সন্ধা রায়ের গাড়ি থেকে মিষ্টি চুরি করে খেলেন চিন্ময় রায়, বাস্তবেও তিনি সার্থক ‘টেনিদা’

Chinmoy Roy : ১৯৬৬ সালে তপন সিংহের পরিচালনায় ‘গল্প হলেও সত্যি’ ছবি দিয়ে প্রথম পা রাখেন রুপোলি পর্দায়। খুব ছোট একটি চরিত্র, আর তাতেই কিস্তিমাত

“একবার বলো উত্তম কুমার...”, না, উত্তম কুমার তিনি মোটেই ছিলেন না তবে বাঙালি প্রেমিকের উত্তম কুমার হওয়ার যে সুপ্ত বাসনা, তার নির্যাসটুকু তিনিই প্রথম সরাসরি বলেছিলেন। ‘বসন্ত বিলাপ’ ছবির এই অমোঘ সংলাপটি আজও অমলিন। অমলিন রোগা প্যাংলা, আপাত অসুন্দর চিন্ময় রায়ও। বেঁচে থাকলে আজ ৮২ বছর পূর্ণ করতেন সেকালের জনপ্রিয় অভিনেতা।

১৯৬৬ সালে তপন সিংহের পরিচালনায় ‘গল্প হলেও সত্যি’ ছবি দিয়ে প্রথম পা রাখেন রুপোলি পর্দায়। খুব ছোট একটি চরিত্র, আর তাতেই কিস্তিমাত। স্বল্প পরিসরেই নজর কাড়লেন দর্শকদের। আর ফিরে তাকাতে হয়নি থার্ড ডিভিশনে পাশ করা রোগাপটকা ছেলেটিকে। ‘বসন্ত বিলাপ’, ‘গুপী গাইন বাঘা বাইন’, ‘শ্রীমান পৃথ্বীরাজ’, ‘ধন্যি মেয়ে’, ‘চারমূর্তি’, ‘মৌচাক ’, ‘হাটে বাজারে’, ‘ঠগিণী’, ‘ফুলেশ্বরী’, ‘সূবর্ণ গোলক’, ‘ওগো বধূ সুন্দরী’— একের পর ছবিতে তিনি মাতিয়েছেন বাঙালি দর্শককে। নিজের একটা আলাদা স্টাইল স্টেটমেন্ট তৈরি করেছিলেন চিন্ময়। কিছু কিছু চরিত্রের জন্য চিন্ময় রায় ছাড়া অন্য কোনও বিকল্প খুঁজে পেতেন না পরিচালকরা। কমেডিকে এমনই মর্মে মর্মে আত্মস্থ করেছিলেন তিনি। এত সাবলীল অভিনয় যে, কোনও দিন জোর করে হাসতে হয়নি দর্শকদের।

আরও পড়ুন - গায়ে আঁটত না ‘বড়দের’ জামা! রবি ঘোষ যেভাবে রয়ে গেলেন বাঙালির মনে

নিতান্তই সাদামাটা চেহারা, অথচ অফুরন্ত হাস্যরস, চিন্ময় রায় মানেই একটা প্যাকেজ। যে ছবিতে যতটুকু চরিত্র পেয়েছেন নিজেকে সঁপে দিয়েছেন। তাবড় তাবড় অভিনেতাদের পাশেই নিজেকে প্রতিষ্ঠা দিয়েছেন দৃশ্যে। দৃশ্যে তাঁর হাঁটা চলা, কথা বলা কিছুতেই তিনি অনন্য। চোখের অদ্ভুত একটা কায়দা করতে পারতেন তিনি, কৌতুক এতে বেড়ে যেত কয়েক গুণ।

চিন্ময়বাবুর জন্ম বাংলাদেশের কুমিল্লায়। ১৯৪০ সালের ১৬ জানুয়ারি। দেশভাগের পর এপার বাংলায় চলে আসা। ছোটবেলাটা কেটেছে বরানগরের বাড়িতে। চেহারা রোগাসোগা হলে কী হবে খেতে ভালোবাসতেন বরাবর। আর ভালোবাসতেন জমিয়ে আড্ডা দিতে। তরুণ মজুমদার একবার এক সাক্ষাৎকারে বলেছিলেন, “চিন্ময় ভীষণ টিমম্যান ছিলেন, কলটাইমের অনেক আগেই চলে আসতেন। মেকাপ রুমে বসে বাকিদের সঙ্গে জমিয়ে আড্ডা দিতেন।” রুপোলি পর্দায় কমেডিয়ান হিসেবে জনপ্রিয়তা পেলেও অভিনয় জগতে চিন্ময়বাবুর শুরুটা হয়েছিল থিয়েটারের হাত ধরেই। নান্দীকারই ছিল তাঁর অভিনয় জীবনের ধারাপাত। যদিও এক সময় সে দল ছেড়ে দেন তিনি। চিন্ময়বাবুর কথায় “সেটাই ছিল আমার জীবনের টার্নিং পয়েন্ট।”

উমনাথ ভট্টাচার্যর পরিচালনায় চারমূর্তি ছবি, এই প্রথম নিছক একজন কমেডিয়ান থেকে ‘হিরো’র চরিত্র চিন্ময়ের। হিরো অর্থে কেন্দ্রীয় চরিত্র। চিন্ময় সেখানে টেনিদা। পটলডাঙার হিরো। সাহিত্যের পাতা থেকে এই চরিত্রকে দৃশ্যে জীবন্ত করে তুলেছিলেন তিনি। পটলডাঙার রোয়াকের আড্ডা থেকে শুরু করে প্যালা-হাবুল-ক্যাবলার সঙ্গে অমন রসায়ন, আর সর্বোপরি পেটুক ঠাকুর, সব যেন মোহময় ঠেকে আজও। এই ছবিতেই চিন্ময় চলন্ত ট্রেনে বাবাজির রসগোল্লার হাঁড়ি গায়েব করে দেন, অমোঘ সেই দৃশ্য। অবশ্য এ দৃশ্য তিনি বাস্তবেও একবার ঘটিয়েছিলেন। একবার একটি অনুষ্ঠানে অভিনেত্রী সন্ধ্যা রায়ের দিংয়ে গিয়েছেন চিন্ময় রায়। ফেরার সময় উদ্যোক্তারা সন্ধ্যা রায়ের গাড়িতে একটা মিষ্টির হাঁড়ি তুলে দিয়েছেন। ব্যাস তৎক্ষণাৎ টেনিদার চরিত্রে অবতীর্ণ হলে চিন্ময় রায়, চোখের নিমেষে গায়েব করলেন মিষ্টির হাঁড়ি। সিনেমার মতো বাস্তবেও পরে সন্ধ্যা রায়কে জানিয়েছিলেন আসল কীর্তিটা তিনিই ঘটিয়েছেন।

Actor Chinmoy Roy

'চারমূর্তি' ছবিতে পেটুক চিন্ময়

এমনটাই মহার মানুষ ছিলেন চিন্ময়। আর ছিলেন সোজাসাপটা। চেহারাতেই করব রোগা ছিলেন, মনে সাহস ছিল অফুরন্ত। পর্দায় হিরো হতে না পারলেও বাস্তব জীবনে হিরোর মতোই প্রবেশ করেন নায়িকার জীবনে। তরুণ মজুমদারের পরিচালনায় ‘বালিকা বধূ’ ছবিটি তখন সবে মুক্তি পেয়েছে। মৌসুমী চ্যাটার্জি ছাড়াও এই ছবিতে উঠে এল আরও এক নতুন মুখ। জুঁই বন্দ্যোপাধ্যায়। এই নবাগতা নায়িকাকেই মনে ধরে যায় চিন্ময়ের। ব্যাস আগে পিছু কিছু না ভেবেই সটান চলে গেলেন দেখা করতে। আর প্রথম দেখাতেই বিয়ের প্রস্তাব। নায়িকা হতবাক হয়েছিলেন ঠিকই তবে চিন্ময় জানতেন আসল সত্যিটা তা হল, ‘প্রেমে পড়লে বেশিদিন ফেলে রাখতে নেই। টুক করে কথা বলে নিতে হয়!’ পরে অবশ্য দুজনের চার হাত এক হয়েছিল। আর এমন হিরোর ভূমিকায় পরিবেশ করলে কজনই বা পারেন ফেরাতে!

আরও পড়ুন - উত্তমের সঙ্গে দারুণ ভাব, অথচ সুচিত্রাকে চলতেন এড়িয়ে, অনুপ কুমারকে কি ভুলেছে বাঙালি?

তবে চিন্ময় রায়ের সাহসের এটাই একমাত্র উদাহরণ নয়। শোনা যায়, তথাকথিত রাসভারী মহানায়িকা সুচিত্রা সেনের মেকাপ রুমে একবার ঢুকে পড়েছিলেন সটান। সুচিত্রা রীতিমত রেগে গিয়ে প্রশ্ন করেন, “কী চাই?” আর উল্টোদিকে চিন্ময় তখনও সাবলীল, ঠান্ডা গলায় উত্তর দিলেন, “আপনার সঙ্গে আলাপ করতে”। হ্যাঁ এমনটাই অবাক করা চরিত্র ছিলেন অভিনেতা চিন্ময়। নবদ্বীপ হালদার, ভানু বন্দ্যোপাধ্যায় বা তুলসী চক্রবর্তীর মতো কিংবদন্তি অভিনেতাদের ঠিক পরের পর্বে বাংলা ছবিতে কমেডিয়ানের ভূমিকায় রবি ঘোষ অথবা অনুপকুমারের সঙ্গে সমানে সমানে পাল্লাও দিয়েছেন তিনিও।

Actor Chinmoy Roy

'বসন্ত বিলাপ' ছবির অমোঘ দৃশ্য

কাজ পাগল লোক ছিলেন চিন্ময়। ছবির জগৎ থেকে বিরতি নেওয়ার পর ছোট পর্দায় পরের পর কাজ করে গিয়েছেন তিনি। ‘চুনী পান্না’ নামের একটি কৌতুক সিরিয়ালে মুখ্য ভূমিকায় নজির কাড়েন দর্শকদের। যতদিন শরীর সায় দিয়েছে ততদিন গিয়েছেন ফ্লোরে। ওখানেই যেন প্রাণের স্বাদ পেতেন চিন্ময়। তারপর দীর্ঘদিন ধরেই বার্ধক্যজনিত অসুখে ভুগছিলেন তিনি, তার ওপর নিজের ফ্ল্যাটের ছাদ থেকে বেকায়দায় পরে যান। সেটাই কাল হয়। আর ঘুরে দাঁড়াতে পারলেন না তিনি। প্রায় বছর চারেক আগে ৭৯ বছর বয়সে মারা যান এই বর্ষীয়ান অভিনেতা।

সন্ধ্যা রায় একবার বলেছিলেন, ভালো চরিত্রের খুব সাধ ছিল চিন্ময় রায়ের। বারবার চেয়েছিলেন কৌতুক অভিনয়ের সংজ্ঞা থেকে বেরোতে। কিন্তু সময় সেটা হতে দেয়নি। তাই হয়তো জীবনের সবটুকু সাধ উগড়ে দিয়েছিলেন ‘বসন্ত বিলাপ’ছবির ওই বিখ্যাত সংলাপে। আজও মুখে মুখে ফেরে সেটি। না উত্তমকুমার হওয়ার প্রয়োজন পড়ে না চিন্ময় রায়ের, তিনি নিজের নাম ভূমিকাতেই সার্থক।

More Articles