চামড়ার রং শেষ কথা নয়! বর্ণবাদকে বুড়ো আঙুল দেখিয়ে যাঁরা শাসন করেছেন পৃথিবী

Racism: প্রতি মুহূর্তে রাষ্ট্রের সর্বময় শাসককেই বিদ্ধ হতে হয়েছে জাতিগত-বর্ণগত বৈষম্যের!

কালো! জগতের আলো না বিড়ম্বনা, এই প্রশ্নেই বারবার বিতর্কিত হয়েছে চারপাশ। প্রতি মুহূর্তে ছড়িয়ে গিয়েছে কালোর কষ্ট। কালো মেয়ের গঞ্জনা থেকে শুরু করে কালো রঙের টানাপোড়েন। সমস্ত গুণ আর প্রতিভার দিননামচা ছাড়িয়ে শুধুমাত্র গায়ের রঙেই মজেছে তথাকথিত অশিক্ষিত সমাজ। কিন্তু অন্ধকারের পরেই নতুন সূর্যোদয়ের মতোই বিশ্বজুড়ে কালো রঙেই মেতেছে বিশ্ব। প্রত্যেক মুহূর্তে বিবর্তিত হয়েছে নয়া ইতিহাস।

পুরুষের বিভেদ ঘুচিয়ে কালো রঙের জাদুতে বিশ্বজয় করেছেন একাধিক। রাজকীয় আর দাসপ্রথার মায়াজালেও রুখে দাঁড়িয়েছেন অ্যাঙ্গোলার কৃষ্ণাঙ্গ রানি। প্রতিবাদে সোচ্চার হয়েছেন ফ্লোরেন্সের 'কালো রাজা' মেডিসি। আব্রাম গেনিবেল থেকে ব্রুস। একের পর এক কৃষ্ণাঙ্গ প্রতিবাদী-সম্রাটের আলোকে এই বিশ্ব বুঝেছে, রঙ নয় এগিয়ে যেতে মস্তিষ্ক প্রয়োজন সবার আগে। যেখানে আদিম যুগের কালো বর্ণের মুসা হয়েছেন ধনীদের সর্বোচ্চ।

এ তো গেল পুরাণকথা। কয়েকশো বছর আগের ইতিহাস। 'কালো'-দের এগিয়ে যাওয়ার দিননামচা। কিন্তু আজ? এই সময়ে দাঁড়িয়েও বিশ্বজুড়ে গুণের বশে কালো-ফরসার রূপভেদের একাধিক নিদর্শন সৃষ্টি হলেও বারবার সেখানেই থেকে গিয়েছে গলদ। একের পর এক রূপ-কাঁটায় বিদ্ধ হয়েছেন কেউ কেউ। প্রতি মুহূর্তে রাষ্ট্রের সর্বময় শাসককেই বিদ্ধ হতে হয়েছে জাতিগত-বর্ণগত বৈষম্যের!

আরও পড়ুন: নিশ্চিহ্ন হওয়ার মুখে নিকোবরের আদিম অধিবাসীরা, কেন প্রমাদ গুনছেন গবেষকরা

এই কালো মানুষের বিশ্বজোড়া কাণ্ডকারখানা। যাঁরা একের পর এক ক্ষমতায় দেখে রীতিমতো নাচিয়েছেন বাকিদের। ক্ষমতার বলে, ক্ষমতার বশে, নিজেদের গুণ দিয়েই নর্দমা বানিয়েছেন বৈষম্যকে। তবুও কেউ পেরেছেন, কেউ পারেননি! যার উদাহরণ আমরা দেখেছি কয়েকদিন আগেও। মার্কিন মুলুকে এক ভারতীয় মহিলা অপমানিত হয়েছেন শুধু গায়ের রঙের জন্য। এই কালো হিরেদের বিশ্বজোড়া খ্যাতির শিখরে থাকা কয়েকজনের জীবন ফিরে দেখা হোক।

মনসা মুসা
এলন মাস্ক থেকে মুকেশ অম্বানি। এযুগের তো বটেই এখনও পর্যন্ত বিশ্বের সর্বাধিক সম্পদের মালিক ছিলেন মনসা মুসা (Mansa Musa)। ১২৮০ থেকে ১৩৩৭ খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত মালির রাজা ছিলেন এই ব্যক্তি। তৎকালীন সময়ে দাঁড়িয়ে প্রায় ৪০০ বিলিয়ন ডলারের মালিক ছিলেন তিনি! বিভিন্ন গবেষণায় জানা যায়, কৃষ্ণাঙ্গ মুসার সম্পদের পরিমাণ এতটাই ছিল যে, সমগ্র এলাকা, যেখানে তিনি থাকতেন সবটাই দুর্মূল্য রত্ন দিয়ে সুসজ্জিত থাকত। উপজাতিদের রীতি মেনেই মুসার পরনে যেটুকু থাকত, সবটাই ছিল সোনার। আরও জানা যায়, এই মুসার মক্কা ভ্রমণ ছিল দেখার মতো। তিনি নাকি ৬,৫০০ কিলোমিটার পথ পাড়ি দেন প্রায় ১,২০০ দাস এবং ৬০ হাজার সঙ্গী নিয়ে। জনতার প্রত্যেকেই তাঁর প্রজা। সেই সময়ে সর্বাধিক ধনী রাজা ছিলেন মুসা। পরবর্তীকালে তাঁর রাজত্ব লুট করা হয়। হেরে যান মুসা। এই কৃষ্ণাঙ্গ রাজার কীর্তি এখনও নজির স্থাপন করে বিশ্বের ইতিহাসে।

মেডিসি
ফ্লোরেন্সের কালো রাজা মেডিসি। আলেসান্দ্রো ডি মেডিসি। বর্ণবৈষম্য এবং দাসপ্রথার যুগে এই রাজাও রেকর্ড গড়েন। কালো-সাদার বিভেদের মধ্যেই পাশ্চাত্য দুনিয়ায় নজির স্থাপন করেন তিনি। ফ্লোরেন্সের ডিউক হিসেবে ছিলেন মাত্র ৬ বছর। ১৫৩২ থেকে ১৫৩৭, তাঁর মৃত্যু পর্যন্ত ওই পদে ছিলেন তিনি। প্রথম কৃষ্ণাঙ্গ ডিউক হিসেবে উঠে আসেন এই ব্যক্তি। মেডিসির অবদান, দাসপ্রথার বিনাশে একের পর এক সিদ্ধান্ত নজর কাড়ে বিশ্বের। তিনিও হয়ে ওঠেন এক যুদ্ধের প্রতীক।

ভিনসেন্ট গুয়েরেরও
অষ্টাদশ শতাব্দীর শেষ প্রান্তে বিভেদের বিশ্বে তাক লাগিয়েছিলেন ভিনসেন্ট (Vincent Guerrero) । সমস্ত বিভেদকে উড়িয়ে মেক্সিকোর প্রথম কালো রাষ্ট্রপতি হিসেবে কাজ শুরু করেছিলেন তিনি। ১৮১০ সাল নাগাদ মেক্সিকান সেনাবাহিনীর প্রধান ভিনসেন্ট দায়িত্বভার নেন মেক্সিকোর। একের পর ক্ষেত্রে শুরু করেন সংস্কার। বিতর্ক এবং একনায়কতন্ত্রের অভিযোগ উড়িয়ে দিয়ে, তিনিই হয়ে উঠেছিলেন দেশের সর্নেসর্বা। তথাকথিত ফরসা-রাজত্বে এই ভিনসেন্ট ছিলেন সেরা।

ফ্রেডরিক ডগলাস
তিনি রাষ্ট্রপতি হতে পারেননি ঠিকই। কিন্তু আমেরিকায় প্রথম কৃষ্ণাঙ্গ রাষ্ট্রপতি পদপ্রার্থী হিসেবে মনোনীত হয়েছিলেন রিপাবলিক দলের হয়ে। পাশ্চাত্যের দাসপ্রথার বিনাশে বিরাট ভূমিকা ছিল এই মানুষটির। এক নজির স্থাপন করেছিলেন ফ্রেডরিক ডগলাস (Fredrick Douglas)

নেলসন ম্যান্ডেলা
১৯৯৪-'৯৯। বিশ শতকের বিশ্বইতিহাস বদলে দিলেন ম্যান্ডেলা! জগতের আলো হয়ে আফ্রিকার আকাশে উঠল নতুন চাঁদ। যে আন্দোলন শুরু হয়েছিল ৯০ এর দশকের আগে থেকেই, তা পরিপূর্ণ হল কয়েক বছর পরে এসে। একাধিক অত্যাচার, বৈষম্যের বিরুদ্ধে সোচ্চার হয়ে বিশ্বের হৃদয় জিতলেন ম্যান্ডেলা (Nelson Mandela) । ১৯৯১ থেকে আফ্রিকান জাতীয় কংগ্রেসের প্রধান দেখিয়ে দিলেন শাসন কাকে বলে! খর্ব করলেন বর্ণবিদ্বেষ। যে অত্যাচার একদা রাস্তায় নামিয়েছিল ম্যান্ডেলাকে। যা বারবার শ্বেতাঙ্গ মানুষের কাছে আনন্দের হয়ে উঠেছিল, সেই বিভেদ-বিচ্ছেদ আর অমানুষিক অত্যাচারের বিরুদ্ধে গর্জে উঠেছিলেন এই 'কালো ছেলে'ই। হয়ে উঠেছিলেন এক বৃহত্তর দেশের, গণতান্ত্রিক প্রধান।

বারাক ওবামা
ইতিহাস থেমে গিয়েছিল ম্যান্ডেলার বিদায়ের পর। আর বিশ্ব দেখেনি কৃষাঙ্গ কোনও শাসককে। যিনি ছড়ি ঘোরাবেন আইন আর শাসনের উপরে ভিত্তি করে। ২০০৮ সাল। জল্পনা আর একাধিক কথকতা সত্যি করে উঠে এলেন বারাক হুসেইন ওবামা। মার্কিন মুলুকের রাষ্ট্রপতি নির্বাচনে, ২০০৯ সালে বিশ্বের অন্যতম প্রধান শক্তির প্রধান নির্বাচিত হলেন বারাক ওবামা (Barack Obama) । কৃষ্ণাঙ্গ প্রেসিডেন্ট পেল আমেরিকা (United States Of America) । ফের ইতিহাস গড়লেন কৃষ্ণাঙ্গরা।

কমলা হ্যারিস
ওবামার পর কমলা হ্যারিস (Kamala Harris) । ভারতীয় বংশোদ্ভূত মার্কিন মহিলার কৃষ্ণাঙ্গ দিক কাটিয়ে উঠে এল এক নজিরবিহীন ইতিহাস। ফের হোয়াইট হাউসের অন্যতম সদস্য হলেন কমলা। আমেরিকার উপরাষ্ট্রপতির পদে বসলেন তিনি।

দ্রৌপদী মুর্মু
বিশ্বের তাবড় তাবড় গণতন্ত্রের অন্যতম স্তম্ভ ভারত গড়ল নয়া ইতিহাস। মোদি-রাজত্বের সমস্ত কৌশল, নির্বাচনী রাজনীতি মাথায় রেখেও বলা যায়, ১৩০ কোটির দেশে সাংবিধানিক প্রধান নির্বাচিত হলেন দ্রৌপদী মুর্মু এটি অত‍্যন্ত উল্লেখযোগ্য। আদিবাসী পরিবারের সন্তান এই কৃষ্ণকলির মাথায় উঠল এই সম্মান। পূর্ববর্তী রাষ্ট্রপতি রামনাথ কোবিন্দ-দলিত শ্রেণির তকমা ছাড়িয়ে উড়িষ্যার দ্রৌপদী রচনা করলেন নয়া ইতিহাস।

উচ্চশিক্ষিত। বহুকাল রাজনীতির সঙ্গে জড়িত। একাধিকবার জনপ্রতিনিধি হিসেবে কাজ করেছেন। হয়েছেন ঝাড়খণ্ডের রাজ্যপাল। প্রশাসনিক-রাজনৈতিক-শিক্ষাগত-সামাজিক; সমস্ত ক্ষেত্রেই সমান পারদর্শী এই দ্রৌপদীকে নির্বাচনের মূল উদ্দেশ্য রাজনীতি - তা নিয়েও বিতর্কের সূত্রপাত হলেও ভারতে প্রথম আদিবাসী পরিবারের কেউ সর্বোচ্চ পদে বসছেন, এই ঘটনা শোরগোল ফেলে। বিশ্বের দরবারে ভারত পরিচিত হয়, দেশের সাংবিধানিক পদের মালিক হতে পারেন দলিত জনের কেউ! এই সাহসী পরিচয়েও। দ্রৌপদী নিজস্ব লড়াইয়ে সেখানেই হয়ে ওঠেন মৌলিক, অনন্য, অনবদ্য।

মুসার সময়-সংকট থেকে একালের দ্রৌপদী। বারবার বর্ণের অপরাধে মৌখিক অত্যাচারীর কবলে পড়তে হয়েছে তাঁদের। ঘোর বর্ণের মেয়ে বা ছেলের বিরুদ্ধে সোচ্চার হতে গিয়ে উঠে এসেছে রূপের বর্ণনা। যেখানে রূপ নয়, গুণের ভারসাম্য ফুৎকারে উড়িয়ে কেউ কেউ সভ্যতার সমস্ত ক্ষেত্রত্যাগে হয়ে উঠেছেন আক্রমণের পূজারী। সযুগের ব্রিটিশ থেকে এযুগের অখিল গিরি-শুভেন্দু অধিকারী। একাধিক মুখে দ্রৌপদী অথবা বিরবাহা-চয়নে উঠে এসেছে সেই বর্ণ বৈষম্যের প্রসঙ্গ। যেখানে জাতিগত বৈষম্য এবং গায়ের রঙ নিয়ে বিরূপ মন্তব্যের শিকার হতে বাকি থাকেননি এই সময়ের অনেকেই। যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের এক মহিলা অঅধ্যাপক জাতের দায়ে অভিযুক্ত হন। যিনি অভিযোগ করেছিলেন, অনলাইন ক্লাসে তাঁকে জাতিগত গঞ্জনার শিকার হতে হয়েছে। রোহিত ভেমুলার আত্মহত্যায় উঠে এসেছিল এই একই প্রশ্ন। আবার এক দলিত-ছোঁয়ায় জল অশুদ্ধ হয়েছে, এই দাবিতে প্রধান শিক্ষকের নির্মম অত্যাচারের শিকার হয়েছিল এক পড়ুয়া। জাতের বিড়ম্বনায় কুয়োর জল থেকে অনুষ্ঠানে অংশগ্রহণ। একাধিক ক্ষেত্রেই উঠেছে প্রশ্ন। আবার সংরক্ষণ আর চাকরির দাবানলে সংরক্ষণ তুলতে সরব হয়েছে একটা বিরাট অংশ। প্রশ্ন উঠেছে, সকলের প্রয়োজন না হলেও এর প্রভাবে নিমেষেই বঞ্চিত হচ্ছে মেধা! কিন্তু এতদসত্ত্বেও আজও বঞ্চনার আর গঞ্জনা দাবানলে ছড়িয়ে পড়ে মুসা মেডিসির নাম। উঠে আসে ম্যান্ডেলা থেকে ওবামাও। যাঁরা বারবার প্রমাণ করেন, জাত বা গায়ের রং নয়, বড় আসলে মানব সত্তা।

More Articles