শিক্ষিত পতিতার আত্মচরিত, বাংলা সাহিত্যের এ যাবৎ কালের সবচেয়ে বড় অন্তর্ঘাত
ইংরেজি disruption শব্দটির বাংলা অর্থ ভাঙন বা চূর্ণবিচূর্ণ অবস্থা, শিরোনামে ইংরেজি শব্দটিই লিখতে চেয়েছিলাম, কিন্তু এক্ষেত্রে অন্তর্ঘাত শব্দটি ব্যবহার করলাম বিষয়টির অভিঘাত বোঝানোর জন্য। একটি বইয়ের কথা লিখব, নাম-শিক্ষিত পতিতার আত্মচরিত, লেখক - মানদা দেবী। প্রকাশকাল- ১৯২৯। বইটি এখনও পাওয়া যায়।
মানদার জন্ম ১৯০০ সালে। তার নাম সত্যিই মানদা কি না জানা যায় না। তার নিজের কথায় সে ব্রাহ্মণ কন্যা। মানদা ধনী পরিবারের মেয়ে, তার বাবা হাইকোর্টের বড় উকিল, মানদা বিখ্যাত স্কুল বেথুনে পড়ত। যখন সে ক্লাস সিক্সে, তখন তার মা মারা যায়। মানদার বাবা তাকে গান (রবীন্দ্রসঙ্গীত আর ব্রহ্মসঙ্গীত) শিখিয়েছিলেন শিক্ষক রেখে। অল্প বয়স থেকে সে বাংলা ও ইংরেজি সাহিত্য পড়তে শুরু করে। সে বাড়ির গাড়ি ছাড়া বাইরে বেরোত না। ইতিমধ্যে তার বাবা দ্বিতীয়বার বিয়ে করেন। ক্লাস টেনে উঠে মানদার গৃহশিক্ষকের [রমেশ] সঙ্গে প্রেম ও শারীরিক সম্পর্ক হয়, পরিণতিতে তার সঙ্গে সে বাড়ি থেকে পালিয়ে যায়। এদিকে রমেশ বিবাহিত ছিল এবং কলকাতার অফিস থেকে সে টাকা চুরি করে মানদাকে নিয়ে পালিয়েছিল। ভারতের বিভিন্ন শহরে ঘুরে বেনারসে গর্ভবতী মানদাকে ফেলে রমেশ পালিয়ে যায়। সেখানে এক আশ্রমের মোহান্তের সাহায্যে মানদা এক মৃত সন্তান প্রসব করে ও অসুস্থ হয়ে পড়ে। কিছুদিন ওই আশ্রমে থেকে যখন সে সুস্থ হয়ে উঠেছে, তখন সেখানে এক সাধুর প্রতি আকৃষ্ট হলে, ক্রুদ্ধ মোহান্ত পরিচিত এক বন্ধুর সাহায্যে মানদাকে কলকাতায় পাঠিয়ে দেন।
সময়টা প্রথম বিশ্বযুদ্ধের কাল। মোহান্তের সুপারিশেই কলকাতায় এসে সে ওঠে এক নারী উদ্ধার আশ্রমে। তখন তিনি পূর্ণ যুবতী। সেখানে কিছুদিনের মধ্যেই বুঝতে পারেন ম্যানেজারের সঙ্গে না শুলে সুযোগ সুবিধে পাওয়া যাবে না। মেনেও নিয়েছিলেন মানদা। এক সময়ে তাঁর মনে হয় শরীরই যদি বেচতে হয় তাহলে এই সামান্য সুযোগ সুবিধের জন্য ম্যানেজারকে কেন বেচব, খোলা বাজারেই বেচব। অন্য ভাবে বাঁচবার শেষ চেষ্টায় মানদা তাঁর রুমমেট বান্ধবীকে নিয়ে সেখান থেকে পালিয়ে ব্রাহ্মসমাজে যান। তাঁদের কাছে আশ্রয় চান, কিন্তু কুখ্যাত পিউরিটান ব্রাহ্ম হেরম্বচন্দ্র তাদের তাড়িয়ে দেন পতিতা বলে। নিরুপায় মানদা বউবাজারের হাড়কাটা গলির বেশ্যাপাড়ায় এক বাড়িউলির আশ্রয়ে ওঠেন।
এই সিরিজের আগের লেখাটি পড়ুন-বিপ্লবী অজয় মুখোপাধ্যায়কে বাঙালি ভুলে গেল অথবা ভুলিয়ে দেওয়া হল
সেই বাড়িউলির সাহায্যে আমহার্স্ট স্ট্রিটে বস্তিঘর ভাড়া নিয়ে মানদা বেশ্যাবৃত্তি শুরু করেন। সেখানে কিছুদিনের মধ্যেই কলকাতার এক বিখ্যাত ডাক্তার মানদার বাবু হয়, তিনি মানদাকে নিয়ে হাড়কাটা গলিতে বাড়ি ভাড়া করে চলে যান। ততদিনে মানদা গজল আর কীর্তন শিখে নিয়েছেন যা বেশ্যাবাড়ির জনপ্রিয় গান। এই ডাক্তারের সঙ্গে সেই সময়ের বিখ্যাত দেশনেতা চিত্তরঞ্জন দাশের পরিচয় ছিল। চিত্তরঞ্জন দাশ পূর্ব বাংলায় ঝড়ের জন্য ত্রাণের টাকা তোলার আপামর কলকাতাবাসীকে ডাক দিয়েছিলেন, তিনি বেশ্যাদেরও আলাদা করে আহ্বান জানিয়েছিলেন। আর মানদা তাঁর ডাক্তার প্রেমিকের মাধ্যমে সেই কাজে জড়িয়ে পড়েছিলেন।
১৯২০ সালে গান্ধীজীর ডাকে অসহযোগ আন্দোলন শুরু হলো, চিত্তরঞ্জন বাংলায় সেই আন্দোলনের প্রধান নেতা। সেই সময় মানদা ও তার কয়েকজন বন্ধু এই পেশা থেকে কংগ্রেসের যুবকদের সঙ্গে আন্দোলনে যোগ দিলেন। বেশ্যারা এই কাজে যোগ দেওয়ায় চিত্তরঞ্জনকে অনেক সমালোচনা শুনতে হয়েছে। ১৯২৪ সালে তারকেশ্বরের শিব মন্দিরের সামনে সত্যাগ্রহ আরম্ভ হয়। সে সময়ের মোহান্ত সতীশ গিরির বিরুদ্ধে নানাবিধ অত্যাচারের অভিযোগ ছিল। এদিকে দেশবন্ধু চিত্তরঞ্জন নেতৃত্বে কংগ্রেসি দল মন্দিরে প্রবেশাধিকার দাবি করেন। কলিকাতা হইতে মানদারা প্রায় দশ-বারোজন বেশ্যা তারকেশ্বরে যান। সেখানে কংগ্রেসিদের সঙ্গে মানদার নেতৃত্বে তাঁরা অবস্থান ধর্মঘট করেন, শেষ পর্যন্ত মোহান্ত মন্দিরের দরজা খুলে দেয়।
এরপর উত্তরবঙ্গে ভয়াবহ বন্যা হলে মানদার উদ্যোগে কলকাতার বিখ্যাত বেশ্যাপাড়াগুলো থেকে অর্থাৎ হাড়কাটা গলি, রামবাগান, সোনাগাছি, ফুলবাগান, চাঁপাতলা, আহিরীটোলা, জোড়াসাঁকো, সিমলা, দলে দলে বেশ্যারা রাস্তায় মিছিল করে চাঁদা তুলেছিলেন। কলকাতার মানুষ এই বিরল দৃশ্য দেখেছিল। মানদার উদ্যোগে রামবাগানের কয়েকজন চরকা কাটা ও খদ্দর পরাও শুরু করেছিলেন, হঠাৎ চিত্তরঞ্জন দাশের মৃত্যুতে সব শেষ।
ইতিমধ্যে মানদার নতুন 'বাবু' এক ব্যাঙ্ক ডিরেক্টর। তার কল্যাণে মানদা হাড়কাটা ছেড়ে বড় রাস্তায় রামবাগানে বাড়ির মালিক হল। এই ডিরেক্টর মানদাকে রোজ খবরের কাগজ কিনে দিতেন। অনেক সাহিত্যর বইও কিনে দিয়েছিলেন। মানদা তখন বেশ ধনী।
রামবাগানে থাকার সময় মানদার নতুন নাম হয় ফিরোজা। কী ভাবে? মানদার ভাষায়, ‘আমি ফিরোজা রংয়ের জামা কাপড় পরিতে ভালবাসিতাম বলিয়া রামবাগানে আমার ডাক নাম ছিল ফিরোজা বিবি।‘ রামবাগানে থাকতেই ফিরোজা বাঈ হিসেবে খ্যাতি ছড়ায়। একদিন খবর আসে ফিরোজার বাবুর ব্যাঙ্ক ফেল পড়েছে, বাবু নিখোঁজ।
কিছুদিনের মধ্যেই রাজশাহীর এক জমিদার ফিরোজার নতুন বাবু হয় আর মানদা রামবাগান ছেড়ে সোনাগাছিতে বড় বাড়ি নিয়ে ওঠেন। এই সময়ে মানদার দুই প্রেমিক জুটে গেল, পেশায় তারা উকিল ও ব্যারিষ্টার। ফিরোজার দুজনের সঙ্গেই শারীরিক সম্পর্ক ছিল। যেহেতু এই দু'জনের সমাজের অভিজাত ব্যক্তিদের সঙ্গে পরিচয় ছিল, তারা ফিরোজার জন্য নিয়মিত ধনী খদ্দের আনতে শুরু করে।
রাজশাহীর জমিদার বিদায় নেওয়ার পর আসামের এক ধনী ব্যবসায়ীকে তারা ফিরোজার কাছে আনে। এরপর সেই ধনী ফিরোজাকে বিয়ের প্রস্তাব দেয়। ফিরোজা রাজি হন না, ব্যবসায়ী ফিরে যায়। ততদিনে জীবন তাঁকে শিখিয়েছিল কারো স্ত্রী হওয়ার চেয়ে একলা স্বাধীন জীবন অনেক ভালো। তিনি ঠিক করলেন অনেক হয়েছে, আর সোনাগাছির জীবন নয়। এখন তার বেশ্যাপাড়া ছেড়ে অভিজাত পাড়ায় চলে যাওয়া উচিত।
তাঁর দুই প্রেমিক তথা দালালের সাহায্যে দক্ষিণ কলকাতার ভবানীপুরে বড় বাড়ি কিনে চলে আসেন, ফিরোজা নাম পাল্টে হল মিস মুখার্জি আর তার দুই দালাল উকিল ও ব্যারিস্টার, এরা শহরের অভিজাতদের মধ্যে মিস মুখার্জিকে একজন সোশ্যালাইট হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করল। এবার দুই দালাল কলকাতার ধনীদের দিয়ে কলকাতার বাইরে বাগানবাড়িতে প্রত্যেক মাসে একটি পার্টি দিত মিস মুখার্জির নামে। এরকমই একটি পার্টির বর্ণনায় মানদা লিখিত আত্মচরিত হঠাৎ শেষ হয়ে যায়।
বিশ শতকের শুরুর দিকে প্রকাশিত এই বইটি এক গুরুত্বপূর্ণ সামাজিক দলিল। একটি মেয়ে, তার কী নাম জানা যায় না, নিজের রূপে গুণে বুদ্ধিতে মাত্র ২৯ বছর বয়সে তিনি কলকাতার একজন বিখ্যাত ধনী বেশ্যা (ক্ষমতাকেন্দ্র) হয়ে ওঠেন এবং ওই প্রান্তিক জীবন ছেড়ে শহরের জীবনের মূলস্রোতে ফিরে আসেন। মানদা থেকে ফিরোজা হয়ে শেষ পর্যন্ত তার পরিচয় মিস মুখার্জি। যে সমাজ তাঁকে বেশ্যাজীবনের দিকে ঠেলে দিয়েছিল, সেই সমাজের অভিজাত মহলে তিনি নিজেকে প্রতিষ্ঠা করেন, রিক্লেম করে নিজের অধিকার, এই হল তাঁর সংক্ষিপ্ত যাত্রাপথ। একটি মেয়ের পক্ষে সেই যুগে এই দীর্ঘ রণকৌশল চালিয়ে যাওয়া কী কঠিন ছিল তা আজ আমরা বুঝতে পারি। শুধু তাই নয়, মানদা ঠিক করেন আত্মজীবনী প্রকাশ করে সব বলে যাবেন। এই বিষয়ে প্রথমেই তিনি উকিলের পরামর্শ নেন, কারণ বিভিন্ন মহল থেকে বাধা আসবে তা তিনি জানতেন। এসেও ছিল, এই বই যাতে প্রকাশ না হয় সেজন্য কলকাতার কয়েকজন প্রভাবশালী মানুষ, যারা এক সময়ে তাঁর কাছে নিয়মিত যেতেন, তাঁরা মামলার নোটিশ পাঠায় তাঁকে, কিন্তু মানদার উকিল কোর্টে সে সবের নিষ্পত্তি করেন। এমনকী উকিলের পরামর্শে বইতে তিনি নিজের ছবিও দেননি, ইচ্ছে থাকা সত্ত্বেও। এসবই তিনি ভূমিকায় লিখেছেন।
একটি বই, যার কোন কপিরাইট নেই, লেখকের নাম থাকলেও পরিচয় জানা যায় না, তাঁকে দেখা যায় না, বইটি প্রকাশ হওয়ার ১ মাসের মধ্যে চারটি সংস্করণ হয়ে চারহাজার কপি বিক্রি হয় এবং লেখকেরও কোন খোঁজ পাওয়া যায় না, বাংলা সাহিত্যে এত বড় অন্তর্ঘাত আর হয়নি।