গরমে হাঁসফাঁস, প্রাণজুড়োনো কলকাত্তাইয়া সরবতের সেরা ঠিকানা
এছাড়াও কলকাতার আনাচ-কানাচে ছড়িয়ে আছে এমন বহু দোকান, যাদের সরবৎ যে কোনও নামকরা দোকানের সঙ্গে পাল্লা দিতে পারে।
গরমে নাজেহাল অবস্থা কলকাতাবাসীর। এই অবস্থায় দু'দণ্ড শান্তির মতোই যেন দাঁড়িয়ে আছে কলকাতার সরবতের দোকানগুলো। কলকাত্তাইয়া সরবতের সেরা স্বাদ গ্রহণ করতে গেলে সরবৎ-প্রেমীদের পৌঁছে যেতে হবে সে সমস্ত ঠিকানায়।
প্যারামাউন্ট: প্রেসিডেন্সি বিশ্ববিদ্যালয়ের উল্টোদিকের রাস্তা ধরে কিছু দূর এগোলেই বাঁহাতে পড়বে কলেজ স্কোয়ার। তার ঠিক পাশেই দাঁড়িয়ে আছে একশো বছরের পুরনো দোকান ‘প্যারামাউন্ট’। গরমের দিনে এই ছোট্ট সরবতের দোকানে বসার জায়গা পাওয়া ভাগ্যের ব্যপার। অষ্টপ্রহর সেখানে কলেজপড়ুয়া থেকে আরম্ভ করে পথচলতি মানুষের ভিড় লেগেই থাকে। ১৯১৮ সালে পূর্ববঙ্গের বরিশাল থেকে নীহাররঞ্জন মজুমদার নামে এক ব্যক্তি কলকাতা এসেছিলেন জীবিকার সন্ধানে। প্রথম জীবনে নীহারবাবু অনুশীলন সমিতির সদস্য ছিলেন। বরিশাল থেকে কলকাতা এসে তিনি একটা সরবতের দোকান খুললেন। সেই দোকানের নাম দিলেন ‘প্যারামাউন্ট’। সরবৎ বিক্রির পাশাপাশি এই দোকানের পিছনদিকের একটা ঘরে সেসময়ে বিপ্লবীদের গোপন বৈঠক চলত। আজকের দিনেও ‘প্যারামাউন্ট’ সেই ইতিহাস সযত্নে বহন করে চলেছে। দূর-দূরান্ত থেকে মানুষ এই দোকানের ‘ডাব মালাই’-এর স্বাদ গ্রহণ করতে আসে। যুগ যুগ ধরে 'প্যারামাউন্ট' হয়ে এসেছে বাংলার বহু কবি-সাহিত্যিকের পছন্দের ঠিকানা।
চারু মার্কেটের চকোলেট চা: দুপুরের রোদে ফাঁকা হয়ে আসে 'ভবানী' সিনেমার সামনেটা। টিপু সুলতান শাহি মসজিদের দিক থেকে ভেসে আসে ‘ধূসর শূন্যের আজান গান।’ তারই মধ্যে রবীন্দ্র সরোবর মেট্রো স্টেশনের প্রবেশদ্বারের পাশে ছোট্ট একটা দোকানে দেদার বিক্রি হয় চকোলেট চা। এই দোকানের কোনও নাম নেই। মানুষ একে ‘চকোলেট চায়ের দোকান’ হিসেবেই চেনে। চকোলেট চা ছাড়াও এই দোকানে পাওয়া যায় নানা ধরনের কফি এবং লস্যি। এর আগে লস্যি বলতে কলকাতাবাসী বুঝত দই-মিশ্রিত এক দুধ-সাদা পানীয়। চারু মার্কেটের এই সরবতের দোকানের দৌলতেই তারা পরিচিত হল চকোলেট লস্যির সঙ্গে। সাম্প্রতিককালে ইউটিউবের দৌলতে এই ‘চকোলেট চায়ের দোকান’ খুবই বিখ্যাত হয়ে উঠেছে।
আরও পড়ুন: বাঙালি ভুলেছে ঢাকাই পরোটার স্বাদ, রইল তার সেরা ঠিকানাগুলো
শিব-শক্তি সরবতের দোকান: উত্তর ভারতে হোলির সময় সিদ্ধি খাওয়ার চল রয়েছে। কলকাতাতেও সেই প্রচলন রয়েছে, তবে এখানে সিদ্ধির দোকানের বড় অভাব। সাদা সুতির কাপড়ে সবুজ পাতার নির্যাস ছেঁকে নিতে নিতে হোলির ছড়া কাটছে দোকানি, এমন চিত্র কলকাতায় খুবই কম দেখা যায়। অল্প কিছু দোকানেই কলকাতাবাসী সন্ধান পাবে সেরা সিদ্ধির সরবতের। আর তাদের মধ্যে অন্যতম হল ‘শিব-শক্তি সরবৎ শপ।’ সিদ্ধির সরবৎ ছাড়াও এই দোকানের অন্যতম আকর্ষণ হলো লস্যি। সকাল থেকে শুরু করে রাত পর্যন্ত এই দোকানে বিক্রি হয় হরেক কিসিমের লস্যি। বেনিয়াটোলায় অবস্থিত এই দোকানের লস্যি কলকাতার যে-কোনও বড় দোকানকে টেক্কা দিতে পারে।
কপিলাশ্রমের সরবৎ: সালটা ১৯০৭। ঠিক দু’বছর আগেই তৎকালীন বড়লাট লর্ড কার্জনের নির্দেশে ভাগ হয়েছে বাংলাদেশ। এই অবস্থায় হৃষিকেশ শ্রীমানী নামে এক ব্যক্তি উত্তর কলকাতার বিধান সরণির ওপর তৈরি করলেন বাংলার প্রথম সরবতের দোকান। একচালার সেই দোকানের নাম তিনি রাখলেন ‘কপিলাশ্রম’। কালে কালে এই দোকানই কলকাতার সেরা সরবতের দোকান হিসেবে জনপ্রিয় হয়ে উঠল। সময়ের সঙ্গে সঙ্গে হৃষিকেশবাবুর হাত থেকে দোকানের দায়িত্ব এসে পড়ল তাঁর পৌত্র প্রনবেন্দু শ্রীমানীর ওপর। কপিলাশ্রমের বৈশিষ্ট্য হলো, দইয়ের সরবৎ। লস্যি নিয়ে নানা ধরনের পরীক্ষা-নিরীক্ষা চালান তাঁরা। একসময় দোকানের সামনে সরবৎ খাওয়ার জন্য লম্বা লাইন পড়ত। কেউ কেউ আবার গাড়ি দাঁড় করিয়ে অপেক্ষা করতেন কপিলাশ্রমের সরবতের স্বাদ নেওয়ার জন্যে। এক সাক্ষাৎকারে প্রণবেন্দুবাবু জানিয়েছেন, আগে সরবতের দই তাঁদের বাড়িতেই পাতা হত। তারপর তাতে মেশানো হত ‘অরোরা কোম্পানি’-র সিরাপ। কালক্রমে সেই নিয়মে সামান্য কিছু পরিবর্তন এসছে ঠিকই, কিন্তু আজও কপিলাশ্রমই ‘ম্যাঙ্গো লস্যি’-র সেরা ঠিকানা।
এছাড়াও কলকাতার আনাচ-কানাচে ছড়িয়ে আছে এমন বহু দোকান, যাদের সরবৎ যে কোনও নামকরা দোকানের সঙ্গে পাল্লা দিতে পারে। সেই সমস্ত দোকানের নাম হয়তো অনেকেই জানে না। তবু গরমকাল এলেই বিকেলের পড়ন্ত রোদে তাদের শোকেসের ওপর থরে থরে সাজানো থাকে রং-বেরঙের নানা সরবতের বোতল।