গ্রীষ্মে প্রজাদের জলকষ্ট ছিল না || ইতিহাসে উপেক্ষিত রয়ে গেল বাংলার এই রাজবংশ

ইতিহাসের পাতায় উপেক্ষিত রাজবংশের তালিকায় মল্ল রাজাদের নাম বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। এই রাজবংশের তালিকা অতি দীর্ঘ। এই বংশের প্রতিষ্ঠাতা আদি মল্ল (আনুমানিক ৬৯৫ খ্রিস্টাব্দ) থেকে শুরু করে শেষ রাজাকালিপদ সিংহ ঠাকুর পর্যন্ত প্রায় ৬২ জন  এই বংশে রাজত্ব করে গেছেন। বর্তমানে রাজপাট নেই, কিন্তু এই বংশের বংশধরেরা এখনও এখানেই ছড়িয়েছিটিয়ে আছেন। সংস্কৃত ভাষায় 'মল্ল' কথাটির অর্থ 'কুস্তিগির'। এই বংশের প্রতিষ্ঠাতা আদি মল্ল বাগদি রাজা নামে পরিচিত ছিলেন। তবে এই বংশের উৎপত্তি কোথা থেকে হলো, তা সঠিকভাবে বলা যায় না। কিন্তু এটা অনুমান করা যায় যে, সেই সময় বিষ্ণুপুর ও তৎসংলগ্ন এলাকা 'মল্লভূম' নামে পরিচিত ছিল, সেই কারণেই রাজপরিবারটি মল্ল বংশ নামে পরিচিতি লাভ করেছে।

আদি মল্ল প্রায় ৩৩ বছর রাজত্ব করে গেছেন। এরপর তাঁর পুত্র জয় মল্ল পদ্মপু্র জয় করে, তৎকালীন দূর্গটি শক্তিকেন্দ্র হিসেবে দখল করেছিলেন। তিনি রাজ্যকে আরও প্রসারিত করেন। এই বংশের সর্বাধিক খ্যাতিমান রাজারা হলেন কানু মল্ল, বেণু মল্ল, ঝাউ মল্ল, সুর মল্ল প্রমুখ। তবে ৪৯-তম রাজা বীর হাম্বির ছিলেন একজন অত্যন্ত ধার্মিক এবং একাধারে শক্তিশালী রাজা। বীর হাম্বির, শ্রীমন্ত দেব হাম্বির নামে পরিচিত ছিলেন। তিনি বারো ভুঁইয়াদের অন্যতম ছিলেন। রাঢ়বঙ্গে পাঠানদের আক্রমণ রুখে দিয়েছিলেন তিনি। পাঠানরা মুণ্ডমালা ঘাট-সহ বিভিন্ন অঞ্চল থেকে একপ্রকার পালিয়ে যায়। হাম্বিরের উত্তরসূরি রাজা রঘুনাথ প্রথম সিংহ উপাধি পান। কথিত আছে, মুর্শিদাবাদের তৎকালীন নবাব তাঁকে এই উপাধি প্রদান করেন। এরপর থেকেই এই বংশের রাজারা ক্ষত্রিয়দের ন্যায় 'সিংহ' উপাধি ব্যবহার করতেন।এই বংশ ছিল যেমন শক্তিশালী, ঠিক তেমনি ধর্মপরায়ণ। খ্রিস্টীয় সপ্তম শতাব্দী থেকে ব্রিটিশ শাসন শুরু হওয়ার আগে পর্যন্ত প্রায় ১০০০ বছর বাঁকুড়ার ইতিহাস মল্ল রাজবংশের উত্থান-পতনের সঙ্গে অঙ্গাঙ্গীভাবে জড়িয়ে আছে।

মল্লরাজাদের রাজধানী ছিল বিষ্ণুপুর।এই শহরটিকে মন্দির শহর বললেও অত্যুক্তি হবে না। বিষ্ণুপুরজুড়ে ছড়িয়ে রয়েছে কারুকার্যমণ্ডিত মন্দিরের সমারোহ। মন্দিরের গায়ে টেরাকোটার অসাধারণ কারুকার্য মুগ্ধ করে।মল্ল রাজ হাম্বির চৈতন‍্য মহাপ্রভুর পরম ভক্ত ছিলেন, তাই এঁরা সকলেই কৃষ্ণভক্ত। শাঁখারিবাজারে মদনমোহন মন্দির, মাধবগঞ্জে মদনগোপাল মন্দির, বসুপাড়ায় শ্রীধর মন্দির, রাসতলায় রাসমঞ্চ, এছাড়া রাজদরবার ও কালাচাঁদ-সংলগ্ন এলাকায় প্রচুর মন্দির রয়েছে। মল্লরাজারা খুব সংগীতপ্রিয় ছিলেন। দিল্লি থেকে তানসেনপুত্র বাহাদুর খাঁ-কে আনিয়ে বিষ্ণুপুর ও ভারতীয় মার্গসংগীতের প্রসার ঘটান। একটি আলাদা ঘরানা তৈরি হয়। তার নাম 'বিষ্ণুপুরী ঘরানা'।

রাজধানী রক্ষার ব্যাপারে মল্লরাজাদের বিশেষ লক্ষ্য ছিল। রাজধানীকে রক্ষা করার নিমিত্তে তাঁরা অনেকগুলি 'গড়' তৈরি করান। প্রত্যেকটি গড়ের খাঁজে খাঁজে কামান রাখা থাকত। রাজবাড়িতে প্রবেশ করার মুখেই গড় দরজা তৈরি হয়। একটি ছোট ও একটি বড়। সুরক্ষিত রাখতে রাজবাড়ির চারপাশে পরিখা কাটা হয়েছিল, শত্রুপক্ষের আসার খবর পেলেই সেই পরিখা জলপূর্ণ করে দেওয়া হত। দুর্ধর্ষ মারাঠি বর্গী ভাস্কর পণ্ডিত এই কারণে দুর্গে প্রবেশ করতে পারেননি।

আরও পড়ুন: অন্য ধর্মে প্রেম, উদ্ধার হওয়া নরকঙ্কাল || অভিশপ্ত চিহ্ন বহন করছে এই জেলা

মল্লরাজারা ছিলেন বীর যোদ্ধা, ন্যায়পরায়ণ, ধার্মিক,।প্রজাবৎসল ও অত্যন্ত বুদ্ধিমান। এছাড়া শিল্প ও গুণের কদর করতেন।প্রজাদের কষ্ট লাঘব করার জন্য বিভিন্ন রাজার আমলে মোট সাতটি সুবৃহৎ বাঁধ নির্মাণ করা হয়।সেগুলি হল- লাল বাঁধ, শ্যাম বাঁধ, কৃষ্ণ বাঁধ, যমুনা বাঁধ, পোকা বাঁধ বা বীর বাঁধ, কালিন্দি বাঁধ ও গাঁথার বাঁধ।

রাঢ়বাংলার দেশ বাঁকুড়া রুক্ষ-শুষ্ক হওয়া সত্ত্বেও প্রজাবৎসল মল্লরাজাদের বুদ্ধিমত্তায় প্রখর, গ্রীষ্মেও প্রজাদের জলকষ্টে ভুগতে হত না।

বিষ্ণুপুরের টেরাকোটার শৈলির ওপর ভিত্তি করে তৈরি হাতি-ঘোড়ার মূর্তি জগৎবিখ্যাত। পাঁচমুড়া, রাজগ্রাম, সোনামুখী বা হামিরপুর অঞ্চলের হস্তশিল্পের সুখ্যাতি জগৎজোড়া। বিষ্ণুপুরের তাঁতশিল্প ও বিষ্ণুপুরী সিল্কের জগৎজোড়া সুনাম।

বিষ্ণুপুরের মল্ল রাজবংশ সংগীতপ্রেমী, ধার্মিক, শিল্পকলার পৃষ্ঠপোষ কৃতি দেয় না। ১৭৭০ সালে দুর্ভিক্ষ হওয়ার ফলে রাজ্যের পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যায় এবং এককালের রাজবংশ নিছক জমিদারের পর্যায়ে নেমে আসে। এরপর ১৭৮৭ সালে, বিষ্ণুপুর-বীরভূমের সঙ্গে একত্রিত হয়ে যায়, ফলে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যায়। তখন বিষ্ণুপুরের লোকেরা 'চুয়াড়' বা 'ডাকাত' নামে পরিচিতি লাভ করে।

ক, প্রজাবৎসল এবং অত্যন্ত শক্তিশালী হওয়া সত্ত্বেও ইতিহাস তাঁদের শশাঙ্ক, চন্দ্রগুপ্ত, সমুদ্রগুপ্ত বা চন্দ্রবর্মন-দের মতো স্বী

[তথ্যসূত্রঃ-bankura.gov.in এবং Megh Bristi (সুপর্ণা ঘোষ)]

More Articles