মানুষের বিশ্বাস, প্রস্রবণের জল সারাবে সব রোগ! ঘরের কাছের তীর্থ এই মহাপীঠ

বক্রেশ্বরের অন্যতম প্রধান আকর্ষণ হলো এর উষ্ণ প্রস্রবণগুলি। এই শহরে দশটি উষ্ণ প্রস্রবণ আছে। এগুলি হলো- পাপহরা গঙ্গা, বৈতরণী গঙ্গা, খরকুণ্ড, অগ্নিকুণ্ড, ভৈরবকুণ্ড, দুধকুণ্ড, সূর্যকুণ্ড, শ্বেতগঙ্গা, ব্রহ্মাকুণ্ড ও অমৃতকুণ্ড...

একান্ন সতীপীঠের অন্যতম হলো 'বক্রেশ্বর'। তারাপীঠ থেকে ৬৬ কিলোমিটার দূরেই রয়েছে সতীপীঠ বক্রেশ্বর। সতীহারা দেবাদিদেব মহাদেব যখন প্রলয়নৃত্য করছেন, তখন বিষ্ণুর সুদর্শন চক্র সতীর দেহ খণ্ডবিখণ্ড করলে দেবীর তৃতীয় নয়ন, মতান্তরে ভ্রূ-যুগলের মধ্যস্থান এখানে এসে পড়ে। তাই দেবী এখানে 'মা মহিষমর্দিনী'। এই গ্রামটির পূর্বনাম ছিল ডিহি।

স্থানটির সঙ্গে অষ্টাবক্র মুনির জন্ম কাহিনি জড়িত আছে। জনশ্রুতি অনুযায়ী পূর্বে এই স্থানটি ছিল ঘন জঙ্গলে পরিপূর্ণ। মাত্র কয়েক ঘর পরিবার এখানে বসবাস করত। তখন এই স্থানটির নাম ছিল ডিহি। অষ্টাবক্র মুনির মায়ের নাম ছিল সুজাতা এবং পিতা শাস্ত্রজ্ঞ-বেদজ্ঞ মহাপণ্ডিত কহোর মুনি। অন্তঃসত্ত্বা সুজাতাকে প্রতিদিন কহোর মুনি বেদ পাঠ করে শোনাতেন। গর্ভে থাকাকালীন রোজ বেদপাঠ শুনে শুনে জন্মের পূর্বেই বেদ সম্পর্কে সম্যক জ্ঞান লাভ করেছিলেন অষ্টাবক্র মুনি। এরকমই একদিন কহোর মুনি বেদ পাঠ করে শোনাচ্ছেন স্ত্রী সুজাতাকে, অন্যমনস্ক হয়ে তিনি বেদের একটি অংশ ভুল পাঠ করেছিলেন। তৎক্ষণাৎ গর্ভস্থ সন্তান তাঁর ভুল ধরিয়ে দেয়। কিন্তু এই ঘটনায় বেদজ্ঞানে পারদর্শী কহোর মুনির সম্মান ক্ষুন্ন হয়। সন্তানকে তিনি অভিশাপ দেন, অষ্টাঙ্গ বিকৃত হোক তার রূপ। পিতার অভিশাপে এই সন্তান শারীরিক প্রতিবন্ধকতা নিয়ে জন্মগ্রহণ করে।

এই সময় জনক নামে এক রাজা ছিলেন। তিনি তাঁর রাজসভায় শাস্ত্রজ্ঞ পণ্ডিতদের আমন্ত্রণ জানিয়ে ঘোষণা করেন, যিনি শাস্ত্রের নানা বিষয় শুনিয়ে তাঁকে খুশি করতে পারবেন, তাঁকে তিনি উপঢৌকন এবং অর্থে বিভূষিত করবেন। অর্থাভাবে জর্জরিত কহোর মুনি রাজসভায় উপস্থিত হন। কিন্তু রাজসভার পণ্ডিতদের কাছে পরাজিত হয়ে তাঁরই সেবায় নিযুক্ত হন এবং বন্দিদশা পালন করতে থাকেন। কালের নিয়মে সময় এগিয়ে যায়। অষ্টাবক্র মুনি মাত্র ১২ বছর বয়সেই মহাপণ্ডিত ও বেদজ্ঞ হয়ে ওঠেন। বড় হয়ে অষ্টাবক্র তাঁর বাবার বন্দিদশার কথা শোনেন মায়ের মুখ থেকে। তিনি রাজদরবারে উপস্থিত হন, কিন্তু প্রবেশপথে বাধা পান বালক অষ্টাবক্র। এরপর তিনি পণ্ডিতদের তর্কযুদ্ধে আহ্বান জানান এবং প্রত্যেককে পরাস্ত করেন। ফলস্বরূপ অষ্টাবক্র পিতাকে বন্দিদশা থেকে মুক্ত করে গৃহে ফিরিয়ে আনেন। সন্তানের এই সাফল্যে কহোর মুনি খুব খুশি হন এবং এবং নিজের কৃতকর্মের জন্য সন্তানের এই রূপ দেখে দুঃখিত হন। তিনি অষ্টাবক্রকে আশীর্বাদ করেন এবং বলেন, 'সমঙ্গ' নদীতে স্নান করলে তাঁর অঙ্গবিকৃতি দূর হবে। 'সমঙ্গ' কথাটির অর্থ হল সমান গতিতে বয়ে চলে যে নদী। এইরকম একটি জলাধারের খোঁজ করতে করতে অষ্টাবক্র ডিহি নামক গ্রামে এসে উপস্থিত হন। সেখানে ঘুরতে ঘুরতে পূর্বদিকের জঙ্গলের মধ্যে তিনি আটটি কুণ্ডের সন্ধান পান। আশ্চর্য হয়ে তিনি লক্ষ করেন যে, সাতটি কুণ্ডের জল গরম এবং একটি কুণ্ডের জল ঠান্ডা। এই সাতটি কুণ্ডের জল একসঙ্গে গিয়ে একটি নদীতে মিশেছে এবং সমানভাবে বয়ে চলেছে। তখন তিনি সেই সঙ্গমে স্নান করেন। তাঁর শরীরের সমস্ত প্রতিবন্ধকতা দূর হয়। এই কারণে নদীটিকে 'পাপ হরা' নদী বলা হয়ে থাকে।

আরও পড়ুন: সতীর জননাঙ্গ পড়েছিল, এখানে নারীর কাছে এখনও বশ পুরুষ, যে কাহিনি প্রচলিত

এরই সঙ্গে আরও একটি জনশ্রুতি শোনা যায় যে, এই জঙ্গল থেকেই অষ্টাবক্র মুনি একটি শিবলিঙ্গের সন্ধান পান এবং স্নান সেরে সেই শিবলিঙ্গের সামনে তিনি গভীর সাধনায় মগ্ন হন। এইভাবে অনেক বছর ধরে তিনি শিবের কঠিন সাধনা করেছিলেন এবং তাঁর ওপর সন্তুষ্ট হয়ে দেবাদিদেব মহাদেব তাঁকে শারীরিক বিকৃতি থেকে মুক্তি লাভের বর দিয়েছিলেন। পরবর্তীকালে শিবলিঙ্গটির নাম হয় বক্রনাথ এবং ডিহি গ্রামের নাম বদল হয়ে হয় বক্রেশ্বর।

বাবা বক্রেশ্বরকে (বক্রনাথ) কেন্দ্র করে এখানে আরও পাঁচটি শিবলিঙ্গ রয়েছে- কুবেরেশ্বর, সিদ্ধেশ্বর, জ্যোতিলিঙ্গেশ্বর, কালারুদ্রশ্বর ও জম্ভশ্বর। এইসব মন্দিরের পাশে পাশেই রয়েছে উষ্ণ জলের কুণ্ডগুলি। এই জলকুণ্ডগুলির একটি করে নাম আছে। আটটি কুণ্ড ছাড়াও আরও দু'টি কুণ্ড, অর্থাৎ মোট দশটি কুণ্ড বর্তমান। সেই নামগুলি হলো পাপহরা গঙ্গা, বৈতরণী গঙ্গা, ভৈরবকুণ্ড, খরকুণ্ড, অগ্নিকুণ্ড, দুধকুণ্ড, সৌভাগ্যকুণ্ড বা অমৃতকুণ্ড, সূর্যকুণ্ড, ব্রহ্মাকুণ্ড ও শ্বেতকুণ্ড। এই কুণ্ডগুলিকে কেন্দ্র করেও পৌরাণিক কাহিনি প্রচলিত রয়েছে।

এখানে সতী 'মাতা মহিষমর্দিনী'-রূপে বিরাজমান।মহিষমর্দিনী দশভূজার মূর্তিটি পিতলের। জনশ্রুতি আছে, এই দশভুজার মূর্তির নিচে একটি গর্তের ভিতর মায়ের দেহাংশটি রাখা আছে, অর্থাৎ সতী মায়ের তৃতীয় নয়ন এখানেই অবস্থান করছে। ঐতিহাসিকরা বলেন, এই পীঠে আগে অন্য দেবীমূর্তি ছিল। সুলতানের সেনাপতি 'কালাপাহাড়'-এর আক্রমণের হাত থেকে রক্ষা করার নিমিত্তে মা দুর্গার ১৮ হাত মূর্তিটিকে পুকুরে লুকিয়ে রাখা হয়েছিল। অনেকদিন পরে বর্তমান মন্দির থেকে অনেক দূরে 'ধরমগড়' নামক একটি স্থানে আচার্যদের দুর্গামন্দির-সংলগ্ন পুকুর থেকে একটি আঠারো হাত দুর্গা মূর্তি পাওয়া যায়। এই আচার্য পরিবার বংশপরম্পরায় বক্রেশ্বরের সেবাইত। হরেকৃষ্ণ মুখোপাধ্যায়ের লেখা 'বীরভূমের বিবরণ' বইটি থেকে জানা যায়, ১৩২২ সালে এই পাথরের মূর্তিটি আচার্যবাড়ির দুর্গামন্দির-সংলগ্ন পুকুর থেকে উদ্ধার হয়। মূর্তির নিচে এবং ওপরে চালচিত্র করে কৌমরি, ইন্দ্রাণী, বৈষ্ণবী, বারাহি ইত্যাদি ন'টি শক্তি মূর্তি খোদিত রয়েছে। ধারণা করা হয়, এই মূর্তিটিই শক্তিপীঠের আসল মূর্তি। প্রত্যেকটি শক্তিপীঠের মতো এখানেও একজন ভৈরব আছেন। ভৈরব বটুকনাথ। তাঁর দর্শন পেতে গেলে একটু পাতালে প্রবেশ করতে হয়।

দুধসাদা বক্রেশ্বর তার অত্যাশ্চর্য রূপ এবং মহিমান্বিত স্থাপত্যশৈলিতে বারবার দেশ-বিদেশের পর্যটকদের আকর্ষণ করে চলেছে।

বক্রেশ্বরের অন্যতম প্রধান আকর্ষণ হলো এর উষ্ণ প্রস্রবণগুলি। এই শহরে দশটি উষ্ণ প্রস্রবণ আছে। এগুলি হলো- পাপহরা গঙ্গা, বৈতরণী গঙ্গা, খরকুণ্ড, অগ্নিকুণ্ড, ভৈরবকুণ্ড, দুধকুণ্ড, সূর্যকুণ্ড, শ্বেতগঙ্গা, ব্রহ্মাকুণ্ড ও অমৃতকুণ্ড। খর, ভৈরব ও সূর্যকুণ্ডের জলের তাপমাত্রা যথাক্রমে ৬৬, ৬৫ ও ৬১ ডিগ্রি সেলসিয়াস। অগ্নিকুণ্ডের তাপমাত্রা ৮০ ডিগ্রি সেলসিয়াস।

মানুষের বিশ্বাস এই সকল কুণ্ডের জলে স্নান করলে সমস্ত পাপ দূরীভূত হয় এবং যাবতীয় রোগ নিরাময় হয়।

 

 

More Articles