উপাচার থেকে ধর্ষণ! ভুটানের এই ভয়াবহ উদযাপনের কথা জানলে শিউরে উঠবেন

উত্তরের পাহাড় ঘেরা এক ছোট্ট দেশ ভুটান। প্রতি বছর অসংখ্য পাহাড়প্রেমী মানুষেরা ভিড় জমায় এই দেশে। আকৃতিতে ছোটো এই দেশের আনাচেকানাচে ছড়িয়ে রয়েছে তাঁদের নানান উপাচার। যদিও ভুটানের অভ্যন্তরীণ লোকাচার বা উপাচার সম্বন্ধে বিশেষ কিছু জানা যায় না। তবে বলা হয়, মহিলা পর্যটকদের জন্য পৃথিবীর অন্যতম সুরক্ষিত দেশ হল এই ভুটান। কিন্তু এই দেশের মধ্যে আজও কিছু স্থানে এমন একটি উপাচার পালন করা হয়, যা দেশের মহিলাদের জন্য এক দুঃস্বপ্ন ব্যতীত অন্য কিছু নয়। অবশ্য এই উপাচারটি দেশের সর্বত্র প্রচলিত নয়, কেবলমাত্র দেশের পূর্ব ও মধ্য়ের কয়েকটি জায়গাতেই প্রচলিত।  

বিখ্যাত লেখিকা সেলিনা হোসেন রচিত ‘নীল ময়ূরের যৌবন’ উপন্যাসে আমরা পাই ‘সুখব্রতরাত্রি’ নামে এক লোকাচারের কথা। উপন্যাসে পাহাড় ঘেরা অনুবর্র জমিতে ফসল ফলাবার আশায় এই ব্রত বা অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হয়ে থাকত। সারাদিন অবিবাহিত নারী এবং পুরুষেরা নিজের পছন্দের মানুষটির সঙ্গে সময় কাটানোর পর, রাত্রিবেলা লিপ্ত হত যৌন সম্পর্কে। ভুটানের এই লোকাচার যেন খানিকটা উপন্যাসের ‘সুখরাত্রিব্রত’ই বাস্তব রূপ।

ভুটানের এই উপাচারের নাম হল ‘বোমেনা’ বা ‘Night Hunting’। এই ‘বোমেনা’ শব্দের অর্থ হল ‘মহিলা শিকার’। ভুটানের অবিবাহিত পুরুষ এবং নারীরা এই উৎসবে অংশগ্রহণ করে থাকেন। এই উৎসবের নিয়ম অনুযায়ী, অবিবাহিত পুরুষেরা তাঁদের পছন্দের নারীর সঙ্গে এক রাতের জন্য যৌন মিলনের সুযোগ পেয়ে থাকে। অবশ্য এই মিলনে যদি কোন নারী আগ্রহী না হন, তবে সে সেই পুরুষকে প্রত্যাখ্যান করতে পারেন। নিয়ম অনুযায়ী, এই উৎসবের দিনটিতে অবিবাহিত মহিলারা তাঁদের বাবা এবং মায়ের সঙ্গে একই ঘরে ঘুমিয়ে থাকেন। রাত গভীর হলে এক বা একাধিক পুরুষেরা, যারা সেই মহিলার সঙ্গে যৌনমিলনে ইচ্ছুক, তাঁরা সকলের নজর এড়িয়ে ঘরে প্রবেশ করেন এবং ইশারার মাধ্যমে তাদের উপস্থিতির কথা জানান দিয়ে থাকেন। যদি সেই নারী, সেই পুরুষের সঙ্গে যৌন মিলনে অনিচ্ছুক হন, তবে তিনি কোন ইশারা অথবা শব্দের মাধ্যমে পাশেই ঘুমিয়ে থাকা বাবা-মা’কে সেই বিষয়ে সজাগ করে দেন। এরপর পুরুষটির পালিয়ে যাওয়া ছাড়া আর কোন উপায় থাকে না। অনেক সময় আবার অনেক নারীর পরিবারের লোকজনরা কাঠের লাঠিরও ব্যবস্থা করে রাখেন, দ্রুততার সঙ্গে পুরুষটিকে বিতাড়িত করার জন্য।

এই উৎসব মূলত অবিবাহিত পুরুষ এবং মহিলাদের জন্য অনুষ্ঠিত হলেও, অনেকসময় বিবাহিত পুরুষ অথবা মহিলারাও নিজের ইচ্ছায় এই অনুষ্ঠানে অংশগ্রহণ করে থাকেন। বিশেষত, ভুটানের গ্রামীণ জীবনেই এই ‘বোমেনা’ অধিক প্রচলিত। বিশেষ করে গ্রাম্য রমণীরাই এই অনুষ্ঠানে বেশি অংশগ্রহণ করে থাকেন কিন্তু ভুটানের বিভিন্ন জায়গা থেকেই পুরুষেরা সেদিন আসেন নিজেদের পছন্দের মহিলাদের সঙ্গে যৌন মিলনের আকাঙ্খায়। আবার অনেকসময় বলা হয়, এই ‘বোমেনা’ হল গ্রামীণ প্রেমকে স্বীকৃতি দানের এক অন্যরূপ। এই উৎসব বহুকাল আগে থেকেই প্রচলিত ছিল কিন্তু পরবর্তীকালে ভুটানের শহরে বসবাসকারী মানুষেরা এই অনুষ্ঠানকে স্বীকৃতি দিলে, এর অনেক বেশি প্রচলন ঘটে। পূর্বে এই যৌন মিলন কেবল গ্রামের নারী-পুরুষদের মধ্যে ঘটে থাকলেও, পরের দিকে মূলত গ্রাম্য নারী এবং শহরের পুরুষদের মধ্যেই এই যৌন মিলন অধিকাংশ সময়ে ঘটতে দেখা যায়।

আরও পড়ুন-শিক্ষিত পতিতার আত্মচরিত, বাংলা সাহিত্যের এ যাবৎ কালের সবচেয়ে বড় অন্তর্ঘাত

কিন্তু পরবর্তীকালে বেশিরভাগ ক্ষেত্রে মানুষেরা, বলা ভালো পুরুষেরা তাদের যৌনখিদে  নিবারণের হাতিয়ার হিসাবে এই ঐতিহ্যবাহী লোকাচারকে ইচ্ছামত ব্যবহার করতে থাকে। যার ফলস্বরূপ অসংখ্য মহিলারা বিভিন্ন যৌনরোগের শিকার হন এবং এই লোকাচার ক্রমে এক ধর্ষণের রূপ নেয়। পরবর্তীকালে যেসমস্ত মহিলারা এই Night haunting এ অংশগ্রহণ করেছেন, তাঁরা কোনো না কোনোভাবে যৌন হেনস্থার শিকার হয়েছেন। এর ফলে মহিলারা অবাঞ্ছিত গর্ভাবস্থা, একক মাতৃত্বের মত সমস্যাগুলির সম্মুখীন হয়েছেন। এছাড়াও অনেকের ক্ষেত্রেই পরবর্তীতে বৈবাহিক সূত্রে আবদ্ধ হওয়ার সম্ভবনাও এক নেতিবচক রূপ নিয়েছে, বহু মহিলা গর্ভধারণের কারণে কাজের সুযোগ হারিয়েছেন, হারিয়েছেন শিক্ষার সুযোগও এবং অনেকে আবার বিবাহ বিচ্ছেদেরও সম্মুখীন হয়েছেন, এছাড়াও মানসিক অসুস্থতার শিকারও হয়েছেন অনেকেই। অন্য পুরুষের সঙ্গে মিলিত হওয়ার কারণে অনেক মহিলাই তাঁদের সাংসারিক জীবনে বিভিন্ন অশান্তি ভোগ করে থাকেন। বিশেষ করে অনাথ অথবা আর্থিক ভাবে পিছিয়ে থাকা মহিলাদেরকেই  পাখির চোখ বানানো হয়ে থাকে।

কিন্তু পুরুষতান্ত্রিক সমাজ-কাঠামোটাই এমন যে একাধিক পুরুষের সঙ্গে যৌন সম্পর্ক স্থাপন না হওয়া অবধি তাকে কোনো জবরদস্তির আওতায় ফেলা হয় না, সমাজের কাছে জবাবদিহি করতে হয় শুধু মহিলাদেরকেই, পুরুষদের এখানে অগাধ ছাড়। বিভিন্ন আইনের মাধ্যমে পুরুষদের এই যথেচ্ছাচার খানিক বন্ধ করা সম্ভবপর হয়েছে।

তবে আশার কথা, বর্তমান প্রজন্ম এই লোকাচার থেকে বেশটাই বিমুখ। লোকাচারের ব্যবহার করে প্রেম নিবেদনের পরিবর্তে তারা এখন অনলাইন ডেটিং অ্যাপে এখন বেশি বিশ্বাস রাখে,  এই উৎসবের রঙ এখন সময়ের সঙ্গে সঙ্গে ক্রমশ ফ্যাকাশে হয়ে পরেছে।

তথ্যসূত্রঃ

১. Cntraveller.in
২. Historyofyesterday.com
৩. Kuenselonline.com  
৪. 'নীল ময়ূরের যৌবন', সেলিনা হোসেন। 

More Articles