সঙ্গী ১১৯ বছরের পুরনো প্রজেক্টর, যে ভাবে বেঁচে আছেন কলকাতার শেষ বায়োস্কোপওয়ালা
ত্রিপল টাঙিয়ে গজিয়ে উঠেছে সারি সারি দোকান। কোনোটায় জ্বাল হচ্ছে এক কড়াই দুধ। পাশেই কোথাও এক কোপে মাংসের ধড়মুণ্ডু আলাদা করছে কসাই। রাস্তার ওপর থরে থরে সাজানো চটচটে তেলের ড্রাম। চারপাশে জমাট নোংরার স্তুপ। কলেজ স্ট্রিটের খুব কাছে। আমার-আপনার অচেনা কলকাতা। কলাবাগানের মার্কাস স্কোয়ার।
সেখানে ৮/১০ ফুটের ছোট্ট খুপড়িতে থাকেন বছর ৬২-র মহম্মদ সেলিম। পরিবারের সদস্য বলতে ৮ জন। স্ত্রী, ৪ ছেলে, ২ মেয়ে এবং ১১৯ বছরের পুরনো একটি প্রোজেক্টর। তাঁর নানা-র আমল থেকে প্রোজেক্টরটা পরিবারের সঙ্গে। কত উত্থান-পতনের সাক্ষী। ঘরে ঘরে টেলিভিশন এল, তারপর মোবাইল, এখন ইন্টারনেট। আগে বায়োস্কোপ দেখতে কচিকাঁচারা ছুটে আসত। আজকাল ফিরেও তাকায় না। হাতে মোবাইল, ছেলেমেয়েরা স্মার্ট হয়েছে। দর কমেছে পুরনো প্রজেক্টরের। তাই বলে বাতিল করে দেবেন! কত জনে বলেছে, লোহালক্কড়ের দোকানে বিক্রি করে দাও। ভাল দাম পাবে। ওসব শুনলে বুকটা ছ্যাঁত করে ওঠে সেলিমের। প্রোজেক্টর ছাড়া আজও অন্য কিছু ভাবতেই পারেন না। “ওই যে আপনারা কী বলেন না, যদি হও সুজন তেঁতুলপাতায় ন’জন। আমরা আটজনে মিলেমিশে বেশ ভালোই আছি।”
সময়টা ১৮৯৮। হীরালাল সেন প্রতিষ্ঠা করলেন রয়্যাল বায়োস্কোপ কোম্পানি। বাংলার প্রথম প্রোডাকশন হাউস। সেলিমের নানা ছিলেন রয়্যাল বায়োস্কোপের কর্মী। সেই থেকে পরিবারের রক্তে মিশে গেল সিনেমা। তিন পুরুষ ধরে তাঁরা সানন্দে বায়োস্কোপওয়ালা।
সেটা গত শতাব্দীর ছয়ের দশক। বাবার সঙ্গে গুটি গুটি পায়ে প্রোজেক্টর নিয়ে বেরিয়ে পড়তেন যুবক সেলিম। দিলীপকুমার তখন মধ্যগগনে। একা হাতে শাসন করছেন গোটা বলিউড। সেলিমের প্রিয় নায়ক বলে কথা। ‘দিল দিয়া দর্দ লিয়া’ কিংবা ‘গঙ্গা যমুনা’-র মতো এক সে-এক হিট ছবির ক্লিপ চালিয়ে দিতেন প্রোজেক্টরে। রেগে যেতেন আব্বা। আব্বার চিরকালের পছন্দ অশোককুমার। এই নিয়ে বাবা-ছেলের কত ঝগড়াই না হয়েছে। এখন ভাবলে হাসি পায়। কোথায় মিলিয়ে গেল সেই সব দিন!
এই তো সেদিন! আটের দশকেও ব্যারাকপুর, মেটিয়াবুরুজ, বরানগরের রাস্তায় রাস্তায় প্রোজেক্টর নিয়ে ঘুরে বেড়াতেন। স্পষ্ট মনে পড়ে মহম্মদ সেলিমের। রাজেশ খান্না, জিতেন্দ্র, শ্রীদেবী-র ছবি দেখতে ছেঁকে ধরত কচিকাঁচারা। প্রত্যেকের হাতে ২৫ পয়সার কয়েন। কালো কাপড়ে ঢাকা ম্যাজিক বক্সে চোখ রাখতেই হাসি ফুটে উঠত মুখে। হাসি দেখে মন ভাল হয়ে যেত সেলিমের। একসময় কলকাতার প্রত্যেক পাড়ায় ঘুরে বেড়াত এই বায়োস্কোপওয়ালারা। মা-বাবারা তখন সন্দেহের চোখে তাকাত না। অবলীলায় এগিয়ে দিত ছেলেমেয়েদের। কখনওসখনও নিজেরাও চোখ গলিয়ে দেখে নিত পছন্দের তারকাদের। লো-ওয়াট বাল্বের আলোআঁধারি যে এমন মায়াবী দৃশ্য তৈরি করতে পারে, আজও ভাবতে বসলে আশ্চর্য লাগে সেলিমের।
বায়োস্কোপ শিল্পকে বাঁচিয়ে রাখতে চেষ্টা চালিয়ে গেছেন লাগাতার। বাজার তখন পড়তির দিকে। অনুরোধ করলেন এক ইঞ্জিনিয়ারকে। ছবির সঙ্গে শব্দ যোগ হল প্রোজেক্টরে। বদলে ফেললেন পুরনো ছবির ক্লিপ। পৌঁছে গেলেন মুরগিহাটা। ৫ টাকায় ১ কিলো বাতিল ফিল্ম কিনে নিজেই বানিয়ে ফেললেন ছোট্ট একটা ছবি। এ জেলা থেকে সে জেলা। এক রাজ্য থেকে অন্য রাজ্য। মেলায়-মেলায় নতুন ছবি আর প্রোজেক্টরের গাড়ি নিয়ে কম ঘোরেননি। অনেকদিন পর যখন বাড়ি ফিরতেন চোখে জল আসত। ওই তো সামান্য আয়! ছেলেমেয়েদের জন্য কিছু কিনবেন, সেই সামর্থ হত না।
আরও পড়ুন-চৈতন্যর প্রিয় মিষ্টি, আজও রসকদম্বকে বাঁচিয়ে রেখেছে বাংলার এই জেলা
২০০৭ সালে সেলিমকে নিয়ে তৈরি হল তথ্যচিত্র। টিম স্টার্নবার্গ বিশ্বের দরবারে তুলে ধরলেন কলকাতার এক বায়োস্কোপওয়ালার কাহিনি। সেই বছর অস্কারে মনোনীত হল ছবিটি। শুভেচ্ছার বন্যা বয়ে গিয়েছিল ৮/১০–এর ছোট্ট ঘরে। ২০১৫ সালে ডাক পেয়েছেন কলকাতা আন্তর্জাতিক চলচ্চিত্র উৎসবেও। ‘ফুল অউর কাঁটে’ ছবি থেকে ৭ মিনিটের বায়োস্কোপ বানিয়ে পৌঁছে গিয়েছিলেন নন্দনে। লোকজনের লাইন পড়ে গেল। তাঁকে ঘিরে অটোগ্রাফ, সেলফি কত কী! সেলিম ভালই জানে আসলে ওসব হুজুগ! সাতদিনের মাতামাতি। তারপর যে কে সেই! মার্কাস স্কোয়ারের এঁদো গলি। ছোট্ট খুপড়ি। বাতিল যন্ত্র আর ঝাপসা হয়ে আসা চোখ!