করোনায় শেষ ভবিষ্যত, স্কুল ছেড়েছে লক্ষ লক্ষ শিশু

অনেক ক্ষেত্রেই করোনা সংক্রমিত বাবা-মায়ের কিংবা অভিভাবকদের মৃত্যুর পরে শিশুরা অনাথ হয়ে পড়েছে। দুধের দাঁত ভাঙেনি অথচ সইতে হচ্ছে প্রিয়জনের মৃত্যুযন্ত্রণা। প্রিয়জন হারানোর বেদনার পাশাপাশি অর্থনৈতিক সঙ্কটের ভয়াবহ রূপের মুখে পড়ে শিশু, কিশোর-কিশোরীদের মধ্যে অনেকেই এখন স্কুলছুট।

সম্প্রতি বিষয়টিতে সুপ্রিম কোর্ট হস্তক্ষেপ করেছে। সুপ্রিম কোর্ট নির্দেশ দিয়েছে, 'জাতীয় শিশু অধিকার সুরক্ষা কমিশন'কে করোনা সংক্রমিত হয়ে বাবা-মা অথবা অভিভাবকের মৃত্যুর পরে যে ছেলেমেয়েরা স্কুলের লেখাপড়া ছেড়ে দিয়েছে তাদের সম্পর্কে অ্যাকশন প্ল্যান সম্পর্কে রিপোর্ট জানাতে হবে সুপ্রিম কোর্টের কাছে।

বিপুল সংখ্যক শিশু বাবা-মা অথবা অভিভাবক করোনা সংক্রমিত হয়ে মারা যাওয়ার পরে অর্থনৈতিক তীব্র দুর্দশার সম্মুখীন গত দুবছর ধরেই। যদিও শৈশবে দারিদ্র্যপীড়িত জীবনের সাক্ষী থাকার কথা নয় স্বাধীন দেশের শৈশবকে।

বাবা-মা, অভিভাবক হারিয়ে অনাথ বহু শিশুরই দুবেলা পেটভরে খাবার জুটছে না। স্কুলে পড়তে যাওয়া তাঁদের পক্ষে বিলাসিতা। একাধিক সরকারি এবং বেসরকারি সমীক্ষায় ধরা পড়েছে এই উদ্বেগজনক তথ্য।

ভারতীয় সংবিধানের আর্টিকেল ২১ অনুযায়ী স্কুলে পড়ার অধিকার সাংবিধানিক অধিকার। এদিকে করোনা পরিস্থিতিতে শিশু এবং কিশোর-কিশোরীরা প্রিয়জনকে হারিয়ে ফেলার পরে দেশজুড়ে শিশুপাচারের ঘটনাও পাল্লা দিয়েছে বেড়েছে। গড়ে ১০ বছর বয়সি শিশুরা পাচারকারীদের খপ্পরে পড়েছে বলে স্বেচ্ছাসেবীরা জানিয়েছেন। 

পরিস্থিতি যথেষ্ট উদ্বেগজনকই। ইতিমধ্যেই 'দিল্লি কমিশন ফর প্রোটেকশন অব চাইল্ড রাইটস' জানিয়েছে, সারা দেশের ৩ কোটি ৫০ লক্ষ শিশুর সুস্থভাবে বেঁচে থাকতে হলে দরকার সামাজিক সুরক্ষার সুযোগ। বর্তমানে সারা দেশে দু'কোটির বেশি শিশু বাবা-মাকে হারিয়ে অনাথ এবং অভিভাবকহীন।

কোভিডের প্রথম দফার ঢেউ ভারতে হামলা চালানোর পর থেকেই শিশুরা অনাথ হতে শুরু করে। স্বেচ্ছাসেবী সংস্থা 'চাইল্ড লাইন' জানিয়েছে, করোনার প্রথম দফার হানা চলাকালীন দুর্দশাগ্রস্ত শিশুদের কাছ থেকে স্বেচ্ছাসেবীরা ৪০ হাজার ফোন পেয়েছেন। একই অবস্থা ছিল করোনার দ্বিতীয় দফার হানার পরেও।

আরও পড়ুন-বিদ্যুৎ ঘাটতির পরিণাম কী? দেশ কি বড় বিপদের সম্মুখীন?

করোনা পরিস্থিতিতে স্কুলগুলো মাসের পর মাস বন্ধ ছিল। গত দুবছরে ভারতের বিভিন্ন রাজ্যে স্কুলগুলো একাধিকবার খুলেছে এবং বন্ধ হয়েছে। এসম্পর্কে ইউনিসেফের পেশ করা তথ্য অনুযায়ী, স্কুলগুলো মাসের পর মাস বন্ধ থাকার ফলে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে অন্তত ২৪.৭ কোটি স্কুলপড়ুয়া। পরে অনলাইনে ক্লাস চালু হলেও বহু দরিদ্র পড়ুয়া অনলাইন পরিষেবার সুযোগ নিতে পারেনি। অনলাইনে ক্লাস করতে নেটওয়ার্ক প্রায়শই না মেলায় প্রত্যন্ত এলাকার পড়ুয়াদের হিমশিম খেতে হয়েছে। এছাড়া ভারতে মোটে ২৪ শতাংশ পরিবারে ইন্টারনেটের সংযোগ রয়েছে।

ইউনিসেফ এও আশঙ্কা প্রকাশ করেছে, করোনা পরিস্থিতিতে স্কুলছুট পডুয়াদের ভিতর অনেকেরই ফের স্কুলে পড়ার সুযোগ নেই। এদের মধ্যে বেশিরভাগই ছাত্রী।

স্বেচ্ছাসেবী সংস্থা 'রাইটস টু এডুকেশন ফোরাম' জানাচ্ছে, ভারতে আরও এক কোটি স্কুলপড়ুয়া ছাত্রী আগামী দিনে স্কুলছুট হতে পারে। কারণ সেই আর্থিক অনটন।  

কেন্দ্রীয় সরকার অবশ্য স্বেচ্ছাসেবীদের পেশ করা তথ্য মানতে নারাজ। কেন্দ্রীয় সরকারের বক্তব্য, ছাত্রীদের স্কুলছুটের হার কমেছে। এরপর বিষয়টি নিয়ে সম্প্রতি হস্তক্ষেপ করেছে সুপ্রিম কোর্ট। আগামী সপ্তাহে জাতীয় শিশু অধিকার সুরক্ষা কমিশন আদালতে কী জানায়, তাই দেখার।

ভারত সরকারের ন্যাশনাল স্ট্যাটিসটিক্যাল অফিসের সমীক্ষায় দেখা যাচ্ছে, দেশে স্কুলছুটের হার ১২ .৬ শতাংশ। এর মধ্যে উচ্চ প্রাথমিক স্তরে ১৭.৫ শতাংশ পড়ুয়া লেখাপড়া ছেড়ে দিচ্ছে। মাধ্যমিক স্তরে স্কুলছুটের হার ১৯.৮ শতাংশ। প্রাথমিক স্তরেও স্কুলছুটের হার বাড়ছে।

কেন্দ্রীয় সরকারি সংস্থা ন্যাশনাল স্ট্যাটিসটিক্যাল অফিসের আরেকটি সমীক্ষা রিপোর্টে প্রকাশিত হয়েছে, স্কুলছুট ৩৬.৯০ শতাংশ ছাত্র লেখাপড়া ছাড়ছে পরিবারের অর্থনৈতিক সামর্থ্য না থাকায়। আর ৩০.২ শতাংশ ক্ষেত্রে ছাত্রীরা স্কুলের লেখাপড়া ছেড়ে দিতে বাধ্য হচ্ছে দারিদ্র্যের কারণে।  স্কুলছুট ছাত্রীদের মধ্যে ১৩.২ শতাংশের বিয়েও দিয়ে দিচ্ছেন অভিভাবকরা।

স্কুলছুট ছাত্রছাত্রীদের অনেকেই কেন্দ্রীয় সরকারি সংস্থা ন্যাশনাল স্ট্যাটিসটিকাল অফিসের সমীক্ষকদের জানিয়েছে, পরিবারে তীব্র আর্থিক অনটনে লেখাপড়া চালানো খুবই কঠিন। এজন্যে লেখাপড়া করার চেয়ে অর্থকরী কাজ করা জরুরি। তাতে সংসারের খানিকটা সুরাহা হবে।

স্বাধীনতার পর থেকে এদেশে রাজা এসেছে, রাজা বদলেছে। কিন্তু শিশুদের জীবন স্বাধীন দেশে আজও বাসযোগ্য হয়নি। করোনা ভাইরাসে বাবা-মা, অভিভাবকের মৃত্যুর পরে লক্ষ লক্ষ শিশু কঠোর বাস্তবের মুখে পড়েছে।

এ প্রসঙ্গে ন্যাশনাল স্ট্যাটিসটিকাল অফিসের সমীক্ষায় উল্লেখ করা হয়েছে, যে স্কুলপড়ুয়াদের মধ্যে সমীক্ষা চালানো হয়েছে তাদের ৩০ শতাংশই মনে করে অর্থকরী কাজ করা লেখাপড়া চালানোর চেয়ে সংসারের পক্ষে সুরাহার।

আদতে দেশের ভবিষ্যতের পক্ষে বর্তমান পরিস্থিতি ক্ষতিকারক। যদি ভবিষ্যতের লক্ষ লক্ষ ভারতীয় নাগরিক শিক্ষার সুযোগই না পায়, তবে দুভার্গ্যজনকভাবে ভবিষ্যতের সমাজ আর সুস্থ, স্বাভাবিক সমাজ হবে না।

করোনার প্রাদুর্ভাবে স্কুলগুলো বন্ধ হয়ে যাওয়ার পরে লক্ষ লক্ষ দরিদ্র পরিবারের স্কুলপড়ুয়া ছেলেমেয়ের বরাতে  মিড-ডে মিলও জোটেনি। অথচ ২০১৩ সালের 'জাতীয় খাদ্য নিরাপত্তা আইন' অনুসারে স্কুল পড়ুয়াদের মিড-ডে মিল পাওয়া আইনি অধিকার।

২০২০-২০২১ সালের ভারতে কোভিড পরিস্থিতি নিয়ে কেন্দ্রীয় অর্থমন্ত্রকের ইকোনমিক সার্ভে অনুসারে, কোভিড পরিস্থিতিতে ভারতে সবচেয়ে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছেন নিম্নবিত্ত পরিবারগুলি।

২০২০ সালের মার্চে প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি দেশজুড়ে অনির্দিষ্টকালের জন্যে লকডাউন ঘোষণার পরেই স্কুলগুলোও বন্ধ হয়ে যায়। এরপর দেশের সমস্ত রাজ্য এবং কেন্দ্ৰশাসিত এলাকাগুলিকে কেন্দ্রীয় সরকার নির্দেশ দেয়, মিড-ডে মিল বাবদ স্কুল পড়ুয়াদের জন্যে যেন ভাতা বরাদ্দ করা হয়। সেই প্রকল্পও মুখ থুবড়ে পড়েছে বলে শিশু অধিকার ও সুরক্ষা নিয়ে কাজ করছে, এমন একাধিক স্বেচ্ছাসেবী সংস্থার তরফে অভিযোগ করা হয়েছে।

কেন্দ্রীয় সরকার আগামী ৯ বছরে স্কুলছুটের হার শূন্যে নামাতে উদ্যোগ নিয়েছে। সেইসঙ্গে স্কুলছুটের হার কমাতেও ব্যবস্থা নেওয়া হচ্ছে কেন্দ্র্রের দাবি। তবে স্কুলছুট হওয়া ভারতে বছরের পর বছর ধরে জিইয়ে থাকা সামাজিক সমস্যা। করোনা হানা দেওয়ার আগেও ভারতে স্কুলছুট ছেলেমেয়ের সংখ্যা ছিল ৬০ লক্ষের বেশি।

চিনের পরেই ভারতের শিক্ষাব্যবস্থা বিশ্বের মধ্যে দ্বিতীয় বৃহত্তম। ভারতে মোট ১৫ লক্ষ স্কুল আছে। এই স্কুলগুলোতে ৯০ লক্ষের বেশি শিক্ষক -শিক্ষিকা আছে। প্রাক-প্রাথমিক থেকে উচ্চ মাধ্যমিক স্তর পর্যন্ত পড়ুয়ার সংখ্যা ২৬ কোটি ৬৫ লক্ষের বেশি।

More Articles