দিনে একবার পান্তা, তাতেই হাতির বল! বলছেন পুষ্টিবিদরাই

প্লেটে সাজানো পান্তা ভাত, কাঁচা লঙ্কা, পেঁয়াজ, বেগুন ভাজা এবং আলুসেদ্ধ মাখা। জানেন এই প্লেটের ছবি কার? সোশ্যাল মিডিয়া ব্যবহারকারীদের বুঝতে অসুবিধা হচ্ছে না নিশ্চয়ই। চারদিন আগেই বলিউড অভিনেত্রী অনুষ্কা শর্মার ইনস্টাগ্রাম স্টোরিতে এই ছবি দেখে চোখ কপালে উঠেছে বাঙালির। বিরাট ঘরণীর পাতে ছাপোষা এই বাঙালি পদ দেখে অনেকেই বিশ্বাস করতে পারছেন না। বাঙালি তো সেই কবে থেকেই মজে রয়েছে পান্তাভাতের স্বাদে। আজ কারো অজানাও নয় এই পদ। কবে থেকে চল পান্তা খাওয়ার? আগে সে কথায় আসা যাক।

পান্তাভাতের উৎস

নৃতাত্ত্বিক তপন কুমার সান্যালের মতে, দক্ষিণ এশিয়ার প্রোটো অস্ট্রালয়েড প্রজাতির মানুষেরা পান্তা ভাত খেত। তাঁর যুক্তি অনুযায়ী এই প্রজাতির মানুষ সারাদিনে মাত্র একবারই রান্না করত। এরপর রামায়ণের যুগে সীতা রামচন্দ্রকে পোলাও রান্না করে খাওয়াতেন। কিন্তু সে যুগের মুনি ঋষিরা পান্তাভাত আহার করতেন। মুঘল যুগেও প্রচলিত ছিল এই পদ। তৎকালীন সময়ে সামাজিক, সাংস্কৃতিক প্রতিষ্ঠানের সদস্যরা যে অনুষ্ঠানের আয়োজন করতেন,তাতে আগত অতিথিদের পান্তাভাত খাওয়ানো হত।

ষোড়শ শতকে রচিত বিভিন্ন মঙ্গলকাব্যেও ফিরে ফিরে এসেছে পান্তাভাতের প্রসঙ্গ। মধ্যযুগে বাঙালি সংস্কৃতির অন্যতম দলিল কবিকঙ্কন মুকুন্দরাম চক্রবর্তী রচিত    'চণ্ডীমঙ্গল' কাব্যে পান্তাভাতের উল্লেখ রয়েছে। ১৬৫০ খ্রিস্টাব্দে বিজয় গুপ্তের রচিত মঙ্গলকাব্যে পাই,' আনিয়া মানের পাত বাড়ি দিল পান্তা ভাত'।

১৭৬৫ সালের এপ্রিল মাসে নবাব আলিবর্দি খানের মৃত্যুর পর পৌত্র সিরজদ্দৌল্লা মুর্শিদাবাদের সিংহাসনে বসেন। ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির রাজনৈতিক ও সামরিক প্রভাব বৃদ্ধি পেলে সিরাজ বিরক্ত হয়ে ওয়ারেন হেস্টিংস সহ বেশকিছু ব্যবসায়ীকে মুর্শিদাবাদে বন্দি করে রাখেন।কিছুদিন পর পূর্বপরিচিত বাঙালি ব্যবসায়ী কৃষ্ণকান্ত নন্দীর সাহায্যে  হেস্টিংস মুর্শিদাবাদ থেকে পালিয়ে গিয়ে আশ্রয় নেন তাঁর বাড়িতে। কথিত আছে, প্রখর গরমের সেই দিনে ক্লান্ত ও ক্ষুধার্ত হেস্টিংসকে কৃষ্ণকান্ত পান্তাভাত, ভাজা চিংড়ি এবং পেয়াঁজ খেতে দিয়েছিলেন।

এবার আসা বাঙালির প্রিয় রবিঠাকুরের কথায়। রবীন্দ্রনাথ তাঁর জীবনস্মৃতিতে লিখেছেন, ‘ইসকুল থেকে ফিরে এলেই রবির জন্য থাকে নতুন বউঠানের আপন হাতের প্রসাদ। আর যে দিন চিংড়ি মাছের চচ্চড়ির সঙ্গে নতুন বউঠান নিজে মেখে মেখে দেয় পান্তাভাত, অল্প একটু লঙ্কার আভাস দিয়ে সে দিন আর কথা থাকে না’।

বৈষ্ণবরাও রাধাকৃষ্ণকে পান্তভাত ভোগ হিসেবে দান করেন। অনেক জায়গায় দুর্গাপুজোর দশমীর দিন দেবীকে পান্তাভাত নিবেদন করা। গ্রামবাংলায় আজও শীতলা পুজোর দিন পান্তাভাত খাওয়ার প্রথা প্রচলিত রয়েছে।
শুধু বাংলা সারা ভারতের মানুষই এই পদটি খান, কেবল ভিন্ন নামে। বাংলার পান্তাভাতের নামই আসামে 'পৈত ভাত', ওড়িশায় 'পাখালা ভাত' নামে পরিচিত।ওড়িশায় পাখালা ভাতের জল টাঙ্কা তোরানি নামে পরিচিত। পুরীর জগন্নাথদেবকে 'পাখালা ভাত' ভোগ হিসেবে নিবেদন করা হয়। জগন্নাথ মন্দিরে পরিবেশিত ভোগের নাম 'সুবাস পাখালা'। জুঁই,  বেলি, কাঠগোলাপ ফুলের সাহায্যে সুবাসিত করে আদা মেশানো হয় এই পাখালায়।

কেরালায় পান্তাভাতকে বলা হয় 'পাজম কাঞ্জী'। মাছের ঝোল, আচার, চাটনি সহযোগে কেরালায় পাজম কাঞ্জী খাওয়ার প্রচলন আছে। তামিলনাড়ুতে এই ভাতের নাম 'পাজহেদু সাধম', যার অর্থ পুরোনো ভাত ( Old rice). উত্তর ভারতের মানুষেরা বিশ্বাস করেন যে পান্তা ভাত খেলে তাদের গায়ে বাঘের মতো শক্তি হবে।

আরও পড়ুন-বিরিয়ানি নয়, নববর্ষে বাঙালির পাতে ছিল মাংসের পোলাও

একসময় বিংশ শতাব্দীর শেষে বাংলাদেশে শহুরে বাঙালিরা জাঁকজমক করে নববর্ষ উদযাপন করতে শুরু করেন। বাঙালিয়ানার চিহ্ন হিসেবেই প্রধান পদ হয়ে ওঠে পান্তাভাত ও ইলিশ মাছ।

পান্তাভাতের গুণ


প্রবল গরমে অনেকেই পান্তাভাত খেতে ভালোবাসেন। শুধু স্বাদ নয় পুষ্টিগুণের দিক থেকেও একশোয় একশো দিতে হবে ফার্মেন্টেশন বা গাঁজন পদ্ধতিতে তৈরি পান্তাভাতকে। জেনে নেওয়া যাক পান্তাভাতে উপস্থিত পুষ্টি উপাদান সম্পর্কে-


ভিটামিন বি ১২ : ফার্মেন্টেশন পদ্ধতির কারণে পান্তা ভাতে ভিটামিন বি টুয়েলভের পরিমাণ বেড়ে যায় যা ক্লান্তি দূর করতে সাহায্য করে। ফলে শরীরে দীর্ঘক্ষণ কাজ করার শক্তি বজায় থাকে।


অ্যাসিডিটি থেকে মুক্তি: বিজ্ঞানীদের মতে পান্তাভাত শরীরে পিএইচ ব্যালান্স করতে সাহায্য করে। আলসার রোগীদেরও সুফল মিলবে পান্তাভাতে। পাশাপশি হজমশক্তি বাড়াতেও সাহায্য করে এই খাবার।

ল্যাকটিক অ্যাসিড: ফার্মেন্টেশনের কারণে ল্যাকটিক অ্যাসিড তৈরি হয় যা স্তনপান করানো মায়েদের ক্ষেত্রে বিশেষ উপকারী। এই অ্যাসিড মাতৃদেহে দুধ উৎপাদনে সহায়তা করে।

কোষ্ঠকাঠিন্যের সমস্যা: প্রাকৃতিক লাক্সেটিভ হিসেবে কাজ করে পান্তাভাত যা কোষ্ঠকাঠিন্যের সমস্যা দূর করে।
রক্তচাপ নিয়ন্ত্রণ: পান্তাভাত রক্তচাপ নিয়ন্ত্রণেও কার্যকরী। সাধারণ ভাতের তুলনায় পান্তাভাতে সোডিয়াম কম থাকে। অপরদিকে পটাশিয়ামের পরিমাণ বেশি থাকে যা রক্তচাপ নিয়ন্ত্রণ করতে সক্ষম।

রিহাইড্রেশন: পান্তাভাত শরীরের জন্য রিহাইড্রেটিং খাবার হিসেবে কাজে করে।তাই গরমকালে শরীর ঠাণ্ডা থাকে।

কোলাজেন: পান্তাভাত বিউটি সিক্রেট হিসেবেও কাজ করে। এর মধ্যে থাকা কোলাজেন ত্বক মসৃণ, ঝকঝকে এবং টানটান করে।

মাইক্রোনিউট্রিয়েন্টের উপস্থিতি: পান্তাভাত শরীরের প্রয়োজনীয় পুষ্টি উপাদানগুলির উৎস হতে পারে অনায়াসে। কারণ এতে প্রচুর পরিমাণে ম্যাগনেশিয়াম, আয়রন ও ক্যালশিয়াম থাকে।১০০ গ্রাম সাধারণ ভাতে যেখানে ৩.৪ গ্রাম আয়রন থাকে, সেখানে সমপরিমাণ পান্তাভাতে প্রায় ৭০.৯১ গ্রাম আয়রন উপস্থিত থাকে।

পান্তাভাত তৈরির পদ্ধতি

এমন কোনো বাঙালিই বোধহয় নেই যিনি পান্তাভাত তৈরি করতে জানেন না। তবু পাঠকদের জন্য রইল বাংলা ও বাঙালি অত্যন্ত প্রিয় পান্তাভাত তৈরির পদ্ধতি -

রাতে খাবারের পর অতিরিক্ত ভাতে জল ঢেলে সারারাত রেখে দিন। এক্ষেত্রে সাধারণ তাপমাত্রায় রেখে দিতে হবে জলঢালা ভাতকে। ১২-১৬ ঘণ্টা ফার্মেন্টেশনের ফলে তৈরি হয়ে যাবে সুস্বাদু পান্তাভাত। আলুভাজা, বেগুন ভাজা, পেঁয়াজ লঙ্কা দিয়ে তৃপ্তি করে খান পান্তাভাত। 

More Articles