এই মুহূর্তে বিশ্বে অনাহারে ভুগছেন কত মানুষ! পৃথিবী জুড়ে খাদ্য সংকট নিয়ে মিলল বিস্ফোরক তথ্য
২০৪৭ সালে ভারত উন্নত দেশের তালিকায় নাম লেখানোর পথে হাঁটছে। অন্নের অধিকার নিশ্চিত না করে তা কতখানি সম্ভব তা উত্তর মোদি সরকারের কাছে আছে কি?
দুর্ভিক্ষের দরজায় কড়া নাড়ছে গোটা দুনিয়া। কয়েকশো কোটি মানুষ খিদে পেটে, অভুক্ত অবস্থায় নিশিযাপন করবেন। চরম খাদ্য সংকটের সম্মুখীন হতে চলেছে মানব সভ্যতা। আর খুব বেশিদিন বাকি নেই ভয়াবহ এমন দিন ঘনিয়ে আসতে। সতর্ক করলেন জাতিসংঘের খাদ্য প্রধান ডেভিড বিসলে। সম্প্রতি জাতি সংঘের জেনারেল অ্যাসেম্বলির সভায় এক সভায় বিসলে পৃথিবীর খাদ্য সংকট নিয়ে মুখ খুলেছেন এবং দেশ প্রধানদের সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দেওয়ার জন্য অনুরোধ জানিয়েছেন।
কেন খাদ্য সংকট ঘনিয়ে আসছে?
ডেভিড বিসলে সভায় জানান, যখন তিনি জাতিসংঘের ওয়ার্ল্ড ফুড প্রোগ্রামের (WFP) এর দায়িত্ব গ্রহণ করেন তখন সারা বিশ্বে ৮ কোটি মানুষ অনাহারে দিন কাটাতেন। কিন্তু জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে খাদ্য সংকট মারাত্মক আকার নিয়েছে। বিশ্বে যে হারে জলবায়ু পরিবর্তন হচ্ছে তাতে এই মুহূর্তে প্রায় ১৩ কোটি ৫০ লক্ষ মানুষ অনাহারে ভুগছেন। ২০১৯ সালে করোনা অতিমারীর পর পৃথিবীব্যাপী অভুক্তের সংখ্যা দ্বিগুণ বেড়ে গেছে। অতিমারী পরবর্তী পৃথিবীতে প্রায় ২৭ কোটি ৬০ লক্ষ মানুষ দু’বেলা খাবার জোগাড় করবে কীভাবে তা বুঝে উঠতে পারছে না। বিসলে এই ভয়াবহ পরিস্থিতিকে ব্যাখ্যা করতে গিয়ে বলেছেন, প্রবল বেগে ঝড়ের পর ঝড় ধেয়ে আসছে পৃথিবীর মানুষদের জন্য। এ পরিস্থিতিতে ২৪ ফেব্রুয়ারি থেকে শুরু হওয়া রাশিয়া ইউক্রেনের যুদ্ধ আগুনে ঘৃতাহুতির স্বরূপ। দু’ দেশের মধ্যে যুদ্ধের কারণে রাসায়নিক সার এবং শক্তির যে ঘাটতি তৈরি হয়েছে তার ফলে বিশ্বের ৩৪.৫ কোটি মানুষ অনাহারে দিন কাটাচ্ছেন।
বিসলের কথায়, “এর মধ্যে ৪৫ টি দেশের ৫ কোটি অভুক্ত মানুষ দুর্ভিক্ষের দোরগোড়ায় দাঁড়িয়ে রয়েছে। যদি আমরা এখনই এই মানুষগুলোর কাছে পৌঁছাতে না পারি তাহলে দুর্ভিক্ষ, অনাহারে জাতিগুলির অস্তিত্ব সংকটের সম্মুখীন হবে, ঠিক যেমন ২০০৭-০৮ এবং ২০১১ সালে দেখেছি। এর ফলে পৃথিবী জুড়ে ব্যাপকহারে অভিবাসন লক্ষ্য করা যাবে। তাই এই মুহূর্তেই সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দিতে হবে।” খাদ্য সংকট সম্পর্কে সচেতন করতে বিসলে বিশ্ব নেতাদের সঙ্গে বৈঠক করেছেন এবং তাঁদের সচেতন করেছেন। ওই বৈঠকে জেনারেল অ্যাসেম্বলির সভাপতি সাবা করোসি উদ্বোধনী ভাষণে বলেছেন, “মনে হচ্ছে আমরা এক স্থায়ী জরুরি অবস্থার সঙ্গেই সহবাস করছি।” জাতিসংঘের মহাসচিব আন্তোনিও গুতেরেস জানিয়েছেন, যে সংঘাত ও মানবিক সংকট ছড়িয়ে পড়েছে গোটা দুনিয়ায় তাতে জাতিসংঘের ফান্ডিংয়েও ৩২ বিলিয়ন ডলারের ঘাটতি দেখা গিয়েছে যা একালের সর্বোচ্চ। তাই পরিস্থিতি মোকাবিলা করার জন্য যথাযোগ্য প্রস্তুতি নিতে বাধা পাচ্ছে জাতিসংঘ।
আরও পড়ুন- কেন ইনকিলাব ধ্বনি দিচ্ছেন ইরানের মেয়েরা! কীভাবে পাড়ি দিল ভগতের স্লোগান
বিসলে ওই বৈঠকে আরও জানিয়েছেন, “যুদ্ধের কারণে ইউক্রেন শস্যের রপ্তানি বন্ধ করে দিয়েছে। অথচ ইউক্রেন এমন একটি দেশ যা ৪০ কোটি মানুষকে বছরভর খাওয়ানোর জন্য পর্যাপ্ত খাদ্য উৎপাদন করে। অন্যদিকে বিশ্বের দ্বিতীয় বৃহত্তম রাসায়নিক সার উৎপাদনকারী দেশ এবং প্রধান খাদ্য উৎপাদকারী রাশিয়াও যুদ্ধের কারণে তাদের রপ্তানি কমিয়ে দিয়েছে। ক্ষমতাশালী দেশগুলির সাহায্যে অনীহার কারণে যে দেশগুলিতে সংকট দেখা যাচ্ছে, যেমন হাইতি, তাদের যথাযথ সাহায্য করা সম্ভব হচ্ছে না। মুদ্রাস্ফীতি, মূল্যবৃদ্ধিও খাদ্য সংকট তৈরির অন্যতম প্রধান কারণ। কোভিড পরবর্তী পৃথিবীতে দরিদ্ররা এই পরিস্থিতির মোকাবিলা করতে ব্যর্থ হয়েছেন কারণ তাঁরা অর্থনৈতিকভাবে ভেঙে পড়েছেন। ফলে মা সন্তানের দুধ কিনবেন না জলবায়ু পরিবর্তনের সঙ্গে মানিয়ে নিতে নতুন পন্থা নেবেন তা ঠিক করে উঠতে পারছেন না। এই সমস্যার এখনই মোকাবিলা করতে না পারলে ২০২৩ সালে খাদ্য জোগাড় করতে বেগ পেতে হবে সকলকেই। মধ্য ও দক্ষিণ আমেরিকায় ইতিমধ্যেই খরা দেখা দিয়েছে, ভারতও তাপ ও খরায় ভুগছে।”
বিশ্বে এখনও যে পরিমাণ খাদ্য উৎপাদন হয় তা ৭.৭ হাজার কোটি মানুষেরও বেশি মানুষ খেতে পারেন। তবে উৎপাদিত খাদ্যের ৫০ শতাংশই তৈরি হয় রাসায়নিক সার ব্যবহার করে। বিশ্বের প্রথম রাসায়নিক সার উৎপাদনকারী দেশ চিন সম্প্রতি সারের রপ্তানি বন্ধ করে দিয়েছে ফলে খাদ্য সংকটের সম্ভাবনা আরও বেড়ে গেছে। সংকট মোকাবিলার জন্য মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র অতিরিক্ত ৫ বিলিয়ন ডলার দান করেছে। একই পথে হেঁটে সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দিয়েছে জার্মানি, ফ্রান্স ও ইউরোপীয় ইউনিয়ন। বিসলে উপসাগরীয় এবং গালফ সংলগ্ন দেশগুলিকে সাহায্যের জন্য এগিয়ে আসতে অনুরোধ করেছেন। তিনি বলেছেন, “আমরা কয়েক ট্রিলিয়ন ডলার সাহায্যের কথা বলছি না। শুধুমাত্র পরিস্থিতি স্থিতিশীল করতে লাভের কিছুটা অঙ্ক আমাদের হাতে তুলে দিন।” এমনকী বিসলে বলেছেন, এই টাকা তাঁদের না দিলেও কোনও সমস্যা নেই। তবে পাশের দেশকে যথা সম্ভব সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দিলেই হবে। “মানুষ বিশ্ব জুড়ে খিদের জ্বালায় কষ্ট পাচ্ছে। প্রতি পাঁচ সেকেন্ড একটি করে শিশুর অনাহারে মৃত্যু হচ্ছে যা আমাদের কাছে খুবই লজ্জার,” বলেন তিনি।
আরও পড়ুন- রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ না ভারতের সিদ্ধান্ত? বিশ্বজোড়া খাদ্যসংকটের জন্য দায়ী কে?
ভারতের অবস্থা
রাশিয়া ইউক্রেন যুদ্ধের কারণে যে দেশের খাদ্যদ্রব্য এবং শক্তির মূল্যবৃদ্ধি ঘটেছে তা মেনে নিয়েছেন বিদেশ মন্ত্রী এস. জয়শঙ্কর। এর ফলে সরকার যে মারাত্মক চ্যালেঞ্জের মুখে পড়েছে, তাও স্বীকার করেন জয়শঙ্কর। আসন্ন জি-২০ বৈঠকে এই বিষয়টিকে গুরুত্ব দিয়ে আলোচনার কথা জানিয়েছেন তিনি। প্রসঙ্গত উল্লেখ্য, ২০২১ সালে ভারত বিশ্ব ক্ষুধা ইনডেক্সে ১১৬ তম স্থানে রয়েছে। ২০২০ সালে ৯৪ তম স্থানে ছিল দেশ। জাতিসংঘের সদ্য প্রকাশিত একটি রিপোর্ট বলছে, ভারতে প্রতি ১০ জনে ৪ জন মানুষ খাদ্য সংকটের মুখে পড়েছেন ২০১৯-২১ সালে। বিশ্বে খাবারের অনিশ্চয়তায় থাকা মানুষদের এক তৃতীয়াংশ মানুষ ভারতীয়। আন্তর্জাতিক পরিস্থিতি, তাপ প্রবাহের কারণে ভারতে গমের জোগান মারাত্মক হারে কমেছে। ইন্ডিয়ান এক্সপ্রেসের প্রতিবেদন অনুযায়ী, ২০২২- ২৩ সালে ১৯ মিলিয়ন টন গম আমদানি করেছে ভারত, ২০২১-২২ এ যা ছিল ৪৩ মিলিয়ন টন। অর্থাৎ প্রায় ৫৬% গমের মজুত কমেছে দেশে।
বৃষ্টির অভাবে ১০-১২ মিলিয়ন টন ধানের উৎপাদন কমেছে দেশে। অন্যদিকে বাজারে চালের দাম বেড়েছে ৮ শতাংশ। এই পরস্থিতিতে কেন্দ্রীয় সরকারের তরফে খাদ্যশস্যের দাম বৃদ্ধির কথা শোনা যাচ্ছে। স্বাধীনতার অমৃতকালে ভারতের ঘরে ঘরে ক্ষুধার জ্বালায় জর্জরিত প্রাণ। এ অবস্থায় ২০৪৭ সালে ভারত উন্নত দেশের তালিকায় নাম লেখানোর পথে হাঁটছে। অন্নের অধিকার নিশ্চিত না করে তা কতখানি সম্ভব তা উত্তর মোদি সরকারের কাছে আছে কি?