গায়ে আঁটত না 'বড়দের' জামা! রবি ঘোষ যেভাবে রয়ে গেলেন বাঙালির মনে
Rabi Ghosh: অভিনয় এবং ব্যক্তিগত জীবনের মধ্যে ছিল অনায়াস যাতায়াত, দুই চরিত্রেই সমান দক্ষ রবি ঘোষ
১৯৭৪ সাল, পুরোদমে শুটিং চলছে তরুণ মজুমদারের ‘ঠগিনী’ ছবির। ফ্লোরে পৌঁছাতে সেদিন বেশ খানিকটা দেরি হল রবি ঘোষের। তড়িঘড়ি যোগ দিলেন অভিনয়ে। অন্যদিনের মতো একই উদ্যমে তাক লাগানো অভিনয় করলেন। কোথাও বিন্দুমাত্র ছন্দ পতন নেই। প্যাক-আপ হয়ে যাওয়ার পরে অবশ্য জানা গেল, সকালে মা-কে দাহ করে আসতে গিয়েই দেরি হয়েছিল তাঁর। মুহূর্তে স্তব্ধ হয়ে যেতে হয় এ ঘটনার স্মৃতিচারণে। চার্লি চ্যাপলিন বলেছিলেন, “To truly laugh, you must be able to take your pain, and play with it.” তিনি আরও বলেছিলেন, “Life is a tragedy when seen in close-up, but a comedy in long-shot.” এই অমোঘ সমস্ত উক্তিগুলির সঙ্গে দৃশ্যত মানিয়ে যায় কিংবদন্তি রবি ঘোষের নাম। এ কি কেবল পেশাদারিত্ব নাকি অসম্ভব ভালোবাসা? উত্তর খোঁজার প্রয়োজন পড়ে না। অভিনয়কে আঁকড়ে ধরতে চেয়েছেন তিনি জীবনের প্রতিটা বাঁকে। তাতেই মুক্তি। এর জন্য কখনও বাবার অমতে গিয়ে বাড়ি পর্যন্ত ছেড়েছেন, কখনও আবার ছেড়েছেন আদালতের নিশ্চিন্ত চাকরিও।
মাত্র ৩০ সেকেন্ডের অভিনয়ের স্লট, ‘সংবাদপত্র বিক্রেতা’র চরিত্রে ধরা দিলেন রবি ঘোষ। সেই শুরু। অতটুকু সময়েই নজর কাড়লেন পরিচালক মৃণাল সেনের। এরপর অভিনেতা সত্য বন্দ্যোপাধ্যায়ের পরামর্শে যোগ দিলেন উৎপল দত্তের নাটকের দলে। তারপর থেকেই মঞ্চ অথবা পর্দা, চলতে থাকলো ঝোড়ো ইনিংস।
কখনও কঠিন বুনটের ঠেলায় নাভীশ্বাস ওঠার জোগার কোনো চিত্রনাট্যে এক চিলতে খোলা হাওয়া, কখনও আবার গল্পের আদ্যপান্ত পটভূমি জুড়ে রাজত্ব করা, রবি ঘোষ। ঠিক এভাবেই দাপিয়ে বেড়িয়েছেন টলিউড। কখনও হাসি, কখনও আবার হাসির আড়ালে লুকিয়ে রাখা সপাট জবাব, কঠিন বাস্তবেরা বরি ঘোষের হাত ধরেই ভিড় জমিয়েছে পর্দায়। ‘বাঘা’ থেকে ‘বিরিঞ্চি বাবা’, নিজেকে বারে বারে ভেঙে নতুন করে গড়েপিটে নিয়েছেন তিনি। বাংলা চলচ্চিত্র জগতের স্বর্ণযুগের ইতিহাস বলতে ঠিক যা বোঝায়, তেমনই এক অধ্যায়ের সরিক ছিলেন রবি ঘোষ। এমন কৌতুক অভিনেতা, লাখে একজন, যাঁর অনবদ্য অভিনয় ভঙ্গিতে আজও মন্ত্রমুগ্ধ আট থেকে আশি। সত্যজিৎ রায় অবশ্য সবসময় বলছেন তিনি মোটেই কেবল কৌতুক অভিনেতা ছিলেন না, পাশাপাশি ছিলেন যথার্থ একজন চরিত্রাভিনেতা।
আরও পড়ুন : ‘বল্লভপুরের রূপকথা’ ফিরিয়ে আনল বাংলা সিনেমার হারিয়ে যাওয়া ‘ভূত’
তাঁর বাবা বলেছিলেন, রবি ঘোষের চেহারা নাকি অভিনেতাদের মতো নয়। বলেছিলেন কারণ, তিনি তো জানতেন না, উত্তম-সৌমিত্রদের যুগেও তাঁর ছেলেই ভাঙতে পারবেন ‘স্টিরিওটাইপ’ তকমা। খুব পরিচিত সিনেমার ভাষ্যে রবি ঘোষই নিয়ে এসেছিলেন একটা অন্যরকম হাওয়া। যে হাওয়ার রেশ থেকে যায় বহু বহু বছর।
২৪ নভেম্বর ১৯৩১ সালে কোচবিহারে মামার বাড়িতে জন্ম গ্রহণ করেন রবি ঘোষ। পুরো নাম রবীন্দ্রনাথ ঘোষ দস্তিদার। পাঁচ ভাইবোনের মধ্যে দ্বিতীয় ছিলেন তিনি। ১৯৪৯ সালে সাউথ সাবার্বান মেন স্কুল থেকে ম্যাট্রিক পাশ করে ভর্তি হন দক্ষিণ কলকাতার আশুতোষ কলেজে। সেখান থেকেই বিজ্ঞান বিভাগে ইন্টার্ন পাশ করেন তিনি। পড়াশোনার পাশাপাশি শরীরচর্চাতেও দক্ষ ছিলেন রবি। নিয়মিত শরীরচর্চার শুরু কলেজের ব্যায়ামাগারেই। পরবর্তীকালে ‘জিম’ না গেলেও, মর্নিং ওয়াক এবং বাড়িতেই নিয়মিত ব্যায়াম করতেন। জানা যায়, অভিনয়ের আগে বডিবিল্ডার হতে চেয়েছিলেন রবি ঘোষ। অথচ জীবনের ওঠা-নামা কতোটাই বা পূর্ব নির্ধারিত হয়! তাই ‘বডিবিল্ডার’ হতে চাওয়া কালো, বেঁটে ওই লোকটা অচিরেই হয়ে গেলেন শোসটপার। সে যুগে মিনার্ভা থিয়েটার হাউসফুল করতেন একাই। লোকে বলাবলি করত, রবি ঘোষ মানেই ‘একাই একশো’।
রবি ঘোষ পরিচালনা করেননি কখনও, তবে সত্যজিৎ রায় বুঝেছিলেন রবি ঘোষ চাইলেই দৃশ্যের জন্ম দিতে পারেন। সন্দীপ রায় একজায়গায় লিখেছিলেন, “বাবা বলতেন, রবি তোমার যদি কিছু মনে হয় করতে পারো। আমার যদি ইন্টারেস্টিং মনে হয়, সেই শট আমি রেখে দেব।” ‘অভিযান’- ছবিতে মোষকে টপকে চলে যাওয়ার দৃশ্যটিও যেমন রবি ঘোষ করেছিলেন নিজে থেকেই। যা সযত্নে ছবিতে রেখে দিয়েছিলেন সত্যজিৎ রায়। ছোটো ছোটো মুহূর্ত তৈরি করে এমন চমক দিতে রবি ঘোষের মতো আর কজনই বা পারতেন!
অভিনয় জগতে ‘সিন স্টিলার’ ছিলেন তিনি। দৃশ্য চুরি করে নিতে পারতেন অনায়াসেই। পর্দায় যে মানুষটাকে দেখলে সহজেই হেসে ফেলতো দর্শক, ব্যক্তিগত জীবনে হতো তার ঠিক বিপরীত। ভয়ঙ্কর ব্যক্তিত্বসম্পন্ন রাশভারী গোছের একজন মানুষ ছিলেন রবি ঘোষ। প্রয়োজনের বাইরে একটি কথাও তিনি বলতেন না। শুনতে অবাক লাগলেও, এমনটাই অনায়াস যাতায়াত ছিল তাঁর পর্দার জীবন এবং ব্যক্তিগত জীবনের মধ্যে। তাঁর সম্পর্কে আরও একটা কথা বলেন পরিচালক সন্দীপ রায়, তিনি নাকি খেতে খেতেও অসাধারণ সংলাপ বলতে পারতেন। দুটো কাজই সমান দক্ষতায় চালিয়ে যেতেন পর্দায়, যেন প্রকৃত সব্যসাচী তিনিই। অবসরে রামকৃষ্ণ কথামৃত পড়ে সময় কাটাতেন। পড়তেন নানা নাটক-প্রবন্ধের বইও। প্রথম জীবনে কমিউনিজিমে দীক্ষিত হয়েও পরবর্তী কালে রামকৃষ্ণ-বিবেকানন্দ পড়তেন রবি। নিজে পূজার্চনা করতেন না ঠিকই তবে, অন্যের বিশ্বাস অথবা ভক্তিকে সম্মান করতেন আজীবন।
তাঁর সবথেকে বড় গুণ ছিল, তিনি যে-কোনও পরিস্থিতিকেই খুব সহজভাবে গ্রহণ করতে পারতেন। সেবার বার্লিন ফিল্ম ফেস্টিভ্যালে ‘গুপী গাইন বাঘা বাইন’ দেখানো হবে। রবি ঘোষ প্রথমবার বিদেশে গেলেন। সেখানে গিয়ে বন্ধু তপেন চট্টোপাধ্যায়ের সঙ্গে বেরিয়ে পড়লেন কেনাকাটা করতে। জার্মানদের চেহারা সাধারণত লম্বা-চওড়া হয়। ফলে সেখানে কোনও জামাকাপড়ই ঠিকমতো গায়ে হচ্ছে না রবি ঘোষের। শেষে এক জার্মান মহিলা তাঁকে নিয়ে যান, ছোটদের বিভাগে। সেখানে গিয়েই নিজের জামাকাপড় কেনেন তিনি। এই ঘটনায় একটুও বিচলিত হননি তিনি, উপরন্তু খোশমেজাজে কেনাকাটা সেরে হাসি মুখে বেরিয়ে আসেন।
রবির অভিনয় সম্পর্কে একটা খাঁটি কথা বলেছিলেন উত্তমকুমার, “আমরা হয়তো জাঁকিয়ে কিছু করার চেষ্টা করছি, আর রবি হয়তো কয়েক সেকেন্ড থেকে এমন একটা কিছু করবে যে ও গোটা দৃশ্যটা টেনে নিয়ে বেরিয়ে যাবে, লোকে হেসে গড়িয়ে পড়বে”। আর বলিউডের প্রখ্যাত পরিচালক হৃষিকেশ মুখোপাধ্যায় বলেছিলেন, “সব অভিনেতা, সব শিল্পী সব সময় আমার কাছে একশোয় একশো পায় না। রবি পেয়েছিল।”
আরও পড়ুন : ঋত্বিক না সত্যজিৎ, দ্বৈরথ পেরিয়ে দুই স্রষ্টাকে খুঁজবে বাঙালি?
‘গল্প হলেও সত্যি’, ‘গুপী গাইন বাঘা বাইন’, ‘অভিযান’, ‘অরণ্যের দিনরাত্রি’, ‘হীরক রাজার দেশে’, ‘পদ্মানদীর মাঝি’, ‘বসন্ত বিলাপ’, ‘কাপুরুষ ও মহাপুরুষ’ আরও কতো কতো ছবিতে নিজের জাত চিনিয়েছিলেন। ছিনিয়ে নিয়েছিলেন সবটুকু আকর্ষণ। কেবল দেশ নয় বিশ্ব চলচ্চিত্রের অন্যতম শ্রেষ্ঠ অভিনেতা ছিলেন রবীন্দ্রনাথ ঘোষ দস্তিদার ওরফে রবি ঘোষ।
৪ ফেব্রুয়ারি, ১৯৯৭ জীবনাবসান হয় এই চরিত্রাভিনেতার। তিনি ছিলেন ‘ধনঞ্জয়’, যাঁরা মুসাফিরের মতো নিখাদ আনন্দ অনুভব করাতে আসেন, আবার চলেও যান। কেবল বুঝিয়ে দিয়ে যান, “এ জীবন গেলে ফিরে আসে না আবার...”। সুতরাং লুটে নিতে হবে জীবনের সবটুকু রসদ। রবি ঘোষ অস্কার পাননি ঠিকই, তবে ভালোবাসা, সম্মান, সমাদর এবং গুণের কদর জীবদ্দশাতেই পেয়ে গিয়েছেন। এতগুলো বছর পেরিয়ে এসেও সেই প্রথায় ভাটা পড়েনি একরত্তিও। আজও তিনি সমান জনপ্রিয়, সমান প্রাসঙ্গিক। বাঙালির হৃদয়ে রবি ঘোষ আজও আইকনিক।