ভারতের দুই রাজার নামে পোল্যান্ডে চলে ট্রাম! নেপথ্য কাহিনি আজও অজানা

Poland Tram History: শরণার্থীদের মধ্যে অধিকাংশই ছিল শিশু। বাচ্চাদের পড়াশোনার জন্য স্কুলও খোলেন মহারাজ। সেখানে পাঠ্যবই আনানো হতো পোল্যান্ড থেকে।

স্কুলের গুনগুন শব্দ ভেসে আসছে দূর থেকে। ভেতরে চলছে একঝাঁক বাচ্চাদের ক্লাস। স্কুলের দেওয়ালে ভারতীয় সংস্কৃতির বিভিন্ন শিল্পকর্ম আঁকা। স্কুলের নাম, ‘জামসাহেব দ্বিগবিজয় সিং জাদেজা স্কুল’। নাম শুনে যে কারও মনে হবে, খাঁটি ভারতীয় গুজরাতি স্কুল। আদতে এমনটা মোটেও নয়। স্কুলটি গুজরাত থেকে প্রায় ৬০০০ কিলোমিটার দূরে, পোল্যান্ডের রোক্ল শহরে অবস্থিত। আর এই শহরেই দাঁড়িয়ে রয়েছে একটি ট্রাম, রাজার ট্রাম। প্রশ্ন ওঠা স্বাভাবিক, একজন গুজরাতি মহারাজার নামে সেই কোন পোল্যান্ডে স্কুল তৈরি হলো কেন! এই রাজার ট্রামটিই বা কীভাবে এল এখানে? উত্তর খুঁজতে ফিরে যেতে হবে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময়ে।

১৯৩৯ সালের ২৩ অগাস্ট একটি সন্ধি স্বাক্ষরিত হয় সোভিয়েত ইউনিয়ন এবং জার্মানির মধ্যে। সন্ধিতে লেখা ছিল, দুই দেশ একে অপরকে কোনও পরিস্থিতিতেই আক্রমণ করবে না। তবে যা লেখা ছিল, তার থেকেও অনেক বেশি গুরুত্বপূর্ণ ছিল অলিখিত শর্তগুলি। এই সন্ধি কার্যকরী করার পিছনে এক অলিখিত শর্ত ছিল দুই পক্ষেরই। স্তালিন এবং হিটলার দু'জনেই ঠিক করেন তাঁরা পোল্যান্ড দখল করবেন। পূর্ব পোল্যান্ড স্তালিন দখল করবেন এবং পশ্চিম পোল্যান্ড দখল করবেন হিটলার। এই সন্ধির নাম ছিল মোলোটভ-রিবেনট্রপ সন্ধি। সন্ধি মোতাবেক, ১ সেপ্টেম্বর হিটলার পোল্যান্ড আক্রমণ করেন এবং সরকারিভাবে শুরু হয়ে যায় দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ। এর ১৫ দিন পর, অর্থাৎ ১৬ সেপ্টেম্বর পূর্বদিক থেকে স্তালিন পোল্যান্ড আক্রমণ করেন। পশ্চিমে হিটলার আর পূর্বে স্তালিন, মাঝখানে পড়ে পোল্যান্ড দু' টুকরো হয়ে যায়। জার্মান অধিকৃত পোল্যান্ডে নির্বিচারে ইহুদি হত্যা হয়, কনসেন্ট্রেশন ক্যাম্প তৈরি হয়, গ্যাস চেম্বার তৈরি হয়- এই ইতিহাস সর্বজনবিদিত। কিন্তু রুশ অধিকৃত পোল্যান্ডে কী হয়েছিল, তা নিয়ে ইতিহাসে অতটা আলোচনা হয় না। রেড আর্মি পূর্বদিক থেকে পোল্যান্ডে ঢুকে স্থানীয় পোলিশদের আশ্বস্ত করেছিল যে, তারা জার্মানিকে রুখতে এসেছে। কিন্তু অল্প সময়ের মধ্যেই সেই ভুল ভেঙে যায়। রাশিয়ার সিক্রেট পুলিশ প্রায় পাঁচ লক্ষ পোলিশ নাগরিককে বন্দি করে এবং অকথ্য অত্যাচার চালায়। এরপর ১৯৩৯ সালের নভেম্বর মাসে একপ্রকার লোক দেখানো ভোট হয় পূর্ব পোল্যান্ডে। সেই ভোটের ফলাফলের দোহাই দিয়ে সোভিয়েত ইউনিয়ন ‘গণতান্ত্রিক’ ভাবে পোল্যান্ডের অর্ধেক দখল করে নেয়। একইসঙ্গে পোল্যান্ড সরকারের অনেক উচ্চপদস্থ আধিকারিক এবং পোলিশ আর্মির উচ্চপদস্থ জেনারেলদের মৃত্যুদণ্ড দেওয়া হয়। এই সময় রুশ অধিকৃত পোল্যান্ডের জনসংখ্যা ছিল প্রায় ১.৩ কোটি।

রাজার ট্রাম

 ১৯৪১ সালে জার্মানি যখন সোভিয়েত আক্রমণ করে, তখন পূর্ব পোল্যান্ডে অনেক গণকবর আবিষ্কৃত হয়। এই সম্বন্ধিত একটি বিস্তারিত রিপোর্ট পেশ করে জার্মানি। যদিও আমেরিকা, ব্রিটেন এবং মিত্রশক্তির অন্যান্য দেশ সেই সময় এই রিপোর্টকে নাৎসি প্রোপাগান্ডা বলে উড়িয়ে দেয়। ১৯৩৯ থেকে ১৯৪১ পর্যন্ত স্তালিন পোল্যান্ড থেকে পোলিশদের বিতাড়িত করে তাজাকিস্তান বা সাইবেরিয়ার মতো দুর্গম এলাকায় পাঠিয়ে দেন। সেখানে স্তালিনের লেবার ক্যাম্প ছিল, যাকে ‘গুলাক’ বলা হয়। গুলাককে সংশোধনাগার বলা হলেও, তা নরকের চেয়ে কিছু কম ছিল না। এখানে বন্দিদের দিয়ে হাড়ভাঙা পরিশ্রম করানো হতো, পরিবর্তে পরিমিত খাবার দেওয়া হতো না। অনেক সময় অভুক্তও রাখা হত। একটি রিপোর্ট অনুযায়ী, ১৯৩০-এর দশকে প্রায় ৪০ লাখ মানুষ আসেন গুলাকে। তার মধ্যে ১৭ লাখ মানুষই মারা যান এবং মৃতদের এক তৃতীয়াংশই ছিল নাবালক-নাবালিকা। তবে ১৯৪১ সালে হিটলার সোভিয়েত আক্রমণ করলে পরিস্থিতি পাল্টে যায়। স্তালিন শরণাপন্ন হন ব্রিটেনের। পোল্যান্ডের নির্বাসিত সরকার ব্রিটেনে আশ্রয় নিয়েছিল। পোল্যান্ডের নির্বাসিত সরকার এবং স্তালিনের মধ্যে কূটনৈতিক আলোচনা শুরু হয়। স্তালিন আশ্বস্ত করেন যে, তিনি আর পোলিশদের ওপর অত্যাচার করবেন না, ‘নির্দোষ’ পোলিশদের ছেড়ে দেওয়া হবে এবং হিটলারের সঙ্গে স্বাক্ষরিত সমস্ত চুক্তি বাতিল করে দেবেন। ছাড়া পেয়ে বিক্ষুব্ধ পোলিশরা নিজেদের উপর হওয়া অত্যাচারের প্রতিশোধ নিতে উদ্যত হয়। পোলিশ জেনারেল ভ্লাদিভাস অ্যান্ডার্স 'অ্যান্ডার্স আর্মি' নামে একটি সেনাবাহিনী গড়েন। এই বিশাল সেনা গুলাক আক্রমণ করে সেখানকার বাকি বন্দিদের ছাড়িয়ে নেয়।

আরও পড়ুন- ট্রামের ভেতর জাদুঘর! অসম্ভব সম্ভব হয় কলকাতায়

মহারাজা দ্বিগবিজয় সিং জাদেজা

গুলাক থেকে ছাড়া পেয়ে বন্দি নারী এবং শিশুরা পালিয়ে যান পোল্যান্ড থেকে। কাস্পিয়ান সাগর পার করে তারা পৌঁছন ইরানে। কিন্তু সেখানেও এক সমস্যা। ইরানের উত্তরভাগ ততদিনে দখল করে নিয়েছে সোভিয়েত ইউনিয়ন। ফলত ইরান থেকেও পালাতে হয় সহায় সম্বলহীন নারী এবং শিশুদের। ইরান থেকে পালিয়ে তারা ভারত, উগান্ডা, দক্ষিণ আফ্রিকা, নিউজিল্যান্ডসহ বিভিন্ন দেশে গিয়ে আশ্রয় নেন। এভাবেই প্রায় পাঁচ হাজার শরণার্থী এসে পৌঁছয় গুজরাতের উপকূলে। স্বাধীনতার পূর্বে, গুজরাতে কচ্ছের দক্ষিণ দিকে নবনগর নামে একটি রাজ্য ছিল। স্বাধীনতার পর এই রাজ্যেরই নাম হয়ে যায় জামনগর এবং এটি গুজরাতের সঙ্গে যুক্ত হয়। সেই সময় নবনগর বা জামনগর রাজ্যের রাজা ছিলেন জামসাহেব দ্বিগবিজয় সিং রতনসিং জাদেজা। জামনগরের রাজাদের উপাধি ছিল ‘জামসাহেব’।

আরও পড়ুন- শেষ মুহূর্তে চেয়েছিলেন একটু কমলালেবু, জীবনানন্দের মৃত্যুর পর পুড়ে যায় ‘ঘাতক’ ট্রামটিও

ছত্রপতি শাহাজি

১৮৯৫ সালে জামনগরের রাজ পরিবারে জন্ম হয় দ্বিগবিজয় সিংয়ের। লন্ডনে পড়াকালীন ব্রিটিশ সেনায় যোগদান করেন তিনি এবং ১৯৩১ সালে ক্যাপ্টেন পদে থাকাকালীন অবসর গ্রহণ করেন। ১৯৩৩ সালে পিতা রতনসিংয়ের মৃত্যুর পর জামনগরের সিংহাসনে বসেন মহারাজা দ্বিগবিজয় সিং। এরপর দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ শুরু হলে মহারাজা দ্বিগবিজয় সিংকে ইম্পেরিয়াল ওয়ার ক্যাবিনেটের সদস্য করা হয়। এই সময়ই তাঁর রাজ্যে আবির্ভাব হয় পোলিশ শরাণার্থীদের। মহারাজা ছিলেন অত্যন্ত দরাজদিল! স্বভাবতই বাস্তুহারা, অসহায় শরণার্থীদের দিকে সাহায্যের হাত বাড়াতে কার্পণ্য করেননি তিনি। তবে মহারাজার এই সিদ্ধান্তের বিরোধিতা করেছিল তৎকালীন ব্রিটিশ সরকার। বিশ্বযুদ্ধে নিজেদের সহযোগী সোভিয়েত ইউনিয়নকে কোনওভাবেই চটাতে চাইছিল না তারা। মহারাজা দ্বিগবিজয় সিং অবশ্য সেই দিকে কর্ণপাতও করেননি এবং নিজের রাজ্যেই প্রায় পাঁচ হাজার শরণার্থীকে আশ্রয় দেন। শরণার্থীদের মধ্যে অধিকাংশই ছিল শিশু। বাচ্চাদের পড়াশোনার জন্য স্কুলও খোলেন মহারাজ। সেখানে পাঠ্যবই আনানো হতো পোল্যান্ড থেকে, যাতে শিশুরা নিজেদের মাতৃভাষায় পড়াশোনা করতে পারে। শোনা যায়, শরণার্থীদের উদ্দেশ্যে মহারাজ বলেছিলেন, “আমার রাজ্যের লোকেরা আমায় বাপু বলে ডাকে। তারা আমার কাছে সন্তানের মতো। তোমরাও আমায় বাপু বলেই ডেকো। তোমরাও আজ থেকে আমার সন্তান।”

পোলিশ শিশুদের সঙ্গে মহারাজা দ্বিগবিজয় সিং

সরকারি রক্তচক্ষুকে নাকচ করে দিয়ে মানবতাকেই মূলধন করে এগিয়েছিলেন মহারাজা দ্বিগবিজয় সিং জাদেজা। তবে পোলিশ শরণার্থীদের সংখ্যা বাড়তে থাকলে পরিস্থিতি আরও কঠিন হয়ে যায়। স্বাভাবিকভাবেই একা একজন রাজার পক্ষে এতজন মানুষকে আশ্রয় দেওয়া সম্ভব নয়। তখন মহারাজা দ্বিগবিজয় সিং শরণাপন্ন হলেন নিজের বন্ধু কোলাপুরের রাজা ছত্রপতি শাহাজির (দ্বিতীয়)। বন্ধুর ডাকে সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দেন ছত্রপতি শাহাজি। অর্থনৈতিক সাহায্য করতে এগিয়ে আসেন টাটা গোষ্ঠীর তৎকালীন কর্ণধার জে.আর.ডি টাটাও। পোলিশ শরণার্থীদের জন্য কোলাপুরে গড়ে ওঠে সুব্যবস্থাযুক্ত এক বসতি। সেখানে বাচ্চাদের থাকার জন্য আলাদা ঘর, বিছানা, পুষ্টিকর খাবার, শৌচাগার- সবকিছুর ব্যবস্থা করা হয়। মহারাজা দ্বিগবিজয়ের মতোই ছত্রপতি শাহাজিও স্কুল খুলেছিলেন বাচ্চাদের জন্য। উপাসনার জন্য চার্চও নির্মাণ করেন ছত্রপতি শাহাজি। ১৯৪২-৪৮ পর্যন্ত প্রায় ৬০০০ শরণার্থীকে আশ্রয় দিয়েছিলেন শাহাজি। অসহায় বাস্তুহারা মহিলা এবং শিশুদের সঙ্গে শরণার্থীর মতো নয়, অতিথির মতোই আচরণ করেছিলেন এই দুই রাজা। ভারতের সংস্কৃতিতে ‘অতিথি দেব ভবঃ'-র এক নজির তৈরি করেছিলেন এই দুই রাজা।

১৯৪৫ সালে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ শেষ হয়ে যাওয়ার পর পোল্যান্ড সোভিয়েত ইউনিয়নের অংশ হয়ে যায়। ১৯৪৬ সালে পোলিশ সরকার এই শরণার্থীদের দেশে ফিরিয়ে আনতে সচেষ্ট হয়। তবে ১৯৪৮ পর্যন্ত শরণার্থীরা ভারতেই ছিলেন এবং তারপরে অনেকে দেশে ফিরে যান। বাকিরা যারা দেশে ফিরে যাননি, তারা অন্যান্য দেশে গিয়ে বসতি গড়ে তোলেন। ১৯৯০ সালে সোভিয়েত ইউনিয়নের পতনের পর ফের স্বাধীন রাষ্ট্র হিসেবে আত্মপ্রকাশ করে পোল্যান্ড। পরবর্তীকালে মহারাজা দ্বিগবিজয় সিং জাদেজা এবং ছত্রপতি শাহাজিকে (দ্বিতীয়) পোল্যান্ডের সবচেয়ে বড় মরণোত্তর নাগরিক সম্মান অর্থাৎ ‘অর্ডার অব দ্য কমান্ডার ক্রস’-এ ভূষিত করা হয়। গত বছর ৩১ মে, এই দুই রাজার প্রতি সম্মান জানাতে রোক্ল শহরে একটি ট্রাম চালু করা হয়। ভারতীয় রাজদূত নাগমা মল্লিক এবং রোক্ল শহরের মেয়র জ্যাসেক সুত্রিকের উপস্থিতিতে চালু হয় ডোবরি মহারাজা (Dobry Maharaja অর্থাৎ Good King) নামক ট্রামটি। আকারে-আয়তনে বিশাল এই ট্রামটিকে রাজার ট্রামও বলা যায়, আবার ট্রামের রাজাও।

More Articles