'বেটি বাঁচাও' আজ মুখে মুখে! নেপথ্যে কন্যাসন্তানদের আসল 'ঈশ্বর' পুনের এই চিকিৎসক

Beti Bachao Janandolan: প্রাক্তন প্রধানমন্ত্রী মনমোহন সিং এই কন্যাভ্রূণ হত্যা এবং শিশুহত্যার সংস্কৃতিকে জাতীয় লজ্জা বলে বর্ণনা করেছিলেন। মেয়েদের বাঁচাতে এক ‘জিহাদের’ ডাকও দিয়েছিলেন।

২১ শতকে নারী মুক্তি নিয়ে নানা তর্জন গর্জনই শোনা গেছে। গর্জনই বটে কারণ, গত কয়েক দশকে বিভিন্ন ঘটনা পরম্পরা ও পরিসংখ্যানে চোখ বুলোলে শিউরে উঠতে হয়। ভ্রূণ অবস্থায় কন্যার হত্যা, মেয়ে সন্তানের কপাল লিখন- এই দেশের বুকে এখনও গাঢ় অন্ধকারে ঢাকা। অকালে বিয়ের পিঁড়িতে বসা, পুত্র সন্তান জন্ম দেওয়ার জন্য চাপের মতো সামাজিক ব্যাধির কোনও দাওয়াই এখনও নেই। রোগের কারণ অশিক্ষা। আর এক্ষেত্রে আলোচনাই সার। পরিসংখ্যান বলছে, ভারতে বছরে ৪৬ লক্ষ কন্যাভ্রূণ হত্যা হয়! গত ৫০ বছরে নিখোঁজ সাড়ে ৪ কোটি মেয়ে। খুব বেশিদিন আগের ঘটনা নয়। ২০২০ সাল। গর্ভের সন্তান ছেলে না কি মেয়ে, তা দেখার জন্য অন্তঃসত্ত্বা স্ত্রীর পেট কেটে ফেলেন উত্তর প্রদেশের বাদাউন জেলার এক ব্যক্তি!

কন্যাভ্রূণ হত্যা দেশে ভয়ঙ্কর চেহারা নিলে প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি ২০১৫ সালের ২২ জানুয়ারি তারিখে ‘বেটি বাঁচাও, বেটি পড়াও’ প্রকল্পটি শুরু করেন। ২০১৬ সালের ২৬ অগাস্ট, সেবছরের অলিম্পিকের ব্রোঞ্জ মেডেল বিজেতা সাক্ষী মালিককে এর প্রতিনিধি হিসাবে ঘোষণা করা হয়। এরপরেও সমাজে মেয়েদের অবস্থা সেই একই তিমিরে। তবে এরই মধ্যে এক ব্যতিক্রমী নাম চিকিৎসক গণেশ রাখ।

কন্যা সন্তান হওয়ায় নেন না কোনও পারিশ্রমিক। চিকিৎসকের নাম ডাঃ গণেশ রাখ। পুনেতে নিজেই একটি প্রসূতি-কাম-মাল্টিস্পেশালিটি হাসপাতাল চালান। গড়ে তুলেছেন ‘বেটি বাঁচাও জন আন্দোলন’। আর এই খবর রাতারাতি ভাইরাল নেটদুনিয়ায়। কেন?

আরও পড়ুন- ৩৩ বছর ধরে প্রতিদিন ৪০০ মানুষকে বিনামূল্যে চিকিৎসা, ১০০০ জনকে খাবার! ‘ভগবান’কে চিনুন!

যখনই তাঁর হাসপাতালে কোনও শিশুকন্যার জন্ম হয়, তিনি কোনও ফি নেন না। গত ১১ বছরে বিনা পারিশ্রমিকে তিনি ২ হাজার ৪০০ নবজাতক কন্যার জন্ম দিয়েছেন। এর মাধ্যমেই ভ্রূণ হত্যা সম্পর্কে মানুষকে সচেতন করার কাজও করে চলেছেন ডঃ গণেশ। তাঁর দাবি, গত ১১ বছর ধরে এই কাজের বিনিময়ে তিনি গর্ভবতী মহিলার স্বামী, পরিবার বা আত্মীয়ের কাছ থেকে একটি পয়সাও নেননি।

সংবাদ সংস্থাকে তিনি জানিয়েছেন, ২০১২ সাল থেকে তিনি কন্যা সন্তান জন্মের ক্ষেত্রে তাঁদের বাড়ির লোকের থেকে একটি টাকাও নেন না। আজও সমাজে মেয়েদের সর্বত্রই হেনস্থার শিকার হতে হয়। আজও ভ্রূণ হত্যায় লাগাম পড়েনি। এই সম্পর্কে সচেতনতা বাড়ানোর জন্যই তিনি কন্যাসন্তান প্রসবের ক্ষেত্রে একটি টাকাও নেন না।

কন্যাসন্তানের জন্ম হলে তা উদযাপন করা হয় কেক কেটে। মিষ্টি বিতরণ করা হয় হাসপাতালের তরফে, হাসপাতালে ওড়ানো হয় রংবেরঙের বেলুন। আর এই সবের মূলে রয়েছে একটাই উদ্দেশ্য, সাধারণ মানুষকে সচেতন করা, জানান এই চিকিৎসক। তাঁর কথায়, “ছেলে হলে মিষ্টি কেনার বহর লেগে যায়। এমন অনেককে দেখেছি, যাঁরা মেয়ে হলে মুখ দেখতে পর্যন্ত আসেন না বরং লজ্জায় পড়ে যান। এই কারণেই আমি সচেতনতার প্রচার চালাই। বিনামূল্যে কন্যা সন্তানের প্রসব করাই।” ডঃ গণেশ রাখ আরও বলেন, “১১ বছর আগে বেটি বাঁচাও আন্দোলন শুরু করি। তারই অংশ হিসেবে হাসপাতাল কন্যাসন্তান প্রসব করাই সম্পূর্ণ বিনামূল্যে। কন্যার জন্ম উদযাপন করা হয়।” এখানেই শেষ নয়, হাসপাতাল থেকে মা ও সন্তানের বাড়ি ফেরার ব্যবস্থাও করা হয় মাল্টিস্পেশালিটি হাসপাতালের তরফে। ডঃ গণেশ রাখ জানান, এই কাজে বহু মানুষ ও সংস্থা তাঁর হাসপাতালকে সাহায্য করেন, ফলে সবটা নির্বিঘ্নেই হয়।

এই চিকিৎসক যে আলোকবর্তিকা দেখালেন, তার দিকে নজর রেখেই দেখা যাক কোথায় দাঁড়িয়ে এই দেশের মেয়েরা?

আরও পড়ুন- পিছিয়ে পড়া ‘জেনারেল’দের সংরক্ষণ! এই কোটায় কারা, কী কী সুবিধে পাবেন?

রাষ্ট্রসংঘের জনসংখ্যা তহবিল বা ইউএনএফপিএর ২০২০-এর জুন মাসে প্রকাশিত এক রিপোর্টে বলা হয়েছে, গত ৫০ বছরে ভারতে প্রায় ৪ কোটি ৬০ লাখ মেয়ে ‘নিখোঁজ’ হয়ে গেছে। প্রতি বছর এই দেশে গর্ভপাত ঘটিয়ে ৪৬ লাখ কন্যা ভ্রূণ নষ্ট করে ফেলা হয় এবং জন্মের পর কন্যা শিশুরা অবহেলার শিকার হয়। অকালে পড়াশুনো শিকেয় ওঠে। পরিবারের ইচ্ছায় অপরিণত বয়সে বসতে হয় বিয়ের পিঁড়িতে। এই দেশে জন্মের পর কন্যাশিশুর মৃত্যুর হারও খুবই বেশি।

ভারত সরকারের অর্থ মন্ত্রকের প্রকাশ করা এক রিপোর্টে দেখা যায়, বহু দম্পতি একটি ছেলে সন্তান না হওয়া পর্যন্ত বাচ্চা নিতেই থাকে। দিল্লিতে বিবিসির ভারতীয় নারী ও সমাজ বিষয়ক সম্পাদক গীতা পাণ্ডে জানিয়েছেন, ভারতীয় সমাজে পুত্র সন্তানের প্রতি পক্ষপাত দীর্ঘদিনের একটা সংস্কৃতি। আর নারীর অন্তঃসত্ত্বা অবস্থায় গর্ভের সন্তানের লিঙ্গ নির্ধারণের প্রযুক্তি সহজলভ্য হওয়ায় এবং ছেলে সন্তানের আকাঙ্ক্ষা সমাজে এত প্রবল হওয়ার কারণে ভারতে গত কয়েক বছরে নারী-পুরুষ সংখ্যার অনুপাতও ব্যাপকভাবে ওলট-পালট হয়ে গেছে। কয়েক কোটি কন্যাকে হত্যা করা হয়েছে, হত্যা করা হয়! গর্ভে থাকা অবস্থাতেই গর্ভপাত করে ভ্রূণ হত্যা করা হয়, নয়তো জন্মের পরই মেয়েদের ইচ্ছা করে অবহেলা করে মেরে ফেলা হয়। প্রাক্তন প্রধানমন্ত্রী মনমোহন সিং এই কন্যাভ্রূণ হত্যা এবং শিশুহত্যার সংস্কৃতিকে জাতীয় লজ্জা বলে বর্ণনা করেছিলেন। মেয়েদের বাঁচাতে এক ‘জিহাদের’ ডাকও দিয়েছিলেন।

পরবর্তীকালে নরেন্দ্র মোদিও ‘বেটি বাঁচাও, বেটি পড়াও’ প্রকল্পের ঘোষণা করেন। বেশ কিছু পদক্ষেপ করাও হয়। অশিক্ষাই হয়তো এই অবিচার, অযুক্তির পাহাড়ের জন্য দায়ী। আজকে এই দেশ উন্নয়নের ফানুস ওড়ায়। মহাকাশে ইসরো স্বাধীনতা দিবসেরর মাহেন্দ্রক্ষণে গর্বের পতাকা ওড়ায়। তারপরেও কত মা তাঁদের সন্তানকে মেরে ফেলার পর কান্না চাপা দেয় রাতের অন্ধকারে বালিশে মুখ লুকিয়ে! এদের সামনে এই চিকিৎসকের বিবেকবোধ কি সমাজের রোগ নিরাময়ে যথেষ্ট ওষুধ?

More Articles