অন্য ধর্মে প্রেম, উদ্ধার হওয়া নরকঙ্কাল || অভিশপ্ত চিহ্ন বহন করছে এই জেলা

ইতিহাস-প্রসিদ্ধ স্থান বিষ্ণুপুর। এখানে যেমন রয়েছে টেরাকোটার কারুকার্যখচিত নানা মন্দির, ঠিক তেমনই রয়েছে অলৌকিক নানা কাহিনি। রাজপরিবারের নানা কিংবদন্তি আজও মানুষের মুখে মুখে ফেরে।

১৭০০ সালের কিছু পরের কথা। বারংবার বর্গী এবং অন্যান্য দস্যুর আক্রমণে বিপর্যস্ত বাংলার মানুষের জীবনযাত্রা। সুজলা-সুফলা-শস্যশ্যামলা বাংলার প্রতি সকলের দৃষ্টি। একবার বর্গী আক্রমণ হলো বিষ্ণুপুরে। বীর মল্লরাজাদের রাজভূমি হলো বিষ্ণুপুর।প্রানপণ লড়াই করেও একসময় পিছু হঠতে লাগল সৈন্যসামন্ত। দীর্ঘদিন যুদ্ধ করে তারা ক্লান্ত, বিপর্যস্ত। তৎকালীন মহারাজা গোপাল সিংহ দেবের (মতান্তরে তৎকালীন মল্লরাজ ছিলেন 'বীর হাম্বীর') পরাজয় নিশ্চিত। তিনি তখন মন্দিরে উপাস্য দেবতার সামনে বসে প্রার্থনা করছেন, প্রজাদের সুরক্ষার জন্য। এমন সময় দেখা গেল, স্বয়ং মদনমোহন মন্দির থেকে বেরিয়ে এসে রক্ষাকর্তার ভূমিকায় অবতীর্ণ হয়ে কামান নিয়ে যুদ্ধ করছেন। সৈনিকদের মনোবল বেড়ে গেলো, তারা নতুন উদ্যমে যুদ্ধ করতে লাগল। কামানটির নাম 'দল-মর্দন' অর্থাৎ, বর্গী দলকে মর্দন বা বিনাশ করেছিল যে কামান। কিন্তু কামানটি 'দলমাদল' নামেই পরিচিত।

মদনমোহন বিষ্ণুপুরের আরাধ্য দেবতা। তাঁর স্পর্শ ধন্য দলমাদল কামানটি সংরক্ষিত করে রাখা হয়েছে। এটি এমনভাবে তৈরি করা হয়েছিল যে, এখনও পর্যন্ত কামানটিতে মরচে ধরেনি, আশ্চর্যভাবে অক্ষত রয়েছে। এটি তৈরি করেন বিশ্বকর্মা জগন্নাথ কামার। ঐতিহাসিকরা বলেন, এই কামানটি কুমার জগৎ সিংহ উপহারস্বরূপ মল্ল রাজাদের দিয়েছিলেন। এই কামান ঘিরে নানারকম কিং বদন্তি  ছড়িয়ে রয়েছে মন্দির-নগরী বিষ্ণুপুরের আনাচকানাচে। 'দলমাদল' মল্লভূমের গর্ব। এত বড় কামান সাধারণত দেখা যায় না। মধ্যযুগের তিনটি মহাকামানের অন্যতম শ্রেষ্ঠ কামান এটি। দলমাদল-কে এখন যেখানে স্থাপন করা হয়েছে, পূর্বে সেই স্থানে ছিল না।কয়েক গজ দূরে পাত্রসায়র বা পাটসায়র নামক একটি পরিখার পাঁকে আধডুবন্ত অবস্থায় এটিকে পাওয়া যায়। কামানটির তলদেশের ঔজ্জ্বল্য কাদা জলে থাকার ফলে অনেকাংশে নষ্ট হয়ে গেছে। এখানেও একটি জনশ্রুতি আছে যে, মদনমোহন যুদ্ধশেষে তাড়াতাড়ি মন্দিরে ফিরে যাওয়ার সময় দলমাদলকে পাটসায়রের জলে ফেলে দিয়ে চলে যান। অতীতের গৌরবময় ইতিহাসের সাক্ষী বিষ্ণুপুরের অহঙ্কার এই 'দলমাদল'। মানুষের বিশ্বাস ও ভালবাসা জড়িয়ে রয়েছে এর সঙ্গে, তাই ঐতিহাসিকরা কী বলেন, তাতে কিংবদন্তির ভিত একটুও নড়ে না।

আরও পড়ুন: বর্ধমানের রানি বসন্তকুমারীর পরকীয়া ও প্রথম বিধবাবিবাহ ।। ফিরে দেখা নাটকীয় আখ্যান


বিষ্ণুপুরের মল্লরাজাদের ইতিহাসের এক করুণ (কারও কারও বিচারে কলঙ্কিত) অধ্যায় মল্লরাজ দ্বিতীয় রঘুনাথ সিংহ ও লালবাঈ-এর প্রেম কাহিনি। সংগীতপ্রেমী রঘুনাথ সিংহ সত্যিই ভালবেসেছিলেন লালবাঈকে। এই লালবাঈ ছিলেন একজন মুসলিম নর্তকী। তাকে সুদূর পারস্য থেকে আনা হয়েছিল। আবার অনেকের মতে, লালবাঈ ছিলেন আফগান সর্দার রহিম খাঁ-র পত্নী। লালবাঈ-এর অসামান্য রূপ, তার সুললিত কণ্ঠের গান মহারাজাকে করেছিল বিমুগ্ধ এবং রানি চন্দ্রপ্রভার কাছ থেকে দূরে সরিয়ে নিয়ে গিয়েছিল।

বিষ্ণুপুরের সাতটি জলাশয়ের একটি জলাশয় ছিল লালবাঈ-এর নামানুসারে। মহারাজা দ্বিতীয় রঘুনাথ একটি জলাশয় তৈরি করান তাঁর ভালবাসার প্রমাণ স্বরূপ। এক সুরম্য প্রাসাদ তৈরি করান লালবাঈ-এর থাকার জন্য। একটি উদ্যানও তৈরি করান, নাম দেন 'লালবাগ'। উদ্যানের সামনেই লালদীঘি। এদিকে রানি চন্দ্রপ্রভা, যাঁকে মহারাজা যুবরাজ থাকাকালীন বিবাহ করে জ্যেষ্ঠা মহিষীর মর্যাদা দেন, তিনি ছিলেন চেতোয়া-বরদার রাজা শোভা সিংহের কন্যা, তিনি কিছুতেই সেই জ্বালা সহ্য করতে পারছিলেন না। রাজ্যে তখন অনাবৃষ্টি, মহারাজার রাজধর্মে এবং রাজ্যের কোনও কাজেই মন নেই। তিনি শুধুমাত্র লালবাঈ এর মহলেই সময় কাটান। শোনা যায়, তিনি লালবাঈকে বিবাহও করেন। যদিও তা নিয়ে মতভেদ আছে। বৈষ্ণব বংশের সংস্কার ভুলে লালবাঈ-এর অনুরোধে তিনি মুসলমান হওয়ার প্রস্তুতি নেন। প্রথম দিকে তিনি মৃদু আপত্তি জানালেও পরে রাজি হয়ে যান। শোনা যায়, মহারাজের ঔরসে লালবাঈ-এর গর্ভে একটি পুত্রসন্তান জন্মায়। রাজনীতির খেলা এখানেই শুরু। তখনই পুত্রকে সিংহাসনে বসানোর স্বপ্ন দেখতে শুরু করেন লালবাঈ। এরপর সম্পূর্ণভাবে লালবাঈ-এর বশংবদ মহারাজা, রাজ্যসুদ্ধ সকল প্রজাকে আদেশ দেন মুসলিম ধর্মে, ধর্মান্তরিত হওয়ার জন্য। রাজার আদেশে বিষ্ণুপুর শ্মশানঘাটের নিকটে
নতুন মহলের কাছে যে ভোজনতলা বর্তমান, সেখানেই ১৭১২ খ্রিস্টাব্দের এক মধ্যাহ্নে নারী-পুরুষ নির্বিশেষে শত-সহস্র প্রজাকে নিষিদ্ধ মাংস ভোজন করিয়ে জাতি ধর্ম নাশের ব্যবস্থা করা হলো।

বহুবার বোঝানো সত্ত্বেও অবুঝ রাজাকে বোঝাতে অক্ষম রানি চন্দ্রপ্রভার কাছে এই সংবাদ পৌঁছল। রাজ্য রক্ষা, ধর্মরক্ষা, পূর্বপুরুষের মান-সম্ভ্রম রক্ষার সবটুকু দায়িত্ব নিজ কাঁধে তুলে নিলেন তিনি। কিশোরপুত্র গোপাল সিংহ এবং মন্ত্রীদের সঙ্গে নিয়ে হাজির হলেন ভোজনালয়ে স্বামীর এই নির্লজ্জ মতিভ্রমের সমুচিত উত্তর দিতে। লালবাঈ-এর তত্ত্বাবধানে তখন খাবার পরিবেশনের প্রস্ততি চলেছে। মহারানি চন্দ্রপ্রভা-র নিক্ষেপ করা বিষমাখানো একটি তীক্ষ্ণ তীর মাহারাজা রঘুনাথ সিংহের বক্ষ বিদীর্ণ করে দিল। (ঐতিহাসিক যদুনাথ সরকারের মতে মহারাজা কোনও উঁচু ভবন থেকে পড়ে মারা যান)।

চারদিকে জয়ধ্বনি উঠল, প্রজাগণ ধর্মনাশের হাত থেকে রক্ষা পেল। মহারানি স্বেচ্ছায় সহমরণে গেলেন, রাজা রঘুনাথ সিংহের সঙ্গে। ক্ষিপ্ত প্রজাগণ লালবাঈকে শিকল পড়িয়ে লাল বাঁধের জলে ডুবিয়ে হত্যা করল। লালবাঈ-এর গোলাপ বাগ তছনছ করে দিল, তার প্রাসাদ ভেঙে চূর্ণবিচূর্ণ করে দিল এবং সমস্ত রন্ধনপাত্র জলে নিক্ষিপ্ত করল।


১৮৯৬ সালে এই লালবাঁধ সংস্কারের সময় একটি নরকঙ্কাল এবং কয়েকটি ভাঙা পুরাতন আমলের রন্ধনপাত্র উদ্ধার হয়, এই পাত্রগুলির বৈশিষ্ট্য হলো, এগুলি সাধারণত মুসলিমরাই ব্যবহার করে। শ্যামবাঁধের পশ্চিমে মহারানি চন্দ্রপ্রভার সমাধি মন্দির সতীকুণ্ড অবস্থিত রয়েছে। আজও সকলে বলে, "ওই দেখ 'পতিঘাতিনী সতী'।" ইতিহাস হয়ত তাঁকে পতিঘাতিনী আখ্যা দিয়েছে, কিন্তু সেইদিন ওই পদক্ষেপ গ্রহণ না করলে হয়তো ধর্ম,রাজ্য,সম্মান কোনোটাই বাঁচানো যেত না মল্লসাম্রাজ্যের।

[তথ্যসূত্র: অনিন্দ্য দে, bankura.gov.in]

More Articles