ইলিশের স্বাদ থেকে বঞ্চিত হবে বাঙালি?

প্রয়োজন Hilsa Fisheries Action Plan-এর যাতে উপযুক্ত বাস্তবায়ন হয়, তা নিশ্চিত করা। নাহলে বঙ্গদেশের জাতীয় মাছের ভবিষ্যৎ আরও অন্ধকারে তলিয়ে যাবে। বাঙালি বঞ্চিত হবে তার প্রাণের ইলিশের স্বাদ থেকে।

জুন মাস শেষ হতে চলল। প্রকৃতির স্বাভাবিক নিয়ম মেনে বর্ষা ছড়িয়ে পড়েছে উত্তর গোলার্ধের বিভিন্ন দেশে। দুই বাংলাতেও এখন মৌসুমী বায়ুর দাপটে এসে গেছে বর্ষার মরশুম। আর বর্ষা মানেই বাঙালি আগে বাজারে গিয়ে খোঁজ করবে মাছের রাজা ইলিশের। সেক্ষেত্রে ভুলে যাবে দরদাম করা। যত বেশিই দাম হোক না কেন, রূপোলি শস্য, তাকে পাতে তুলতেই হবে। আর হবে নাই-ই বা কেন? স্বাদে বা গন্ধে ইলিশের তুলনা কি চলে? বিশেষ করে সেই ইলিশ যদি বাংলাদেশের নদীর হয়।

তবে বাংলাদেশ চিন্তিত। চিন্তিত মৎস্যজীবীরা, চিন্তিত ক্রেতারা। কেন? কারণ ইলিশের স্বাদ, গন্ধ সব বদলে যাচ্ছে আস্তে আস্তে। কারণ? পরিবেশ দূষণ। চিন্তায় পড়ে গেলেন? হ্যাঁ, চিন্তা করার অনেক সংগত কারণ রয়েছে। একটু খতিয়ে দেখা যাক।

বাংলাদেশে ছোট-বড় মিলিয়ে প্রায় ৫০টির মতো নদী আছে। তার মধ্যে মূলত মেঘনা, পদ্মা, সুরমা নদীর ইলিশই সবচেয়ে বিখ্যাত। কিন্তু পরিবেশ দূষণ ছাপ ফেলছে এই নদীগুলির ওপরেও। বাংলাদেশ মৎস্য গবেষণা ইনস্টিটিউটের রিপোর্ট বলছে, অনিয়ন্ত্রিত দূষণ ব্যাপক প্রভাব ফেলছে ইলিশের প্রজনন এবং স্বাস্থ্যের ওপর। নদীর গভীরতা কমে যাওয়া, প্রতিনিয়ত লক্ষ লক্ষ লিটার দূষিত বিষাক্ত জলের প্রবেশ করা, এবং সমুদ্র থেকে অতিরিক্ত নোনা জল ঢুকতে থাকা চূড়ান্ত ক্ষতি করছে বাঙালির প্রিয় ইলিশের প্রজনন এবং স্বাস্থ্যের।

আরও পড়ুন: বাংলাদেশে যেভাবে ফিরে এল ইলিশের সুদিন

২০২০ সালের সেপ্টেম্বরে গবেষকরা মুনশিগঞ্জের নিকট গজাইয়া এবং সাতনালিনে কোনও ইলিশই খুঁজে পাননি। যেখানে লকডাউনের কারণে সব শিল্প বন্ধ থাকায় অনেক বেশি ইলিশ উৎপাদন আশা করা হয়েছিল। গবেষকরা দেখেন যে, মেঘনার যে অঞ্চলে ইলিশ সাধারণত বেশি দেখা যায়, সেখান থেকে সরে গিয়ে ইলিশ শরৎপুরের দিকের পদ্মার কাছে প্রজনন করছে। মেঘনার যে অঞ্চলে গবেষকরা ইলিশ খুঁজে পাননি, সেই অঞ্চল মুনশিগঞ্জ, নারায়ণগঞ্জ এবং নরসিংদির পাশ দিয়ে বয়ে যায়। এই তিনটি জায়গাই শিল্পাঞ্চল। প্রচুর কলকারখানা রয়েছে এখানে। বিশেষ করে চামড়ার, বস্ত্রের। সেখানকার বিষাক্ত, রাসায়নিক-যুক্ত বর্জ্য সারাক্ষণ নদীতে মিশছে। লক্ষ লক্ষ লিটার দূষিত জল।

ইলিশ অত্যন্ত সংবেদনশীল মাছ। সেই সঙ্গে পরিযায়ীও। সে তার গতিপথ খুব সহজেই পাল্টে নেয়। কিন্তু তাতেও সে নিজের গুণমান ধরে রাখতে পারছে না। গাজীপুর, ঢাকা, মুনশিগঞ্জের বিষাক্ত জল তার ইন্দ্রিয়গুলিকে ক্ষতিগ্রস্ত করছে। সেই সঙ্গে আছে নদীর মজে যাওয়া, যার ফলে বিচরণক্ষেত্রও কমে যাচ্ছে, আর নদীর ওপর নৌকো, ট্রলার, লঞ্চ, জাহাজ চলাচল তো আছেই। তারও সঙ্গে যোগ হচ্ছে প্লাস্টিক দূষণ। গোদের ওপর বিষফোড়ার মতো যোগ হচ্ছে বেআইনিভাবে বালি উত্তোলন। ইলিশ যাবে কোথায়? পালানোর কোনও পথ নেই। ফলে জনসংখ্যা কমছে, আর যারা বেঁচে যাচ্ছে, তাদের সেই স্বাদ, বা গন্ধ কিছুই থাকছে না। ইলিশের শরীরের ভেতর কাদাবালির পরিমাণ বাড়ছে। বাড়ছে বিষাক্ত ধাতুর পরিমাণ। স্বাদ, গন্ধের অভাবের সঙ্গে তা বাড়াচ্ছে স্বাস্থ্যহানি। মৎসজীবীরা হা-হুতাশ করছেন।

পরিবেশকর্মীদের মতে, সরকার যতক্ষণ না কড়া হাতে দূষণ নিয়ন্ত্রণ করছে, ততক্ষণ এই দুর্দশা চলবে, আরও বাড়তে পারে। প্রয়োজন নদীর ধারের শিল্পাঞ্চলে নজরদারি। যেভাবে উপকূলবর্তী এলাকায় দেদারে তাপবিদ্যুৎ কেন্দ্র গড়ে তোলা হয়েছে, তা বিপজ্জনক। তার নিষ্পত্তি প্রয়োজন। প্রয়োজন Hilsa Fisheries Action Plan-এর যাতে উপযুক্ত বাস্তবায়ন হয়, তা নিশ্চিত করা। নাহলে বঙ্গদেশের জাতীয় মাছের ভবিষ্যৎ আরও অন্ধকারে তলিয়ে যাবে। বাঙালি বঞ্চিত হবে তার প্রাণের ইলিশের স্বাদ থেকে।

More Articles