ট্রামের ভেতর জাদুঘর! অসম্ভব সম্ভব হয় কলকাতায়
কলকাতার পরিচিত ইন্ডিয়ান মিউজিয়াম ছাড়াও আরও বহু মিউজিয়াম এবং প্রদর্শনী আমাদের বহু ইতিহাসের চোখের সামনে তুলে ধরে।
কলকাতায় জাদুঘর বলতে প্রায় প্রত্যেকেই ইন্ডিয়ান মিউজিয়াম অথবা ভারতীয় জাদুঘরের নাম বলে থাকবে। সমগ্র এশিয়ার অন্যতম বড় এবং পুরনো মিউজিয়ামের তালিকায় এই জাদুঘর রয়েছে। প্রত্যেক বছর বহু মানুষ এই জাদুঘর দেখতে আসেন। কলকাতায় ভারতীয় জাদুঘর ছাড়াও আরও অনেক জাদুঘর এবং প্রদর্শনী চলছে, যেগুলি ইতিহাসের অনেক তথ্য আমাদের সামনে তুলে ধরে। এই ধরনের জাদুঘর এবং প্রদর্শনীগুলি প্রধানত কোনও বিখ্যাত মনীষী, অধ্যায়, বিষয় অথবা বস্তুকেন্দ্রিক। কলকাতার বিভিন্ন প্রান্তে অবস্থিত এই মিউজিয়াম এবং প্রদর্শনীগুলি কম খরচে সহজেই ঘুরে দেখে নেওয়া যায়।
কলকাতার ঐতিহ্যগুলির মধ্যে একটি হলো ট্রাম। কলকাতার প্রাণকেন্দ্র ধর্মতলায় রয়েছে ট্রাম মিউজিয়াম। কে. সি. দাসের দোকানের বিপরীতে ধর্মতলার ট্রামডিপোর প্রবেশ পথ থেকে প্রবেশ করে ট্রামগুলো যেদিকে এগিয়ে যায়, সেদিকে ট্রামলাইন ধরে কয়েক মিনিট হেঁটে এগিয়ে গেলেই দেখা যায় এই মিউজিয়াম। এই মিউজিয়ামের নাম 'স্মরণিকা'। ট্রাম মিউজিয়াম বানানোর জন্য একটি আস্ত ট্রাম ব্যবহার করা হয়েছে। তাই আপাতদৃষ্টিতে একে মিউজিয়াম বলে চিহ্নিত করা যায় না। এই মিউজিয়ামের উদ্বোধন হয়েছিল ২০১৪ সালে। সি.টি.সি দ্বারা পরিচালিত স্মরণিকার প্রবেশমূল্য দশ টাকা। দুই কামরার এয়ারকন্ডিশনড ট্রামটির দ্বিতীয় কামরায় রয়েছে সংগ্রহশালা। ট্রামের বিভিন্ন পরিবর্তিত রূপের মডেল এবং ছবি , ট্রামের যন্ত্রাংশ, টিকিট এবং মান্থলি পাসের বিবর্তন, ড্রাইভার এবং কনডাক্টরের পোশাক স্মরণিকার সংগ্রহে রয়েছে। সি.টি.সি-র জন্মলগ্ন থেকে বিভিন্ন অধ্যায়ের কথা স্মরণিকার সংগ্রহ থেকে জানা গেলেও তার পূর্ববর্তী কোনও ইতিহাস এই মিউজিয়ামে নেই। ট্রামের প্রথম কামরাটিকে একটি ছোট ক্যাফেতে রূপান্তরিত করা হয়েছে। সেখানে চা, কফি এবং কিছু শুকনো খাবার পাওয়া যায়। স্মরণিকার ভেতরে মোবাইল ফোনে ছবি তোলার ক্ষেত্রে সমস্যা না থাকলেও ক্যামেরা দিয়ে ছবি তোলার ক্ষেত্রে নিষেধাজ্ঞা থাকতে পারে। প্রত্যহ দুপুর একটা থেকে সন্ধে আটটা অবধি স্মরণিকা দর্শকদের জন্য খোলা থাকে।
আরও পড়ুন: মেটকাফ হল যেন টাইমমেশিন! পা রাখলেই বাঙালির ইতিহাসে ডুব
৩৮, এলগিন রোড। বহু মানুষের কাছে ঠিকানা অপরিচিত হলেও বাড়িটার একটা নাম রয়েছে। বাড়িটার নাম 'নেতাজী ভবন'। নেতাজির স্মৃতিবিজড়িত এই বাড়ি বহু ইতিহাসের সাক্ষী। এই বাড়িতে নেতাজিকে কেন্দ্র করেই তৈরি হয়েছে এক সংগ্রহশালা। আশুতোষ মুখার্জি রোড থেকে বাঁদিকে এলগিন রোড ধরে সোজা মিনিটপাঁচেক হাটলে রাস্তার ডানদিকে পড়ে 'নেতাজী ভবন'। শম্ভুনাথ পণ্ডিত হাসপাতালের পিছনের দিকে কয়েক মিনিট হাঁটা পথে এই বাড়িতে পৌঁছনো যায়। এই বাড়ির নিকটবর্তী দু'টি মেট্রো স্টেশন হলো রবীন্দ্র সদন এবং নেতাজী ভবন। সোমবার বাদে সপ্তাহের বাকি সব দিন বেলা এগারোটা থেকে বিকেল পাঁচটা অবধি নেতাজী ভবনের সংগ্রহশালা দর্শকদের জন্য খোলা থাকে। নেতাজী ভবনের প্রবেশমূল্য কুড়ি টাকা। নেতাজীর নিজের হাতের লেখা অমূল্য চিঠিপত্র থেকে বিভিন্ন ছবি রয়েছে এই বাড়িতে। নেতাজির ব্যবহৃত খাট, বিভিন্ন পোষাক, আসবাবপত্র এই বাড়িতে যত্ন করে সাজিয়ে রাখা হয়েছে। নেতাজী ভবনে প্রবেশ করলেই ডানদিকে পড়ে টিকিট কাউন্টার। একতলায় টিকিট কাউন্টারের কাছেই রাখা রয়েছে একটি গাড়ি। এই গাড়িতেই নেতাজি ব্রিটিশদের চোখে ধুলো দিয়ে কলকাতা ছেড়ে চলে গিয়েছিলেন। একতলায় গাড়ির ছবি তুলতে কোনও বাধা না থাকলেও দোতলায় ক্যামেরা ব্যবহারের ক্ষেত্রে নিষেধাজ্ঞা রয়েছে। দোতলায় নেতাজির জন্ম থেকে বিভিন্ন সময়ের বিভিন্ন মূল্যবান নথি রয়েছে। আজাদ হিন্দ ফৌজের অভ্যর্থনার সময় পাওয়া ফুলের মালা, জার্মানি থেকে জাপানের উদ্দেশ্যে যাত্রার পূর্বে দাদাকে নিজের হাতে লেখা চিঠি, আজাদ হিন্দ ফৌজের উর্দি, অস্ত্র, হিটলারের সঙ্গে করমর্দনের ছবি তার মধ্যে উল্লেখযোগ্য। দোতলায় একটি ঘরে নেতাজির দেওয়া বিভিন্ন ভাষণ শোনা যায়। সেই ঘরে তাঁর গলার আওয়াজের প্রতিধ্বনি হয় । দোতলার বারান্দায় বাড়ি থেকে তাঁর চলে যাওয়ার পথ দেখানোর জন্য পদচিহ্ন আঁকা রয়েছে।
ব্যাঙ্কশাল কোর্ট থেকে হেয়ার স্ট্রিট ধরে গঙ্গার দিকে হাঁটলে হেয়ার স্ট্রিট এবং স্ট্র্যান্ড রোডের সংযোগস্থলে সাদা রঙের এক প্রাসাদপ্রমাণ বাড়ি দেখা যায়। এই বাড়িটির নাম মেটকাফ হল। বর্তমানে মেটকাফ হলে বাংলা এবং বাঙালির সাহিত্য, সংস্কৃতি, শিল্প, ইতিহাস সংক্রান্ত এক প্রদর্শনী চলছে। এই প্রদর্শনীর নাম 'আমি কলকাতা'। মঙ্গলবার থেকে রবিবার সকাল দশটা থেকে বিকেল পাঁচটা অবধি মেটকাফ হল দর্শকদের জন্য খোলা থাকে। প্রবেশমূল্য কুড়ি টাকা। মেঝেতে আঁকা আলপনা থেকে দেওয়ালে টাঙানো পুরনো কলকাতার ছবি, বিভিন্ন মনীষীদের বিখ্যাত উক্তি, অসাধারণ কিছু সিনেমার এবং বিজ্ঞাপনের পোস্টার থেকে বাংলা এবং বাঙালির জীবনযাত্রা, হাতে টানা রিকশা থেকে দাঁড় টানা নৌকো- সবই মেটকাফ হলের দু'তলার বিভিন্ন ঘরে ফুটে উঠেছে।
কলকাতার পরিচিত ইন্ডিয়ান মিউজিয়াম ছাড়াও এই তিনটে এবং আরও বহু মিউজিয়াম এবং প্রদর্শনী আমাদের বহু ইতিহাসের চোখের সামনে তুলে ধরে।