Child Labour: না খাটলে ভাত জোটে না কত শিশুর? আপনাকে লজ্জায় ফেলবে যে তথ্য

Child Labour: একবিংশ শতকে দাঁড়িয়েও শিশুর অবাধ বিচরণে বাধা হয়ে দাঁড়াচ্ছে শিশুশ্রম। যে অস্ত্রে একের পর এক নিরীহ শৈশব শেষ হচ্ছে রোজ।

চায়ের দোকানে বাবু খাই-দাই-থাকি,
কাজ করি সারাদিন, নেই কোনও ফাঁকি!
মার খাই, গাল খাই ,কানে দিই তালা,
পেটে বড় ভুখ বাবু, পেটে বড় জ্বালা!
আগে দাও ভাত বাবু, পরে তুলো শ্রম
-কৃষ্ণা দাস

অমলকান্তিরা প্রত্যেক মুহূর্তে রোদ্দুর হতে চেয়েছিল। বন্দিত্বের মায়ায় দাঁড়িয়ে দইওয়ালার সঙ্গে প্রতিদিন গল্প করতে চেয়েছিল অমল। কিন্তু চাইলেই কী আর সব হয়! এই বিশ্ব, শিশুর বাসযোগ্য হলো কি হলো না, এই প্রশ্নের মধ্যেই তাই বিবর্তিত হয়, না-হওয়া এবং না-পাওয়ার দাবানল! যা প্রত্যেক মুহূর্তে দগ্ধ করে অমলকান্তি অথবা অমলদের শৈশবকে! আর সেখানেই লজ্জা দেয় শিশুর কথা! আসলে যে বয়সে পুষ্টিকর খাবার প্রয়োজন ওদের, ঠিক সেই সময়ই মাথায় অপুষ্টির বোঝা নিয়ে কাজ করে ওরাও। আর থমকে থাকে এই বিশ্বও।

আবার কেউ মোবাইল গেম আর বিলাসিতার বিলাসে কাটায় শৈশব। আর কেউ বিপদ আর দুঃখ-কাঁটায় ভর করে অতিবাহিত করে জীবন। শুধু ভারত নয়, দক্ষিণ এশিয়া, এমনকী, এই বিশ্বের প্রায় সমস্ত দেশেই শিশুদের অবাধ শৈশবে রয়েছে একাধিক বাধা। যেখানে মানসিক স্বাস্থ্য থেকে শুরু করে যৌন হয়রানি যেমন রয়েছে। ঠিক তেমনই এই একবিংশ শতকে দাঁড়িয়েও শিশুর অবাধ বিচরণে বাধা হয়ে দাঁড়াচ্ছে শিশুশ্রম। যে অস্ত্রে একের পর এক নিরীহ শৈশব শেষ হচ্ছে রোজ। কেন?

আরও পড়ুন: কত শিশু ঘুরছে ভারতের রাস্তায়? পৃথিবীর বৃহত্তম শিক্ষাব্যবস্থায় অবাক করবে যে তথ্য

চুরি করে নিয়ে যায় শৈশব...
রাষ্ট্রপুঞ্জের সঙ্গে সম্পর্কযুক্ত একটি সংস্থা, আন্তর্জাতিক শ্রমিক সংগঠন বা ইন্টারন্যাশনাল লেবার অর্গানাইজেশন (International Labour Organization) বা আইএলও বলছে, 'যা শিশুর বিকাশে বাধা সৃষ্টি করে। মানসিক বৃদ্ধিতে সাহায্য করে না। শারীরিকভাবে কষ্ট দেয়। শিশুর সার্বিক অবস্থানে সমস্যা সৃষ্টি করে, এমন কাজের মধ্যে জড়িত থাকলেই ১৮ বছরের কমবয়সিদের শিশুশ্রমিকের আওতায় আনা হবে।'

বিশ্বের শিশুশ্রমিক
ইউনিসেফের একটি তথ্য আশঙ্কা বাড়িয়েছে ফের। শিশুশ্রমের গতিবিধিতে ওই রিপোর্ট ফের প্রশ্নের মুখে ফেলেছে এই বিশ্বকে। যেখানে বলা হচ্ছে, ২০২০ সালে সমগ্র বিশ্বে শিশুশ্রমিকের সংখ্যা ছিল ১৬০ মিলিয়ন। যা করোনা-কালে বৃদ্ধি পেয়েছে আরও ৯ মিলিয়ন। অর্থাৎ ওই রিপোর্ট অনুযায়ী, বিশ্বজুড়ে প্রায় ১৭০ মিলিয়ন শিশুশ্রমিক রয়েছে। যা ভয়াবহ বলে আগেই মন্তব্য করেছিল ইউনিসেফ (UNICEF) । বলা হয়, বিশ্বের প্রতি ১০ জন শিশুর ১ জন শ্রমিক। প্রতি ১০০ জন শিশুশ্রমিকের মধ্যে গড়ে ৬৪ জন ছেলে এবং বাকি ৩৬ জন মেয়ে শিশু হলে অনুমান করা হয়।

ভারতের শিশুশ্রম
ভারতের জনগণনার ২০১১ সালের রিপোর্ট অনুযায়ী জানা গিয়েছিল, এই দেশে ওই সময় অনুযায়ী প্রায় ১০.১ মিলিয়ন শিশু শ্রমিক ছিল। যারা রীতিমত কাজ করে পেট চালায়। এর মধ্যে ৫.৬ মিলিয়ন ছেলে। আর ৪.৫ মিলিয়ন মেয়ে। অর্থাৎ এদেশেও গড়ে শিশু শ্রমিকের সংখ্যা প্রায় ১ কোটির বেশি। যদিও ২০১৯ সালের একটি রিপোর্টে বলা হচ্ছে, এদেশে শিশু শ্রমিকের সংখ্যা উত্তরোত্তর সাফল্য পেয়েছে। দেশ উন্নত হলেও দেশের শিশুদের অবস্থান কিছুক্ষেত্রে খারাপ হয়েছে, একথার সঙ্গেই নানা বিভিন্ন প্রকল্প নিয়েও হুগলিতে সরব হয়েছেন তিনি। আর সেখানে গড়ে প্রতিবছর শিশুশ্রমিকের সংখ্যা বেড়েছে লক্ষাধিক।

২০১১ সালে দেশে প্রায় ২৭০ মিলিয়ন শিশুর মধ্যে অন্তত ১৬ মিলিয়ন শ্রমিকের কাজ করত। দাবি করা হয়, বিশ্বের বহু দেশের মধ্যে এ দেশের মোট শিশুশ্রমিকের প্রায় ৬২ শতাংশ শিশু কৃষিকাজ, খামারের সঙ্গে যুক্ত। ২০১৯ সালের একটি প্রতিবেদনে দাবি করা হয়, শিশুশ্রমিক এবং কৃষিকাজ, খামারের কাজে শিশুর যুক্ত থাকার হার ছত্তিশগড় ও নাগাল্যান্ডে বেশি। যা জাতীয় গড়ের থেকে অনেকটা বেশি, যথাক্রমে ৮৫.০৯ শতাংশ এবং ৮০.১৪ শতাংশ। তা বাদে, মধ্যপ্রদেশে ৭৮.৩৬ শতাংশ,  রাজস্থানে ৭৪.৬৯ শতাংশ, বিহারে ৭২.৬৯ শতাংশ, ওডিশায় ৬৯ শতাংশ এবং অসমে ৬৪.৪২ শতাংশ।

ওই প্রতিবেদনে আরও বলা হচ্ছে যে, কৃষিকাজ তো বটেই, বাকি নানা ধরনের কাজের সঙ্গে যুক্ত থাকা শিশু ও কিশোর-কিশোরী শ্রমিকদের বেশিরভাগই ন্যূনতম শিক্ষার সুযোগ থেকেও বঞ্চিত। ভারতের প্রায় ৪ কোটি শিশুশ্রমিকের মধ্যে প্রায় ৯৯ লক্ষ শিশুশ্রমিক শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে যাওয়ার সুযোগ পেয়ে থাকে। বাকিরা বঞ্চিত হন।

শিশুশ্রমিকের নেপথ্য কারণ
ইউনিসেফ বা রাষ্ট্রপুঞ্জের (United States) ইন্টারন্যাশনাল লেবার অর্গানাইজেশন বলছে, বিভিন্ন কারণে একজন শিশুকে এই দুর্বিষহ অবস্থার শিকার হতে হয়। যেমন: দারিদ্র। আর্থিকভাবে স্বচ্ছল নয় এমন পরিবারের সন্তানের পড়াশোনার তুলনায় অধিকাংশ ক্ষেত্রেই এগিয়ে যেতে হয় খাবার জোগাড় করতে। অর্থাৎ অর্থ নেই, খাবার প্রয়োজন। বাঁচতে হবে। এই অবস্থা থেকে শ্রমের দিকে এগিয়ে যেতে হয় বাড়ির শিশুকেও কাউকে উদ্বাস্তু অবস্থার শিকার হতে হলে সেখানেও তৈরি হয় শ্রম। অর্থাৎ নিজের সবটা ছেড়ে অন্যত্র জাঁকিয়ে বসার আগেই শ্রমের অন্ধকারের অতলে নিমজ্জিত হয় শৈশব।

পরিস্থিতির শিকার। অনেক ক্ষেত্রেই দেখা যায়, চা-বাগান অথবা এমন কিছু কাজ, যা শিশুদের দিয়ে করালে সুবিধা হবে মালিকপক্ষের। ঠিক এখানেই দরিদ্র পরিবারের নাবালক সদস্যদের কাজে লাগানো হয়। ২০১৭ সালে শিশুশ্রমের কারণ বিশ্লেষণে উঠে আসে ভয়ের প্রসঙ্গ। প্রভাবশালীদের ভয়ে অনেক ক্ষেত্রেই কম বয়সে কাজ করতে হয় বহু শিশুকে। কেমন করে পাশ্চাত্যের একাধিক দেশে কফি, চেরি বাগানে কাজ করে দরিদ্র পরিবারের শিশুরা। আবার বহু খামারে পশু প্রতিপালনের জন্য ব্যবহার হয় সুলভ মূল্যের এই শ্রমিকদের। যা ভারত অথবা দক্ষিণ এশিয়ার বহু দেখে দেখা যায়। কিন্তু ভিন্নভাবে। বস্ত্র শিল্প, চাবাগান, খামার এবং চায়ের দোকানের মতো কাজে আধিক্য লক্ষ্য করা যায় শিশুদের।

শিশুশ্রমের বিপদ
মনোবিদরা বলেন, একটি শিশু ঠিক যে সময়ে তার মানসিক বিকাশকে আত্মীকরণ করবে। অর্থাৎ তার সার্বিক বিকাশ ঘটবে, সেই সময় এই শ্রমের বিকাশ দীর্ঘমেয়াদি ক্ষতি করতে পারে। শারীরিক তব বটেই এই ক্ষেত্রে মানসিক স্বাস্থ্য ক্ষতিগ্রস্ত হয়। কারণ, সে তো আর নিজে থেকে চাইছে না!

এইটুকু বয়সেই কাজ করতে। যে কাজ তার মনের মতো নয়। হয়তো সে খেলা করতে ভালোবাসে। কিন্তু দেখছে, দিনের পর দিন কোনও চায়ের দোকানে কাপ ধুচ্ছে। আবার চা বাগানে পাতা তুলছে। আবার কফি তৈরি করছে। এই যে কষ্টের কাজ। নিজের চাহিদার মতো নয়, এটা তার নিজের জীবনে প্রভাব ফেলবে। এখানেই তৈরি হয় বিপদ। এক-একটি শিশু শৈশবের বদ্ধ পরিসরে মারাত্মক বিপদের সম্মুখীন হয়। যা পরবর্তীকালে কালে যে সার্বিক ক্ষতি করবে না। একথা বলা যায় না।

শিশুশ্রম-রোধে ভারতের অবস্থান
দেশের স্বাধীনতার প্রাক মুহূর্ত এবং ব্রিটিশ শাসনের কালো দিক কাটিয়ে ওঠার পর পরই ভারতের সরকার অবস্থান নেয়, শিশুশ্রম শূন্যে নামিয়ে আনার জন্য। ঠিক প্রেক্ষাপটে দাঁড়িয়েই ১৯৭৬ সালে শিশু শ্রম প্রতিরোধ এবং তা হলে কী কী ব্যবস্থা এই প্রসঙ্গে আসে আইন। ২০১৬ সালে নরেন্দ্র মোদি সরকারের আমলে যার খানিকটা বদল ঘটে। এদিকে গুরূপদস্বামী কমিটির মতো একাধিক কমিটি, প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমেও শিশুশ্রম প্রতিরোধে ব্যবস্থা করা হয়।

দেশের শ্রম মন্ত্রক থেকেই বারবার এই বিষয়টি প্রতিহত করার চেষ্টা করা হয়। এমনকি, কেয়ার ইন্ডিয়া, চাইল্ড রাইটস অ্যান্ড ইউ হ্যান্ড  ইন হ্যান্ড- এর মতো সংগঠনও এই বিষয়ে কাজ করে চলেছে। এমনকি শিশু অধিকার আইন নিয়েও তৎপর সরকার। রাজ্যে রাজ্যে মন্ত্রক, কমিশন এবং ভিন্ন ভিন্ন কর্মসূচিতেও এই বিষয়টি নিমূর্ল করার চিন্তাভাবনা চলে। কিন্তু ফলাফল?

শিশুশ্রম প্রতিরোধ
উন্নত বিশ্ব, উন্নত ভারতের আঙিনায় শিশুশ্রম এক মারাত্মক অভিশাপ! যা প্রতিহতর জন্য ইউনিসেফ বলছে, সবার প্রথমে শিশুদের স্বাধীন মুক্ত শৈশব যে উপহার দিতে হবে একথা নিশ্চিত করতেই হবে। এছাড়া এই বিষয়ে ইউনিসেফ পাঁচটি বিষয়ের কথা বলছে!

এক, শিশুদের সুরক্ষা। স্বাস্থ্য, সামাজিক এবং নিরাপত্তা। প্রত্যেককে এই সুরক্ষা দেওয়ার কথা ভাবতে হবে, নিশ্চিত করতে হবে।

দুই, শিশুদের দক্ষতা বৃদ্ধি এবং তাদের মতামতকেও প্রাধান্য দেওয়ার কথা ভাবতে হবে।

তিন, উদ্বাস্তু থেকে শুরু করে সমাজের যেকোনও অংশের শিশু নিয়ে বিরূপ মনোভাব ত্যাগ করতে হবে।

চার, বিভিন্ন মুহূর্তে কথা বলতে হবে।আলোচনা করতে হবে। আলোচনা বাড়াবে সচেতনতা। আর সেখানেই উপকার হতে পারে।

পাঁচ, আর্থিকভাবে স্বচ্ছল করা। শিশুশ্রম যাতে না বাড়ে তাই, অন্যভাবে হলেও ব্যস্থা করা উচিত।

শিশুশ্রমিকের জবানবন্দি
বিশ্বের কোণায় কোণায় ছড়িয়ে রয়েছে অভাগার দল। আমরা কথা বলেছিলাম এমন কয়েক জনের সঙ্গে। সামাজিক নিরাপত্তার তাগিদে প্রত্যেকের নাম পরিবর্তিত।

সাদ্দাম গাজী। উত্তর ২৪ পরগনার জগদীঘাটা এলাকায় বাস। বয়স এখন ১৬। ৪ বছর আগে থেকে পা ভ্যান চালায় সাদ্দাম। সপ্তম শ্রেণিতে পড়ার সময় স্কুল ছাড়তে হয়েছে। সাদ্দামের কথায়, ''২০১৮ সালে দুর্ঘটনায় আমার বাবা মারা যান। মা প্রতিবন্ধী। আমি যদি কাজ না করি খাব কী!''

অমল মণ্ডল। বারাসতের একটি চায়ের দোকানে কাজ করে ৩ বছর ধরে।এখন তার বয়স ১৫। তার কথায়, এখানেই থাকি, খায়। বাড়িতে বাবা, মা এবং আর এক বোন রয়েছে। "মা কলকাতায় কাজ করতে যায়। আমি যদি কাজ না করি, এখানে যা খাবার পাই, এর কিছুই জুটবে না।''

মনিকা প্রধান। বয়স ১৩ বছর। একটি বাড়িয়ে রাতদিন থাকে। কাজ করে। শিক্ষিত পরিবারের আবার তার বয়স নিয়ে হেলদোল নেই! মনিকার কথায়, ''আমরা দুই বোন। মা লোকের বাড়ি কাজ করে। বাবা নেই। আমার বোন একই কাজ করে। কাজ না করলে চাপ বাড়ে। একটু ভালো থাকার জন্য কাজ করি।'' "আর পড়াশোনা? করেছি, চতুর্থ শ্রেণি পর্যন্ত। তারপর আর যায়নি।"

সাগর দাস। সদ্য আত্মঘাতী হয়ে মারা গিয়েছেন ওর বাবা। বয়স মাত্র ১৭। গাড়ির খালাসির কাজ করে। তার কথায়, "বাবা যেদিন গেল মা নামল লোকের বাড়িতে কাজে। আমি গাড়িতে। কী করব। ক্লাস নাইননে পড়তাম।'' প্রায় একই অবস্থা রাজু সরকারের। কাজের সুত্রে এত কম বয়সেই তাকে যেতে হয়েছে তামিলনাড়ু। তার কথায়, ''কলকাতায় কাজ নেই। সেখানেই একটা ব্যাগের কারখানায় কাজ করতাম। এখানে কাজ করছি। মা অসুস্থ। কাজ ছাড়া আর কিছু করার উপায় নেই!'' ঠিক একই অবস্থা রিনা, মিলন, অসীমদের। যেখানে প্রত্যেক মুহূর্তে জমা হচ্ছে ক্ষোভ আর অনিচ্ছার ইঙ্গিত! যা বাড়িয়ে দিচ্ছে বিপদ। বাড়াচ্ছে আশঙ্কাও। প্রশ্ন উঠছে, এত আধুনিকতার মাঝেও এই অন্ধকারের দায় কার! উত্তর?

More Articles