প্রেমের খোঁজে রাজস্থানের ভূতুড়ে এলাকা থেকে বিদেশ যাত্রা, এক অবিস্মরণীয় প্রেমের কাব্য

একটার পর একটা দিন চলে যায়। দিন শেষে সূর্য সমস্ত আকাশে যেন ছড়িয়ে দেয় মুঠোমুঠো আবির। বিকেলের নরম আলো গায়ে মেখে বালির শহর মেতেছে অপূর্ব এক রঙের খেলায়, ঘরে ফিরতে চেয়ে পাখিরা জুড়েছে কলতান। উটের দল সারিবদ্ধভাবে ফিরে চলেছে ঘরের পথে। মরুভূমির বুকে অবস্থিত ছোট্ট এই বসতিটার এক প্রান্তে বসে ফেলে আসা দিনগুলোর কথা ভাবেন বয়সের ভারে ঝুঁকে আসা এক বৃদ্ধ। না, স্মৃতি তাঁর সঙ্গে বিশ্বাসঘাতকতা করেনি। এখনও কোনো এক মনখারাপ করা বিকেলে, মরুভূমির বুকে রঙ বদলানোর সাক্ষী থাকতে থাকতে অশতিপর পর সেই বৃদ্ধের মনে পড়ে সত্তরের দশকের এমনই এক বিকেলের কথা। না, নকশাল আন্দোলনের ঢেউ কোনদিনই আছে পড়েনি থর মরুভূমিতে, কিন্তু এমনই এক দিনে এই বৃদ্ধের মনের চোরাকুঠুরিতে কড়া নেড়েছিল বসন্তদিন।

সত্তরের দশক। জ্বলছে সমগ্র কলকাতা। শ্রমিক-কৃষকের সরকার গঠনের স্বপ্নকে বুকে নিয়ে ঘর ছেড়েছে হাজার হাজার তরুণ-তরুণী। প্রেম আর বিপ্লবের গান রচনা হচ্ছে সারা শহর জুড়ে। এমনই এক উত্তাল সময়েই শুরু আমাদের এই গল্প। তবে আমাদের গল্পের প্রেক্ষাপট কলকাতা নয়। গল্পের শুরুটা হচ্ছে রাজস্থানের থর মরুভূমির বুকে। সেদিন মরুভূমির উত্তপ্ত বালুকারাশিকে সঙ্গী করে, নিজের হৃদয়কেও কোথাও যেন প্রেমের আগুনে জারিত করে নিয়েছিল সেই নাম-না-জানা বৃদ্ধ, থুড়ি তখন তো তিনি যুবক। বিশ্বের সপ্তম বৃহত্তম মরুভূমি থরের বুকেই রাজস্থানের সেই যুবক খুঁজে পেলেন তার প্রেয়সীকে।

এই প্রেমকাহিনি যেন প্রদ্যুম্ন মহানান্দিয়া আর শার্লটের প্রেমকাহিনি'র কাঁধে হাত রেখে চলে। না মরুভূমির বুকের সেদিনের সেই প্রেমিকটি'র পরিচয় জানা যায় না। তিনি তখন মরুভূমির মাটিতে উটদের পরিচর্যার কাজে নিযুক্ত। নতুন একদল পর্যটক এসেছেন সুদূর অস্ট্রেলিয়া থেকে। এই অস্ট্রেলীয় পর্যটকদের মধ্যে ছিলেন মারিনা। হ্যাঁ, প্রথম দর্শনেই মারিনা প্রেমে পড়লেন সেদিনের সেই উটচালক যুবকের। যেমন প্রদ্যুম্ন পড়েছিল শার্লটের প্রেমে, জাহাঙ্গীর মজেছিলেন নুরজাহানে। অর্থাৎ লাভ অ্যাট ফার্স্ট সাইট।

আরও পড়ুন-শিক্ষিত পতিতার আত্মচরিত, বাংলা সাহিত্যের এ যাবৎ কালের সবচেয়ে বড় অন্তর্ঘাত

প্রদ্যুম্ন মহানান্দিয়া। ভ্যালেন্তিনা তেরেসকোভার ছবি এঁকে যিনি এসেছিলেন পাদপ্রদীপের আলোয়, তার সঙ্গী বলতেছিল একটা সেকেন্ড হ্যান্ড সাইকেল - প্যাডেলে ভর দিয়ে প্রেমিকা শার্লটের খোঁজে প্রদ্যুম্ন পৌঁছে গিয়েছিলেন সুদূর সুইডেন। না, প্রদ্যুম্নর থেকে কোন অংশে কম নয় আমাদের আজকের গল্পের নায়ক। মন দেওয়া-নেওয়ার পর মারিনা ফিরে গেলেন অস্ট্রেলিয়ায়। এদিকে প্রথম প্রেমকে কি অত সহজে ভোলা যায়? না, ভোলেননি থরের অজ্ঞাত পরিচয় সেই যুবক। পরিচিতদের অন্ধকারে রেখে কোনোরকমে কিছু টাকার সংস্থান করে তিনিও পাড়ি জমালেন মেলবোর্নের উদ্দেশ্যে। খুঁজেও পেলেন প্রেমিকাকে। দীর্ঘ তিন মাস মারিনার সঙ্গে একপ্রকার সুখে সংসার করলেন তিনি।

কিন্তু এর পরেই কোথাও যেন ছন্দপতন। তিন মাস পরে দেশের মাটির টানে ঘরে ফেরার গান না হয় লেখা হলো, কিন্তু মারিনার কি হবে? দূরত্ব বাড়ে যোগাযোগ নিভে যায়। মহাকালের রথের চাকা ঘোরার সঙ্গে সঙ্গেই প্রেমিকার ছবিটা ঝাপসা হতে শুরু করল সেই রাজস্থানী প্রেমিকের মন থেকে। সমাজের প্রশ্নবাণে জর্জরিত হয়ে একসময় অন্য একজনকে বিয়েও করলেন তিনি। পেলেন সরকারি চাকরি, তাও যে - সে চাকরি নয়। রাজস্থানের ভুতুড়ে গ্রাম কুলধারার নিরাপত্তারক্ষী রূপে চাকরিতে যোগদান করলেন সেই যুবক।

ইতিমধ্যে মহাকালের রথের চাকা ঘুরেছে আরো বেশ কয়েকবার। সময় তার চিহ্ন রেখে যেতে ভুলে যায়নি সেদিনের সেই তরুণের মুখে। আজ তিনি বৃদ্ধ। সময়ের নিয়মে তাকে ছেড়ে গেছেন তাঁর স্ত্রীও। একাকিত্বের যন্ত্রণা প্রতিমুহূর্তে যখন দগ্ধ করে মারছে বৃদ্ধ মানুষটিকে ঠিক তখনই তিনি হাতে পেলেন একটি চিঠি। পত্রপ্রেরক - মারিনা, বৃদ্ধের সেই অস্ট্রেলীয় প্রেমিকা। এই চিঠি সেই বৃদ্ধের কাছে যেন পিচ গলা রোদ্দুরে বৃষ্টির বিশ্বাস, উত্তপ্ত মরুভূমির বুকে এক টুকরো মরুদ্দ্যান। এতদিন পরেও প্রথম প্রেমকে ভোলেননি মারিনা,বিয়েও করেননি তিনি। প্রেমের কাছে সমাজের ভয় হয়ে গেছে তুচ্ছ। আর সেই বৃদ্ধ? তিনি এখন প্রহর গুনছেন আবার কবে থরের মাটিতে আকাশের রঙমিলান্তি খেলাকে সাক্ষী রেখে মারিনাকে বলে উঠবেন, " আমি চিনি গো চিনি তোমারে... ওগো বিদেশিনী।"

তথ্যসূত্র:-
১.ভুতুড়ে গ্রামে ফিরল হারিয়ে যাওয়া অস্ট্রেলীয় প্রেম, কাহিনীতে ক্লিন বোল্ড নেটদুনিয়া-নিউজ১৮

২. ফেসবুক

More Articles