নিশ্চিহ্ন হওয়ার মুখে নিকোবরের আদিম অধিবাসীরা, কেন প্রমাদ গুনছেন গবেষকরা
Great Nicobar Project: প্রায় ৭২ হাজার কোটি টাকা খরচ হবে এই প্রকল্পে। অথচ তার জেরেই ঘনিয়ে আসছে বড়ো বিপদ...
আন্দামান নিকোবর দ্বীপপুঞ্জের আদিবাসীদের কাছে পৌঁছে গিয়েছিলেন কাকাবাবু। ‘উন্নত মানব সভ্যতা’ যেভাবে ওখানকার আদিবাসীদের ব্যতিব্যস্ত করছে, সবুজ ধ্বংস করছে, সেইসব কাহিনি উঠে এসেছিল বইয়ের পাতায়। কিন্তু ‘সবুজ দ্বীপের রাজা’র রাজত্বের এখনকার ছবিটা কি খুব বদলেছে? সাম্প্রতিক গবেষণা বলছে, না। এতটুকুও কমেনি। বরং বেড়ে চলেছে দ্রুতগতিতে।
সম্প্রতি পরিবেশ গবেষকরা একটি বিশেষ দিকে আমাদের দৃষ্টি আকর্ষণ করেছেন। তাঁদের লক্ষ্য গ্রেট নিকোবর দ্বীপ। আন্দামান ও নিকোবর দ্বীপপুঞ্জের দক্ষিণতম অংশ হল এটি। আর এখানেই শুরু হয়েছে ‘মহাযজ্ঞ’। গ্রেট নিকোবর দ্বীপকে ‘ঝাঁ চকচকে’ বানাতে একটি বিপুল পরিকল্পনা নেওয়া হয়েছে। আন্দামান ও নিকোবর দ্বীপপুঞ্জের উন্নয়ন কর্পোরেশনের (Andaman and Nicobar Islands Integrated Development Corporation) পক্ষ থেকে এই পুরো পরিকল্পনা নেওয়া হয়েছে। আর এই গোটা পরিকল্পনার সঙ্গে রয়েছে নীতি আয়োগ, কেন্দ্রীয় সরকারের ‘থিঙ্ক ট্যাঙ্ক’। সব মিলিয়ে এই প্রকল্পের পিছনে খরচ হবে প্রায় ৭২ হাজার কোটি টাকা!
ঠিক কী হবে এই প্রকল্পে? মূলত বেশ কয়েকটি জিনিসের দিকে নজর দেওয়া হয়েছে। প্রথমত, একটি আইসিটিটি অর্থাৎ ইন্টারন্যাশনাল কন্টেইনার ট্রান্সশিপমেন্ট টার্মিনাল তৈরি করা হবে। যা আদতে একটি করিডোর, ১৪.২ মিলিয়ন টিইইউ কার্গো ক্যাপাসিটির মাল বহন করতে সক্ষম হবে। এছাড়াও একটি আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর তৈরি করা হবে। পাশাপাশি বিশাল একটি গ্যাস ও সোলার পাওয়ার প্ল্যান্ট তৈরি করা হবে। সেইসঙ্গে একটি নগর বসতি অর্থাৎ টাউনশিপও তৈরি করা হবে। সব মিলিয়ে এলাহি এক আয়োজন। গ্রেট নিকোবর দ্বীপপুঞ্জের চেহারা যে আমূল বদলে যাবে, তা এককথায় স্বীকার করছেন সকলে।
আরও পড়ুন : আন্দামানের ‘রাক্ষস’-দ্বীপের কাছে গেলেই মৃত্যু! কীভাবে বেঁচে ফিরেছিলেন এক বাঙালি মহিলা?
ঠিক এই পয়েন্টেই প্রশ্ন তুলেছেন অশোকা ট্রাস্ট ফর রিসার্চের গবেষক শরদ লেলের মতো অন্যান্য পরিবেশ গবেষকরা। আজও আন্দামান এবং নিকোবর দ্বীপপুঞ্জের অনেক জায়গায় আদিবাসী সম্প্রদায়ের মানুষের বাস। কেবল জারোয়া নয়, শম্পেন ও নিকোবরিজের মতো আদিবাসীরাও এখানে থাকেন। গ্রেট নিকোবরে মূলত শেষ দু’টি আদিবাসী গোষ্ঠীর বাস। সেইসঙ্গে রয়েছে ঘন জঙ্গল, রয়েছে বন্যপ্রাণী। এই মুহূর্তে গ্রেট নিকোবর দ্বীপের জনসংখ্যা ৮০০০। তার মধ্যে প্রায় ১০০০ জন নিকোবরিজ এবং শম্পেনদের সংখ্যা ২০০-র সামান্য বেশি। দীর্ঘদিন ধরে বসবাস করতে করতে একটা বাস্তুতন্ত্র তৈরি হয়ে গিয়েছে সেখানে। প্রকৃতিকে সঙ্গে নিয়েই তাঁরা নিজেদের জীবনধারণ করছেন। এমন পরিস্থিতিতে এই বিপুল উন্নয়ন যজ্ঞে তাঁদের কতটা উপকার হবে? তাঁদের বসবাসের কী হবে? সবচেয়ে বড়ো কথা, দূষণের পৃথিবীতে দাঁড়িয়ে পরিবেশকে কত পিছনের দিকে ঠেলা হবে? প্রশ্ন তুলছেন গবেষকরা।
পাল্টা প্রশ্ন আসতে পারে, বহু বছর ধরে ওই আদিবাসীরা ‘সভ্যতার’ আলো থেকে বঞ্চিত। বর্তমান পৃথিবীর স্বাভাবিক উন্নয়ন বলতে যা বোঝায়, সেসব তাঁরা পান না। পেলেও, সবসময় সেই সুবিধা ভোগ করতে পারেন না। তাঁদেরও তো সুস্থ জীবনযাপন দিতে হবে। কথাটি সত্য। কিন্তু উন্নয়ন বলতে আমরা কী বুঝি? প্রকৃতিকে ধ্বংস করে, বাসস্থান ধ্বংস করে তাঁদের সম্পূর্ণ অচেনা একটা পৃথিবীতে নিয়ে গিয়ে ফেলা? শম্পেন আদিবাসী গোষ্ঠী এখনও আদিম সভ্যতার মাটিতে পড়ে আছে। সাক্ষরতার হার খুব কম, প্রযুক্তির ব্যবহারও এই মানুষেরা জানেন না। শুধু জঙ্গল আর চাষবাসের মধ্যে দিয়েই বেঁচে আছেন তাঁরা। হঠাৎ অন্য একটা পৃথিবীর মধ্যে পড়লে হারিয়ে যাবেন তাঁরা। এমনটাই বলছেন গবেষকরা। শেষ হয়ে যাবে নিকোবরের আদিম জনগোষ্ঠী।
এখানেই চলে আসবে আরেকটা প্রসঙ্গ। গ্রেট নিকোবরের অন্তত ৮৫৩ বর্গ কিলোমিটার এলাকা আদিবাসীদের জন্য সংরক্ষিত। Andaman and Nicobar Protection of Aboriginal Tribes Regulation, 1956 অনুযায়ী, এই মাটি এখানকার আদিবাসীদের জন্য সুরক্ষিত। যদি কেউ ব্যবহার করতে চায়, তাহলে কেন্দ্রীয় সরকারের থেকে বিশেষ সম্মতি আদায় করতে হবে। তাহলে এই প্রকল্পের মহাযজ্ঞ ওখানে কী করে হচ্ছে? চলতি বছরের ২৭ অক্টোবর, কেন্দ্রের বন সংরক্ষণ মন্ত্রকের তরফ থেকে একটি চিঠি দেওয়া হয়েছে আন্দামান ও নিকোবর দ্বীপপুঞ্জের উন্নয়ন সংস্থাকে। সেখানে এই মেগা প্রকল্পকে সবরকমভাবেই ‘ক্লিয়ারেন্স’ দেওয়া হয়েছে। বলা হয়েছে, খুব গুরুত্ব দিয়ে, পর্যবেক্ষণ করে এই ক্লিয়ারেন্স দেওয়া হল। পরিবেশ মন্ত্রকও সবুজ সংকেত দিয়ে দিয়েছে। ফলে তরতরিয়ে এগোচ্ছে উন্নয়ন যজ্ঞ।
সত্যিই কি ভাবনার কিছু নেই? পরিবেশ মন্ত্রকের এক্সপার্ট অ্যাপ্রেইজাল কমিটির (EAC) রিপোর্ট বলছে, অন্তত ৮.৫ লক্ষ গাছ কাটা যাবে এই প্রকল্পের ঘায়ে। অন্তত ১২ থেকে ২০ হেক্টর ম্যানগ্রোভ অরণ্য সম্পূর্ণ ধ্বংস হবে। এছাড়াও গ্রেট নিকোবর দ্বীপ তার বাস্তুতন্ত্রের বৈচিত্র্যের জন্য বিখ্যাত। ইউনেস্কোর বিশ্ব হেরিটেজের তকমাও পেয়েছে। সেই বাস্তুতন্ত্র কি অটুট থাকবে এই প্রকল্পের জন্য? মাথা নাড়ছেন গবেষকরা। শুধু তাই নয়, ওই এলাকা লেদারব্যাক কচ্ছপের বাসা। টাউনশিপ বা অন্যান্য প্রকল্প হলে সেই বাসা একেবারে নষ্ট হয়ে যাবে।
আরও পড়ুন : ভারতের মোক্ষম চালে আন্দামানের দখল পায়নি পাকিস্তান! চমকে দেবে সেই ইতিহাস
ইতিমধ্যেই ওই জায়গার উপকূলবর্তী জায়গা, গ্রেট নিকোবর বায়োস্ফিয়ার রিজার্ভ ও গ্যালাথিয়া বে’র বেশ অনেকটা অংশই সংরক্ষণের তালিকা থেকে বাদ দেওয়া হয়েছে। অর্থাৎ, ওই জায়গায় কেউ বসতি স্থাপন করতে চাইলে, কারখানা, জাহাজবন্দর করতে চাইলে আর কেন্দ্রের অনুমতি নেওয়ার প্রয়োজন নেই। পাশাপাশি এই প্রকল্প সম্পূর্ণ হলে এই অঞ্চলে জনসংখ্যা বাড়বে। মনে করা হচ্ছে, আগামী ৩০ বছরের মধ্যে এখানকার জনসংখ্যা সাড়ে তিন লাখ হয়ে যাবে। বেশি জনসংখ্যা মানে, নগরের সম্প্রসারণ। ফলে, আরও গাছ কাটা, আদিবাসী উচ্ছেদ, ধ্বংসলীলা।
খুব বেশি পুরনো দিনের কথা নয়। ব্রাজিলের অ্যামাজন অববাহিকার জঙ্গল ধ্বংসের জন্য সেই দেশের প্রশাসন তীব্র বিক্ষোভের মুখে পড়েছিল। মাইলের পর মাইল জায়গা স্রেফ ধ্বংস করে দেওয়া হয়েছিল, আদিবাসীদের সরিয়ে দেওয়া হয়েছিল। প্রতিবাদ করতে গিয়ে কয়েকজন মারাও যান। উদ্দেশ্য ছিল, জঙ্গল সাফ করে শিল্প স্থাপন করা। গ্রেট নিকোবর দ্বীপেও উদ্দেশ্যটা ঠিক একই। আদিবাসীরা সংকটে, বাড়তে থাকা জনসংখ্যা সামাল দেওয়ার জন্য এমন ‘নাগরিক উন্নয়ন’-এর দাপটে দিশেহারা বন্যপ্রাণ। যে আন্দামান ও নিকোবর দ্বীপপুঞ্জ তার বাস্তুতান্ত্রিক সম্পদের জন্য বিখ্যাত, গোটা বিশ্ব বারবার মুগ্ধ হয় যে দিকে তাকিয়ে, সেই উপত্যকাও বিপদের সম্মুখীন। বিশেষজ্ঞদের আশঙ্কা, এভাবে চলতে থাকবে নিকোবরের বাস্তুতন্ত্রের কথা, সেখানকার মানুষ ও প্রাণীদের কথা স্রেফ ইতিহাসের পাতাতেই পড়তে হবে।