সাধারণ মানুষের পকেটে কোপ, কেন ঝড়ের বেগে বাড়ছে দুধের দাম

নিত্যপ্রয়োজনীয় জিনিসপত্রের দাম আকাশছোঁয়া। এর ওপর বাড়তি বোঝা দুধের দাম। বলাই বাহুল্য, এবার মধ্যবিত্তের সকাল হবে, আর একটা দুঃশ্চিন্তার বোঝা মাথায় নিয়ে।

গ্যাস থেকে শুরু করে নিত্যপ্রয়োজনীয় অধিকাংশ জিনিসের দাম বেড়েছে, যা রীতিমতো চিন্তায় রেখেছে মধ্যবিত্তকে। বাজারের আগুন দামের কথা ভুলে সদ্য দেশ মেতে উঠেছিল স্বাধীনতার অমৃত মহোৎসবে। সেই উৎসব মিটতে না মিটতেই এবার দুধের দামে ছেঁকা। বলাই বাহুল্য, মধ্যবিত্তর হাতে হ্যারিকেন। ফের একবার ধাক্কা। ভারতে পাইকারি দুধের দাম বছরে ৫.৮ শতাংশ বেড়েছে। বিশেষজ্ঞরা মনে করছেন, দুধের চাহিদা বাড়লে মানুষকে দুধের জন্য বাড়তি টাকা গুণতে হতে পারে। এই আশঙ্কা সত্যি করে অচিরেই ফের একবার দাম বাড়তে চলেছে মাদার ডেয়ারি এবং আমুল দুধের। গুজরাত কো-অপারেটিভ মিল্ক মার্কেটিং ফেডারেশন, মূলত আমূল দুধের নামে পণ্য বিক্রি করে থাকে। তারাও দুধের দাম বাড়ানোর কথা ঘোষণা করেছে। ১৭ অগাস্ট থেকে বর্ধিত দাম কার্যকর হবে বলে জানানো হয়েছে।

প্রচণ্ড গরমে ভারতে দুধের চাহিদা বেড়ে যায়। দক্ষিণ ভারতে দুধের দাম বছরে ৩.৪ শতাংশ বৃদ্ধি পেয়েছে।

দাম বাড়বে যে কারণে
আইসিআইসিআই সিকিউরিটিজ-এর বিশ্লেষকরা, পাইকারি দাম বৃদ্ধির কারণ হিসেবে দুধের ব্যবহার বৃদ্ধি এবং গরম বেড়ে যাওয়াকে দায়ী করছেন। গবাদি পশুর খাদ্যের দাম বৃদ্ধির ফলে দুধের ক্রয়মূল্য বেড়েছে। ভারতের ডেয়ারি কোম্পানিগুলো গত পাঁচ মাসে দুধের বিক্রির দাম প্রায় ৫-৮ শতাংশ বাড়িয়েছে। ব্রোকারেজ ফার্ম ১২ অগাস্ট একটি নোটে জানিয়েছে, তারা মনে করছে, কোম্পানিগুলিকে দুধের ক্রয়মূল্যের জন্য বেশি খরচ করতে হচ্ছে। আর এর ফলে দুধ বিক্রির দাম বাড়াতে হবে।

আরও পড়ুন: মধ্যবিত্তর পকেটে টান, বাজারের কোথায় কতটা কোপ বসাচ্ছে জিএসটি?

ভারতে পাইকারি দুধের দাম বছরে ৫.৮ শতাংশ বেড়েছে। দক্ষিণ ভারতে দুধের দাম বছরে ৩.৪ শতাংশ বৃদ্ধি পেয়েছে।

দ‍্য ইকোনমিক টাইমস (অনলাইন), ডিপার্টমেন্ট অফ কমজিউমার প্রাইসেস, আইসিআইসিআই সিকিউরিটিজ-এর সূত্র দামের (লিটার প্রতি) যে পরিসংখ্যান উল্লেখ করছে, তা হলো,

সারা ভারতে জানুয়ারিতে: ৪৭.২০

উত্তর জোন: ৪৯.৩০

পশ্চিম জোন: ৪৬.৬০

পূর্ব জোন: ৪৫.৬০

উত্তর-পূর্ব জোন: ৬২.৩০

দক্ষিণ জোন: ৪৭.২০

জুনে এই ছবিটা কীভাবে পাল্টে গেল

সারা ভারতে জুনে: ৪৮.৬০

উত্তর জোন: ৫০.৫০

পশ্চিম জোন: ৪৭.২০

পূর্ব জোন: ৪৬.৫০

উত্তর-পূর্ব জোন: ৬২.৬০

দক্ষিণ জোন: ৪৮.৬০।

কর্পোরেট আয় বৃদ্ধি
বিশ্বব্যাপী স্কিমড মিল্ক পাউডার (SMP) এর দামও গত ১২ মাসে বৃদ্ধি পেয়েছে। দাম বাড়ার ফলে ডেয়ারি কোম্পানিগুলো লাভবান হবে বলে আশা করা হচ্ছে। কারণ কোম্পানিগুলো তাদের আয় বাড়াতে পারছে। কিন্তু ক্রয়মূল্যের পাশাপাশি পরিবহণ ও প্যাকেজিং খরচ বৃদ্ধির কারণে তাদের পরিচালন মুনাফা ক্ষতিগ্রস্ত হতে পারে। এবং চলতি অর্থবছরে তা প্রায় ৫ শতাংশ হতে পারে। CRISIL-এর ডিরেক্টর আদিত্য জাভের বলেছেন, "আমরা আশা করি যে, গরমের কারণে এই গ্রীষ্মে আইসক্রিম, দই এবং ফ্লেভার্ড বা স্বাদযুক্ত দুধের চাহিদা সর্বোচ্চ হবে। গত দুই গরমকাল কোভিড-১৯-এর কারণে উৎপাদন প্রভাবিত হয়েছিল।‘’

তিনি আরও জানাচ্ছেন, ঘি এবং পনিরের মতো গার্হস্থ ব্যবহারের পণ্যগুলির স্থির চাহিদা বৃদ্ধির সঙ্গে হোটেল, রেস্তোরাঁ এবং ক্যাফেগুলিতে দুধের পণ্যের চাহিদাও বৃদ্ধি পেয়েছে। এছাড়াও গত অর্থবছরের দাম বৃদ্ধির কারণে, এই অর্থ বছরে ১৩-১৪ শতাংশ রাজস্ব বৃদ্ধি পাবে।

মাদার ডেয়ারি ও আমুল যে দাম ইতিমধ্যে বাড়িয়েছে, তা বুধবার থেকেই কার্যকর হবে।

কোথায় কত দাম
ঠিক কতটা দাম বেড়েছে? আমূল দুধের দাম বুধবার ১৭ অগাস্ট থেকে প্রতি লিটারে ২ টাকা করে বাড়ছে। নয়া দাম অনুসারে আমূল দুধ পাওয়া যাবে লিটারে ৫০ টাকা করে। আমূল গোল্ড প্রতি লিটারে ৬২ টাকা হচ্ছে। প্রতি লিটার আমূল তাজা ৫৬ টাকায় পাওয়া যাবে। আমূলের এই নতুন দাম বুধবার সকাল থেকে সারা দেশে কার্যকর হবে। গুজরাতের আহমেদাবাদ এবং সৌরাষ্ট্র অঞ্চল, দিল্লি, এনসিআর, পশ্চিমবঙ্গ, মুম্বইয়ে সকাল থেকে কার্যকর হবে বলে জানা যাচ্ছে। এর পাশাপাশি মাদার ডেয়ারিও দুধের দাম বাড়িয়েছে। মাদার ডেয়ারি বুধবার সকাল থেকে দিল্লি এনসিআরে প্রতি লিটার দুধে ২ টাকা দাম বাড়ানোর কথা ঘোষণা করেছে। পশ্চিমবঙ্গেও বর্ধিত দাম এই দিনই কার্যকর হবে বলে জানা গেছে।

দাম বাড়াতে কী যুক্তি
হঠাৎ করে দুধের দাম বাড়ানোর সিদ্ধান্তে নিঃসন্দেহে মধ্যবিত্তের ওপর চাপ। এই দাম বাড়ানোর কী কারণ দেখাচ্ছে সংস্থাগুলো? গুজরাত কো-অপারেটিভ মিল্ক মার্কেটিং ফেডারেশন জানাচ্ছে, দুধের উৎপাদন খরচ লাগাতার বাড়ছে। আর এই বৃদ্ধির কারণে মোট পরিচালন ও উৎপাদন ব্যয়ও বৃদ্ধি পাচ্ছে। আমুল জানাচ্ছে, গত কয়েক বছরের তুলনায় পশুর খাবারের দাম অন্তত ২০ শতাংশ বেড়েছে। এভাবে দাম বৃদ্ধির ফলে দুধের উৎপাদন খরচ বেড়েছে বলে তাদের দাবি। বিশ্লেষকরা বলছেন, রাশিয়া-ইউক্রেন সংকটের কারণে পশুখাদ্য-সহ বিশ্বব্যাপী পণ্যের ঘাটতি দেখা দিয়েছে। আর সব মিলিয়ে এই মূল্যবৃদ্ধি বলে মনে করা হচ্ছে।

আমু‌লের তরফে বিবৃতিতে বলা হয়েছে, "দুধের উৎপাদনের সামগ্রিক ব্যয় বৃদ্ধির কারণে এই দাম বৃদ্ধি করা হচ্ছে। শুধুমাত্র গবাদি পশুর খাদ্য-খরচ গত বছরের তুলনায় প্রায় ২০ শতাংশ বেড়েছে। উৎপাদনে খরচ বৃদ্ধির কথা বিবেচনা করে, আমাদের সদস্য ইউনিয়নগুলিও গত বছরের তুলনায় ৮-৯ শতাংশের মধ্যে কৃষকদের দাম বাড়িয়েছে।" শিশু, বাড়ির বয়স্ক ও অসুস্থ ব্যক্তিদের জন্য মোটামুটি সকলের বাড়িতেই নিয়মিত দুধ আসে। দুধের এই দামবৃদ্ধিতে যে নিঃসন্দেহে চাপ বাড়বে, তা বলাই বাহুল্য।

নিত্যপ্রয়োজনীয় জিনিসপত্রের দাম আকাশছোঁয়া। এর ওপর বাড়তি বোঝা দুধের দাম। বলাই বাহুল্য, এবার মধ্যবিত্তের সকাল হবে, আর একটা দুঃশ্চিন্তার বোঝা মাথায় নিয়ে। 'আমার সন্তান যেন থাকে দুধেভাতে’, এই কথা হয়তো চিরস্তায়ী হয়ে থাকবে বইয়ের পাতায়।

More Articles