলিগলি ও তেলেভাজা

কলকাতার গলি থেকে রাজপথ। সর্বত্রই তেলেভাজার রমরমা। বাঙালির খাদ্যসংস্কৃতির বদল হয়েছে, তবে তেলেভাজাকে বোল্ড আউট করতে পারেনি পিৎজা, বার্গার। তাই অলিগলির দোকানগুলোতে চেয়ে থাকা আলুর চপ, ফুলুরি আপনাকে টানবে না, তা হয় নাকি! বিকেলের স্ট্রিট ফুডের প্রধান জায়গা দখল করে থাকে তেলেভাজা। আর সেই দোকানের সামনে উৎসাহী মানুষের ভিড়।

 

ডাল বড়া:

অনেক দোকানেই দেখতে পাবেন এই দৃশ্য, গরম গরম ভেজে তোলা হচ্ছে, কাঁচালঙ্কার ঝাল দেওয়া ছোলার ডালের বড়া। কালো রঙের লোহার কড়াইয়ে তেলে ভেজে তুলছে ছোট ছোট বড়া। নোনতা আর ঝাল স্বাদ দারুণ।

 

পিঁয়াজি, আলুর চপ, বেগুনি:

উত্তর কলকাতার অলিগলিতে ছোট-বড় নানা মাপের দোকান তেলেভাজার জন্য বিখ্যাত। কাচের বাক্সের একদিকে ডাঁই করে রাখা পিঁয়াজি, আলুর চপ, বেগুনির সে কী মনভোলানো স্বাদ!

 


সিঙাড়া:

সিঙাড়ার জন্য মেঘলা দিনে কখনও প্রাণ কাঁদেনি, এমন বাঙালি নেই। গরম গরম ধোঁয়া ওঠা চায়ের সঙ্গে গরমাগরম সিঙাড়ার জবাব নেই। এর বিকল্প বাঙালি আজও খুঁজে পায়নি।

যেভাবে গত কয়েক শতাব্দী ধরে এই তেলেভাজার দোকানগুলো মাথা উঁচু করে ব্যবসা করে যাচ্ছে, তাতে একথা না বললেই নয় যে, ফাস্ট ফুডের এমন জনপ্রিয়তার মাঝেও বাঙালি জীবনে তেলেভাজার কদর কিন্তু আজও একটুও কমেনি। আর কমবে বলেও মনে হয় না।

More Articles