বিরিয়ানি নয়, নববর্ষে বাঙালির পাতে ছিল মাংসের পোলাও
বাঙালির নববর্ষে খাওয়াদাওয়া শুরু হয়েছিল জমিদারবাড়ির সূত্র ধরে। আসলে এই দিনটা ছিল গরিব কৃষক প্রজাদের জমিদারবাড়িতে এসে, পুরনো খাতার সমস্ত বকেয়া খাজনা মিটিয়ে, হাল অর্থাৎ নতুন খাতা খোলার দিন। খাজনা মিটিয়ে নতুন বন্দোবস্ত নেওয়া প্রজাদের হাতে হাতে ধরিয়ে দেওয়া হত মিষ্টান্ন এবং পান। এগিয়ে দেওয়া হত ডাবের জল। জমিদারবাবুরা এইদিন প্রজা-নিংড়োনো অর্থ দিয়েই ঢালাও খাওয়াদাওয়ার ব্যবস্থা করতেন। আস্তে আস্তে জমিদারি প্রথার অবসান ঘটলে নববর্ষের হালখাতা উৎসবটি প্রধানত হিন্দু বাঙালি ব্যবসায়ীরাই পালন করতে শুরু করেন। গেরস্তবাড়িতে নববর্ষের দিন থেকে আগামী একবছরের সাংসারিক হিসেবপত্র লেখার জন্যে যে নতুন খেরোর খাতা নিয়ে আসা হত, তাকেও লক্ষ্মী-গণেশ কিংবা কুলদেবতার পায়ে ঠেকিয়ে, নিয়ম মেনে ফুল-সিঁদুর দিয়ে পুজো করা হত। নববর্ষের দিন পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন জামাকাপড় পরে খেরোর খাতাটিতে পুজো করার নিয়ম থেকেই সম্ভবত নতুন জামাকাপড় কেনার রেওয়াজ শুরু হয়। আর পুজোর প্রসাদি ফল ও মিষ্টি বাড়ির সদস্য ও অতিথিদের মধ্যে বিতরণ করার রীতি থেকেই এসেছিল সকলকে মিষ্টিমুখ করানোর সুমধুর নিয়মটি।
নববর্ষের দিন বাঙালির খাওয়াদাওয়াকে প্রধানত তিনটি পর্যায়ে ভাগ করা যেতে পারে।
প্রথমত, সকালবেলায় নতুন ধুতি-পাঞ্জাবি বা পাজামা-পাঞ্জাবি পরে, খেরোর খাতা-সংক্রান্ত মাঙ্গলিক আচার শেষ হলে, বাড়ির গুরুজনদের প্রণাম সেরে, মুখে আলগোছে দু'-এক কুচি প্রসাদি ফল এবং মিষ্টি ফেলা। প্রসাদি মিষ্টির মধ্যে ভাল ঘিয়ের দরবেশ অবশ্যই থাকত, কারণ গণেশদাদার নাকি দরবেশ অসম্ভব প্রিয় ছিল। এরপর সেই নতুন পোশাকেই ছাতা মাথায় রোদ বাঁচিয়ে আত্মীয়বন্ধুদের বাড়িতে গিয়ে সে-বাড়ির গুরুজনদের নববর্ষের প্রণাম জানানো। চৈত্র শেষেই বাংলায় যেহেতু ভালরকম গরম পড়ে যায়, তাই পাখার নিচে কিছুক্ষণ বিশ্রাম নেওয়ার পরে হাতে আসত সুদৃশ্য কাচের গেলাসে কুঁজোর ঠান্ডা জল দিয়ে তৈরি একগ্লাস অপূর্ব সরবৎ। বাড়িতে বানানো এই সরবৎগুলির মধ্যে বেশি চালু ছিল ঘোলের সরবৎ, লেবু-চিনির সরবৎ, বেলের পানা এবং তরমুজের সরবৎ। ঘোলের সরবতের ভেতর থেকে ছোট এলাচগুঁড়োর একটা হাল্কা সুগন্ধ বেরত। আর সরবতের মধ্যে কখনওই কোনও ফলের দানা ভেসে থাকত না। এরপর আসত মিষ্টি এবং নোনতা মেশানো একটি কাজ করা কাচের থালা। তাতে থাকত বাড়িতে তৈরি গুড় অথবা চিনির নাড়ু, মিষ্টি খাজা, বাড়িতে কাটানো ছানা দিয়ে তৈরি লেবু সন্দেশ কিংবা ছানার পায়েসের মতো লোভনীয় কিছু মিষ্টি। নোনতার মধ্যে থাকত বাড়িতে বানানো নিমকি বা বাঙালি শিঙাড়া অর্থাৎ যার ভেতরে পুর হিসেবে টুকরো সাদা আলুর তরকারি এবং ভাজা বাদাম পোরা থাকত- অবাঙালি সামোসার মতো এন্তার গরমমশলা এবং শুকনো লংকা দিয়ে নাড়া আলুচটকানি নয়। তা নইলে থাকত ফুটফুটে জ্যোৎস্নার মতো পাতলা লুচি কিংবা কড়ায়ের ডালের পুর দেওয়া তন্বী হিংয়ের কচুরি এবং তার সঙ্গে যোগ্য সংগত করার মতো নারকোলের কুচি ছড়ানো ঘন ছোলার ডাল। কোনও কোনও বাড়িতে এর সঙ্গে পাওয়া যেত একবাটি অনবদ্য মটরের ঘুগনি। এই জলযোগের পর খানিকক্ষণ গল্পগুজব সেরে হেঁটে বাড়ি ফিরতে হত। তাতে হজমযন্ত্রটা খানিক চাঙ্গা হয়ে উঠত, কারণ তার কিছু পরেই তো মধ্যাহ্নভোজ।
নববর্ষের দিনে খাওয়াদাওয়ার দ্বিতীয় পর্যায়টি হল এই মধ্যাহ্নভোজ। সম্ভ্রান্ত বনেদিবাড়িতে পয়লা বৈশাখের দিন দুপুরের খাওয়ার আয়োজনে সবসময়ই থাকত বাঙালিয়ানার ছোঁয়া। বাড়ির গুরুজনদের আত্মীয়-বন্ধুদের সূত্র ধরে তেমন নেমন্তন্ন প্রতি বছর এক-আধটা আসত। তখন বাড়ির ছাদে ম্যারাপ বেঁধে, কাঠের লম্বা টেবিল-চেয়ারে বসিয়ে লোক খাওয়ানো হত। খেতে দেওয়া হত বা হয় স্নিগ্ধ-সবুজ কলাপাতায়, নয়তো কাঠি গুঁজে-গুঁজে বানানো শালপাতার সুন্দর গোল থালায়। বাটি এবং খুরি ছিল লাল মাটির তৈরি। প্রথম পাতে সাদা ফুরফুরে গরম ভাতের ওপর এক পলা গাওয়া ঘি ঢেলে দেওয়া হত। গরম ভাত কলাপাতার শরীরের সঙ্গে মিশে এক আশ্চর্য গন্ধ তৈরি করত, ইদানীং আর যার খোঁজ মেলে না। এরপর লাইন দিয়ে আসত তেতো, শুক্তো, সোনামুগের ডাল, আলু-পটল-বেগুন-উচ্ছে-নারকোল- এমন দু’তিনরকম ভাজা এবং একটি বড়ি গুঁড়োনো শাকভাজা। এখানে বলা প্রয়োজন, বেগুনভাজা হলে তা অবশ্যই হত লম্বালম্বি কাটা এবং ল্যাজ বের করা। বেগুনি হলে তা-ও হত বেশ লম্বাটে। আর সেই মুচমুচে বেগুনি খেতে খেতে পেট ভরে যেত, অন্য পদগুলো আর সেইভাবে খাওয়া হত না। হত চন্দ্রমুখী আলু বা সদ্য ওঠা কচি ঝিঙে দিয়ে বানানো একটি মিষ্টি-মিষ্টি পোস্তর পদ। গরুর দুধের ছানা কাটিয়ে, তার ছোট ছোট গুলি পাকিয়ে, ঘিয়ে ভেজে, সেই বড়া দিয়ে রসুয়ে বামুনরা অসামান্য একটি মাখো-মাখো ছানার ডালনা বানাতেন। এতে আবার ডুমো ডুমো করে ভাজা কিছু আলুও পড়ত। জীবনানন্দের কবিতার চিলের ডানার মতো সোনালিরঙা সেই ডালনা সহযোগে পোলাও এবং লুচি দুই-ই স্বর্গীয় মনে হত। গোবিন্দভোগ চালের জাফরান শোভিত বাঙালি পোলাওটি পরিবেশন করা শুরু হত ওই ছানার ডালনার সঙ্গে সঙ্গেই। আর এরপরে আসত রকমারি আমিষ পদ।
আরও পড়ুন: পাড়ার সেইসব নববর্ষের সন্ধে ছিল ইন্দ্রজালের মতো
শোনা যায়, জমিদাররা নাকি এইদিন রাত থাকতে ধীবর প্রজাদের দিয়ে, তাঁদের নিজস্ব পুকুর থেকে এবং স্থানীয় নদী থেকে নানা ধরনের মাছ ধরিয়ে এনে, রাঁধুনি ঠাকুরকে দিয়ে চমৎকার সব পদ রান্না করাতেন। রুই মাছের বড় বড় পুস্তা-কাটা টুকরো দিয়ে রান্না করা দই-রুই আর তার মুড়ো দিয়ে বানানো উৎকৃষ্ট মুড়িঘণ্ট, আবহমানকাল ধরে ভোজনপ্রিয় বাঙালির রসনার সম্মান রক্ষা করে এসেছে। সম্ভ্রান্ত বনেদিবাড়িতে অতিথিদের জন্য চিতলের সুবিশাল পেটি বা ভেটকিমাছের কালিয়ার মতো কোনও পদ রান্না হলে, তা তাঁদের বাঙালিয়ানায় আলাদা একটা মাত্রা যোগ করত। গলদা বা বাগদা চিংড়ির মালাইকারির শুধুমাত্র কাইটুকুর জন্যে কতশত হৃদয় যে উন্মুখ হয়ে থাকত তার কোনো ইয়ত্তা নেই। এমনই একটি নববর্ষের নেমন্তন্নে গিয়ে, বেসমে চোবানো তোপসেমাছের বড়া, আম-কাসুন্দি ঠেকিয়ে ঠেকিয়ে খেয়ে সাতিশয় পুলকিত হয়েছিলাম- একথা আজও বেশ মনে পড়ে।
মাছপর্ব শেষ হলে শুরু হত মাংসের পালা। আগে অধিকাংশ হিন্দু বাঙালি বাড়িতে মুরগির কোনও প্রবেশাধিকার ছিল না। তাই মাংস বলতে মানুষ বুঝত পাঁঠার মাংস। আমাদের ছোটোবেলার কলকাতাতে কিন্তু খাসির তত রমরমা ছিল না। গোপালচন্দ্র মুখোপাধ্যায়ের মতো মানুষও কলকাতার বুকে ছড়িয়ে থাকা পাঁচটি মাংসের দোকানে চিরকাল পাঁঠার মাংসই বিক্রি করে এসেছেন। তাই তাঁর নাম হয়ে গিয়েছিল গোপাল পাঁঠা। তখন নিউ মার্কেট বা পার্ক সার্কাসের হাতে গোনা যে দু'-একটি দোকানে খাসির মাংস পাওয়া যেত, তার দাম ছিল পাঁঠার চেয়ে বেশ কিছুটা ওপরে। আর পোলট্রি মুরগি বলে যে কোনও বস্তু হয়, সেটা বেশিরভাগ গেরস্তরই তখন অজানা ছিল। মুরগি মানে তখন চরে বেড়ানো দেশি মুরগি বা বনমোরগ। সেই সময় মাংসের পদের মধ্যে কচি পাঁঠার টলটলে ঝোল, সোমত্থ পাঁঠার মাংসের ঝাল-ঝাল কালিয়া, কোর্মা এবং কষা- এগুলোই জনপ্রিয় ছিল। মাংস রান্না হলে তা একটু ঝাল-ঝাল হবে- এটাই ছিল রীতি। কিন্তু এখনকার মতো সেই সময়ের রান্নায় অত পেঁয়াজ-রসুন -আদা পড়ত না। মশলাকে ছাপিয়ে মাংসের নিজস্ব গন্ধটাকে সবসময় অনুভব করা যেত। কিছু কিছু উদারপন্থী বাড়িতে নববর্ষের দিনে বনমোরগের কষা যে হত না, তেমন নয়। কিন্তু তার সংখ্যা ছিল নগণ্য।
মাংসের আর একটি যে বাঙালি পদের কথা না বললেই নয়, সেটি হল মাংসের পোলাও। আমাদের ছোটবেলায় এখানকার হিন্দু বাঙালি বাড়ির অনুষ্ঠানে বিরিয়ানির তখনও অত রমরমা হয়নি, কারণ তার জায়গা দখল করেছিল মাংসের পোলাও। গোবিন্দভোগ চালের সঙ্গে জায়ফল, জয়ত্রী, গোটা গরমমশলা আর অনেকখানি গাওয়া ঘি মিশিয়ে, পাঁঠার সামনের রাং-এর হাড় ছাড়া বড় বড় মাংসের টুকরোকে ভাল করে পাক দেওয়া হত। যত পাক- ততই ভুরভুরে গন্ধ। আর সেই গন্ধে মন-প্রাণ সব আকুল হয়ে ওঠা। নববর্ষের দিন খাওয়াদাওয়ার শেষের দিকে অবশ্যই থাকত পাঁপড়ভাজা, কাঁচা আমের চাটনি, রসগোল্লা আর দুধসাদা কড়াপাক সন্দেশ। আর একদম শেষ পাতে হিমশীতল দধি। সেই দই অল্প অল্প করে খেতে খেতে নেশা ধরে যেত। কোথাও আবার কুলপি-মালাইয়ের ব্যবস্থাও করা হত। রাবড়িও খাওয়ানো হত কোনও কোনও বনেদিবাড়িতে।
সম্ভ্রান্ত বাড়িগুলোতে নববর্ষের দিন যে খাওয়াদাওয়া, তার সব পদ তো মধ্যবিত্ত বাঙালি বাড়িতে হওয়া কোনওদিনই সম্ভব ছিল না। কিন্তু তার মধ্যে যেগুলো হত সেগুলো গ্রহণ করে আমাদের মতো ছেলেছোকরাদের বাঙালিজীবন সার্থক হয়ে যেত। বাড়িতে মা-জ্যাঠাইমারা সেই প্রবল গরমের দিনে কত কষ্ট করে আমাদের জন্য সাতপদ রান্না করে কাঁসার থালায়, কাঁসার বাটিতে সাজিয়ে দিতেন। সেইসব সাবেক পদ্মকাটা বাটির ভেতর থেকে পদগুলির উপচে-পড়া সুগন্ধ এবং রঙের মাদকতা এখনও যেন চোখে ভাসে।
নববর্ষের দিন খাওয়াদাওয়ার তৃতীয় পর্যায়টি শুরু হত সন্ধে থেকে। এই খাওয়াদাওয়াটি চলত দোকানে দোকানে, যেখানে নববর্ষের হালখাতা উপলক্ষে গেরস্তকে নেমন্তন্ন করা হত। সেদিন ওই দোকানগুলোর দরজার ওপরটা আমপাতা আর কদমফুলের ঝালর দিয়ে সাজানো হত। গিয়ে বসলে সেখানকার কোনও কর্মচারী কাচের ছোটো সাইজের গেলাসে করে হাসিমুখে এগিয়ে দিতেন বরফকুচি ভাসানো আমপোড়া কিংবা জলজিরার উপাদেয় সরবৎ। কোথাও আবার স্ট্র সহযোগে এগিয়ে দেওয়া হত অধুনালুপ্ত ক্যাম্পাকোলার কালো পানীয় ভরা কাচের শিশি। এরপর কাচের ছোট প্লেটে রসগোল্লা, পান্তুয়া, নরমপাকের জলভরা সাদা তালশাঁস সন্দেশ, বোঁদে- এমন দু’তিন রকমের মিষ্টি এবং শিঙাড়া বা নিমকির মতো কোনও নোনতা খেতে দেওয়া হত। কোথাও আবার হাতে ধরিয়ে দেওয়া হত কালো গার্ডার আটকানো মাঝারি মাপের একটি মিষ্টির বাক্স- সঙ্গে রোল করে গোটানো বাংলা মাসের ক্যালেন্ডার। মিষ্টির বাক্স আর ক্যালেন্ডারের সংখ্যাটা নিশ্চিতভাবেই ব্যক্তিগত খাতিরের ওপর নির্ভর করত। আর দুপুরের খাবারে পেট ভরা থাকলে বসে খাওয়ার চেয়ে, বাক্সটা বাড়িতে নিয়ে আসাতেই বাঙালি চিরকাল বেশি আনন্দ পেয়েছে।