তিরিশ বছর আগের একটি সিদ্ধান্ত বাঁচিয়ে দেবে পৃথিবীকে? যে ইতিহাস ফিরে দেখা জরুরি

Ozone Layer: ১৯৯৪ সালে রাষ্ট্রপুঞ্জ ১৬ সেপ্টেম্বরকে আন্তর্জাতিক ওজোন স্তর সংরক্ষণ দিবস হিসেবে ঘোষণা করে। কী ঘটেছিল সেদিন?

সে যেন এক রূপকথার গল্প। এক অবিশ্বাস্য, বিরল মানব ঐক্যর গল্প। বেশিদিন নয়, আজ থেকে তিরিশ বছর আগেকার কথা। সময়টা যুদ্ধবিধ্বস্ত, দু'টি শিবিরে বিভক্ত এক পৃথিবী। ঠান্ডা যুদ্ধর অন্তিম পর্ব। রাজনৈতিকভাবে, আদর্শগতভাবে পৃথিবীর বেশিরভাগ দেশ এতটাই বিভক্ত যে, কোনও বিষয় নিয়ে সমগ্র বিশ্বর একমত হওয়া একেবারেই অসম্ভব একটি বিষয়। কিন্তু এই অসম্ভবকে সম্ভব করা হয়েছিল। মানবজাতির স্বার্থে, পৃথিবীর বুকে প্রাণস্পন্দনকে বাঁচিয়ে রাখার স্বার্থে এক হয়েছিল পৃথিবীর সমস্ত দেশ। সেই বিরল ঐক্যর প্রয়োজন আজ সবথেকে বেশি। পরিবেশকে বাঁচিয়ে রাখতে আর কোনও উপায় নেই। তিরিশ বছর আগের সেই ঘটনার পুনরাবৃত্তির প্রয়োজন হয়ে পড়েছে।

এখন সেপ্টেম্বর মাসের প্রায় শেষ পর্যায়। পুজো চলেই এল। কিন্তু সেপ্টেম্বরের মাঝামাঝি একটি বিশেষ দিন বিশ্ব পালন করেছে। ১৯৯৪ সালে রাষ্ট্রপুঞ্জ ১৬ সেপ্টেম্বরকে আন্তর্জাতিক ওজোন স্তর সংরক্ষণ দিবস হিসেবে ঘোষণা করে।

আমাদের পৃথিবীতে যেভাবে হাজার কোটি বছর ধরে সযন্তে জীবকুল লালিত হচ্ছে, তার অন্যতম কৃতিত্ব প্রাপ্য ওজোন স্তরের। ওজোন স্তর সূর্যের ৯৭-৯৯ শতাংশ অতি বেগুনি রশ্মিকে শুষে নেয়। পৃথিবীর মাটি থেকে আনুমানিক ১৫-৩৫ কিমি উচ্চতায় এর অবস্থান।

আরও পড়ুন: এই মুহূর্তে বিশ্বে অনাহারে ভুগছেন কত মানুষ! পৃথিবী জুড়ে খাদ্য সংকট নিয়ে মিলল বিস্ফোরক তথ্য

ওজোন স্তর যে এই কর্মকাণ্ডর মাধ্যমে আমাদের বাঁচিয়ে রেখেছে, তা আবিষ্কার হয় ১৯১৩ সালে। দু'জন ফরাসি পদার্থবিজ্ঞানী এই আবিষ্কারটি করেন। কিন্তু তখনও বোঝা যায়নি, ওজোন স্তরের অপরিসীম গুরুত্ব। এই ওজোন স্তর যে মানুষের কর্মকাণ্ডর ফলে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে, এবং তার ফলে ক্ষতিকারক অতি বেগুনি রশ্মি কী বিপদ ডেকে আনতে পারে; তা জানা যায় জে মলিনা এবং শেরউড রোল্যান্ড নামক দুই রসায়নবিদের হাত ধরে। মাত্র তিন পাতার সেই গবেষণাপত্র পৃথিবীজুড়ে সাড়া ফেলে দেয়। জানা যায় যে, মানুষের ব্যবহার করা রাসায়নিক ক্লোরোফ্লুরোকার্বন বা সিএফসি এই ওজোন স্তরকে ধ্বংস করে দিচ্ছে। ধীরে ধীরে পাতলা হয়ে যাচ্ছে ওজোন স্তরের সেই পর্দা।

এই বিষয় সামনে আসার পর বিজ্ঞানীরা, পরিবেশবিদরা বসে থাকেননি। ঠিক এখন যেভাবে তাঁরা জলবায়ু পরিবর্তন নিয়ে মানুষকে সচেতন করার কাজ করছেন, ঠিক সেভাবেই তাঁরা উদ্যোগী হয়েছিলেন। গবেষণার সেই ফলাফল যাতে সমাজের সব স্তরে, ক্ষমতার গভীরতম অলিন্দে পৌঁছে যায়, তার জন্য সবরকম প্রচেষ্টা করেছিলেন তাঁরা। নীতি-নিয়ামকদের কাছে তুলে ধরেছিলেন পৃথিবীর বাস্তুতন্ত্র এবং সর্বোপরি জীবকুলের আসন্ন বিপদের কথা।

এই কাজে বাধা এসেছিল পুঁজিবাদীদের থেকে। ঠিক যেভাবে বাধা আসে আজ। দুই রসায়নবিদ সিএফসি প্রস্তুতকারক সংস্থাগুলির থেকে বাধার সম্মুখীন হন। সেই সংস্থাগুলি বিভিন্ন সংস্থা এবং বৈজ্ঞানিককে অর্থের জোরে মিথ্যে প্রচার করতে বাধ্য করায়। তাদের উদ্দেশ্য ছিল, মলিনা এবং রোল্যান্ডের গবেষণাকে মিথ্যে প্রমাণ করা।

কিন্তু তাদের শেষরক্ষা হয়নি। গবেষণার ফলাফল সাড়া ফেলে গোটা বিশ্বে, সমাজের সমস্ত অংশে। মানুষ বুঝতে পারে, তারা ঠিক কত বড় বিপদের মুখে দাঁড়িয়ে। সংবাদ সংস্থা থেকে শুরু করে সিনেমাতেও দেখা যায়, এই বিষয় নিয়ে মানুষকে অবহিত করার চেষ্টা। একজোট হয় রাষ্ট্রপুজ্ঞের সমস্ত দেশ। ওই বিপর্যয় থেকে বাঁচতে সমস্ত বিরোধ দূরে সরিয়ে রেখে ১৯৮৭ সালের ১৬ সেপ্টেম্বর তারা সই করে মন্ট্রিয়ল প্রোটোকল। 'A Global Response to Environmental Crisis', মানুষ উপলব্ধি করল যে তাদের কার্যকলাপের কারণে এত বড় ক্ষতি হয়েছে, সেই কারণে ধাপে ধাপে বন্ধ হয়ে যায় সিএফসি-র ব্যবহার।

২০১৮ সালের একটি রিপোর্ট জানাচ্ছে, ২০৩৫ সালের মধ্যে আর্কটিক এবং উত্তর গোলার্ধ-র বেশিরভাগ স্থানেই ওজোন স্তর মেরামত হয়ে যাবে সম্পূর্ণভাবে এবং দক্ষিণ গোলার্ধ এবং আন্টার্কটিকাতে ২০৬০ সালের মধ্যে। যদিও ব্যবহার বন্ধ হয়ে যাওয়া সত্ত্বেও এখনও আমাদের জলবায়ুতে সিএফসি আছে এবং শীতে তা এখনও ওজোন স্তরের ক্ষতি করে। কিন্তু তিরিশ বছর আগে মানুষের নেওয়া সুচিন্তিত সিদ্ধান্তর কারণে বিজ্ঞানীরা আমাদের আশা দেখাতে পারছেন।

ওজোন স্তর মেরামতের কাহিনি পৃথিবীর ইতিহাসে বিরল। খুব কম ক্ষেত্রই মানুষের ইতিহাসে আছে, যেখানে সম্মিলিত এক প্রচেষ্টার উদাহরণ দেখা যায়। তার মধ্যে অন্যতম হলো আন্তর্জাতিক স্পেস স্টেশন। কিন্তু উদাহরণ হাতে গোনা এবং মন্ট্রিয়ল প্রোটোকল বিরল। আজ রাষ্ট্রনায়কদের পরিবেশ রক্ষার মিথ্যে প্রতিশ্রুতি দেখলে মনে হয়, মন্ট্রিয়ল প্রোটোকল যেন কোনও সুন্দর স্বপ্ন ছিল। অথচ, আজ সেইসব রাষ্ট্রের এক হওয়াই সবথেকে বেশি প্রয়োজন। প্রয়োজন বিজ্ঞানে আস্থা রাখা। মাত্র ১.১ ডিগ্রি তাপমাত্রা বৃদ্ধিতেই যে পরিমাণ প্রাকৃতিক বিপর্যয় দেখা যাচ্ছে, তা থেকে শিক্ষা নেওয়া। কিন্তু এখনও পর্যন্ত সদর্থক কিছুর দেখা মিলছে না।

তবে সুদিন আসবেই। প্রত্যেক ১৬ সেপ্টেম্বর সেই রূপকথার গল্প বলা হবে আর আশায় বুক বাঁধব আমরা। যদি একদিন, কোনও একদিন, সব শেষ হয়ে যাওয়ার আগে রাষ্ট্র এবং পুঁজিবাদীদের টনক নড়ে।

More Articles