দুই হাত মাথার উপরে তুলে রাখতেন সব সময়! ব্রিটিশদের 'গুপ্তচর' ছিলেন এই সন্ন্যাসী?

Pran Puri The Spy Monk: কোম্পানি নেপালে কূটনৈতিক বার্তা পৌঁছে দেওয়ার জন্য প্রাণ পুরীকে ব্যবহার করেছিল।

দুই ফকিরের আখ্যান। সাল ১৭৯৭। এশিয়াটিক রিসার্চেসে এই নামেই এক প্রবন্ধ প্রকাশিত হলো। লেখক বম্বের গভর্নর জোনাথন ডানকান। ১৭৮৭ সাল থেকে ১৭৯৫ সাল পর্যন্ত বেনারসে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির রেসিডেন্ট বা কূটনৈতিক প্রতিনিধির দায়িত্বে ছিলেন এই ডানকান। ১৭৮৪ সালে ডানকান এশিয়াটিক সোসাইটি প্রতিষ্ঠা করতে সাহায্য করেছিলেন এবং ১৭৯১ সালে বারাণসী সংস্কৃত কলেজ স্থাপনেও গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা ছিল তাঁর। ওই প্রবন্ধটিতে বারাণসীর একজন সাধুর জীবনের কথা লিখে গেছেন ডানকান। প্রাণ পুরী, এই নামেই সাধুকে ডাকতেন মানুষজন। তবে ডানকানেরও আগে কোম্পানির প্রাক্তন আধিকারিক ফ্রান্সিস উইলফোর্ডের কাছ থেকে প্রাণ পুরীর কথা শোনা যায়। ফ্রান্সিস বারাণসীতেই নিজের অবসর জীবন কাটাতেন। তিনি বলেছিলেন, যোগী প্রাণ পুরী এমন একজন তপস্বী ছিলেন, যিনি উর্ধ্ববাহু! অর্থাৎ সবসময় এই সাধু নিজের হাত উপরে তুলে রাখতেন।

ডানকান প্রাণ পুরীর জীবনের অনেকটা অংশই তুলে ধরেছিলেন লেখায়। ১৭৪২ সাল নাগাদ জন্ম হয় প্রাণ পুরীর। নয় বছর বয়সে কনৌজে নিজের পৈতৃক বাড়ি থেকে পালিয়ে বিথুরে যান তিনি। সেখানে তাঁকে একজন স্বামীজি দত্তক নেন। এই স্বামীজির কাছে থাকতে থাকতেই সন্ন্যাসী হওয়ার সিদ্ধান্ত নেন প্রাণ। ১৭৫৩ সালে প্রয়াগের কুম্ভ মেলায় যান তিনি। সেখানে বিভিন্ন ধরনের তপস্যা দেখে তিনি আজীবন উর্ধ্ববাহু হওয়ার সিদ্ধান্ত নেন। তারপরের প্রায় তিন বছর যন্ত্রণাদায়ক প্রক্রিয়ায় নিজেকে অভ্যস্ত করাতে থাকেন। বাহু এবং হাত মাথার উপরে একটি নির্দিষ্ট অবস্থানে রাখার অভ্যাস করে যেতে থাকেন তিনি।

ডানকান

উর্ধ্ববাহু হয়েই প্রাণ পুরী ভারতীয় উপমহাদেশের পাশাপাশি পশ্চিম ও মধ্য এশিয়ার অনেক জায়গায় ভ্রমণও করেন। বেনারস থেকে মালয়, কোচিন থেকে বেলুচিস্তান, বাহরাইন থেকে সমরখন্দ, মস্কো থেকে তিব্বত- সাধু প্রাণ পুরী সমস্ত স্থানে ছুটে গিয়েছেন। আফগানিস্তানে আহমেদ শাহ আবদালি এবং পারস্যে করিম খানের সঙ্গে সাক্ষাৎ করেন। জগন্নাথ ধাম থেকে শুরু করে রামেশ্বরম, শ্রীপদ থেকে হিংলাজ পর্যন্ত বিস্তৃত হিন্দু মন্দিরগুলিতে তীর্থযাত্রা করেন। বামিয়ানের বুদ্ধ পরিদর্শন করেন, এমনকী লাসায় দলাই লামা এবং কলকাতায় ওয়ারেন হেস্টিংসের মধ্যে দূত হিসেবেও কাজ করেন প্রাণ পুরী। আর এই সবটাই করেছেন দু' হাত মাথার উপরে তুলে!

আরও পড়ুন- সিনেমাই কি সত্যি! RAW- এর অন্দরে গুপ্তচরদের জীবন আসলে কেমন?

তবে ডানকানের এই প্রবন্ধে বিবিধ ত্রুটি উঠে আসে পরবর্তী সময়ে। প্রাণ পুরীর জীবন সম্পর্কে কিছু গুরুত্বপূর্ণ তথ্য এইখানে উল্লিখিত হয়নি। প্রাণ পুরী ভয়াবহ দুর্ভিক্ষের সময় বাড়ি থেকে পালিয়ে গিয়েছিলেন। এমন এক যুগে ঘটনাটি ঘটে যখন বাবা মায়েরা সন্তানদের বিক্রি করে দিতেন এই আশায় যে, কিনে নেওয়ার পরে মালিকরা বাচ্চাকে খাইয়ে পরিয়ে বাঁচিয়ে রাখবে। প্রাণ পুরীর সন্ন্যাসী হওয়ার সিদ্ধান্তের পিছনে এই ঘটনাটি অস্বীকার করা যায় না। আরও একটি বিষয় হলো, ডানকান বা উইলফোর্ড যেমন প্রাণ পুরীকে কখনও যোগী কখনও ফকির বলেছেন, তেমন কিন্তু নয়। প্রাণ পুরী ফকির বা সাধু ছিলেন না। ছিলেন সন্ন্যাসী। এই ধরনের সন্ন্যাসীরা প্রায়ই পার্থিব সাধনায় নিযুক্ত থাকেন যার মধ্যেই থাকে বাণিজ্য, ব্যাঙ্কিং এবং সামরিক পরিষেবা।

প্রাণ পুরী

ডানকান খুব ভালো করেই জানতেন যে প্রাণ পুরী একজন সন্ন্যাসী। তা সত্ত্বেও তিনি তাঁকে ফকির হিসেবেই বর্ণনা করেছেন, সম্ভবত ফারাক বোঝার মতো জ্ঞানের অভাব ছিল ডানকানের। ডানকান জনসাধারণকে জানাতে চাননি, কোম্পানি নেপালে কূটনৈতিক বার্তা পৌঁছে দেওয়ার জন্য প্রাণ পুরীকে ব্যবহার করেছিল। নেপালে প্রাণ পুরীকে পাঠিয়ে আসলে কোম্পানি ১৭৯২ সালের মার্চ মাসে হিমালয়ের এই অংশের সঙ্গে একটি বাণিজ্যিক চুক্তি করে নেয়। এশিয়াটিক সোসাইটি এবং ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি তিব্বতের সঙ্গেও বাণিজ্য ও যোগাযোগের মাধ্যম হিসেবে ব্যবহার করে প্রাণ পুরীকে। তিব্বতিরা ব্রিটিশদের ভরসা না করলেও হিন্দু তীর্থযাত্রীদের এবং বিশেষ করে সন্ন্যাসীদের তো ভরসা করতই। 'বাণিজ্যিক তীর্থযাত্রী' হয়েই কাজ করেছিলেন প্রাণ পুরী। যেহেতু সন্ন্যাসীদের চরিত্রগুলি ভবঘুরে এবং তুলনামূলকভাবে নির্ভীক এবং তাঁদের অনেকেই নেটিভ স্টেটের রাজনৈতিক ও বাণিজ্যিক জীবনের সঙ্গে ঘনিষ্ঠভাবে জড়িত ছিলেন তাই ঔপনিবেশিক প্রশাসকরা নিজেদের প্রয়োজনে তাঁদের ব্যবহার করে। প্রাণ পুরীকেও ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি নিজেদের স্বার্থসিদ্ধির উদ্দেশ্যেই ব্যবহার করে। প্রাণ পুরী ১৮০০ সালে মারা যান। ব্রিটিশদের লেখা বাদে, তাঁর নিজস্ব কথা কোথাওই কাউকে লিখিত বলে যাননি তিনি।

 

সূত্র- https://scroll.in/

More Articles